Ajker Patrika

হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিয়ে বিভক্ত এলাকাবাসী

  • বিশ্ববিদ্যালয় আইনে দেখার হাওরের পারে ক্যাম্পাস স্থাপনের কথা বলা আছে। তবে হাওর ভরাটের কথা নেই।
  • একপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাস হবে সড়কের পাশে, হাওরের ক্ষতি হবে না। আরেক পক্ষ বলছে, ক্ষতি হবে অপূরণীয়।
বিশ্বজিত রায়, সুনামগঞ্জ
দেখার হাওরের প্রস্তাবিত এই অংশে হবে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ভরা বর্ষা মৌসুমে প্রায় ছয় ফুট পানির নিচে থাকে এই জমি। ছবি:আজকের পত্রিকা
দেখার হাওরের প্রস্তাবিত এই অংশে হবে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ভরা বর্ষা মৌসুমে প্রায় ছয় ফুট পানির নিচে থাকে এই জমি। ছবি:আজকের পত্রিকা

হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জে হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বহুল প্রত্যাশিত সেই পালে হাওয়া লাগলেও প্রস্তাবিত স্থান নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। স্থানীয়দের একদল বলছে দেখার হাওরের একাংশ ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রকৃতি-পরিবেশের ক্ষতি হবে। আরেক দল এই হাওরেই বিশ্ববিদ্যালয় করার পক্ষে। তবে সুবিপ্রবির ছাত্রদের অভিমত, যেখানেই হোক দ্রুত স্থায়ী ক্যাম্পাস হওয়ার পক্ষে তাঁরা।

সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সুবিপ্রবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী তাকবিল এইচ এস চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দ্রুত ক্যাম্পাস চাই, তা যেখানেই হোক। যে স্থান বাছাই করলে স্থায়ী ক্যাম্পাস দ্রুত হবে, আমরা সেই স্থানের পক্ষে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান নিসাত বলেন, ‘দুই পক্ষের কোন্দলে যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি না হয়। এক্ষেত্রে পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টিও গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’

সুনামগঞ্জ-সিলেট আঞ্চলিক সড়কের বিশাল অংশজুড়ে দেখার হাওরের অবস্থান। সুনামগঞ্জ সদর, শান্তিগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এ হাওর। এর মধ্যে শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস এলাকার দেখার হাওরের ১২৫ একর জলমগ্ন জমি ভরাট করে সুবিপ্রবির ক্যাম্পাস স্থাপনে ২০২৩ সালের ১৩ জুন অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রকল্প ব্যয় ২৯৯ কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে দেখার হাওর পারে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা আছে। তবে হাওর ভরাট করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস করার কথা উল্লেখ নেই।

মত-ভিন্নমত: জেলা শহর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত জায়গার দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। অভিযোগ আছে, দেখার হাওরের ওই জায়গা সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের বাড়ির কাছে বিধায় তা বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে সাবেক ওই মন্ত্রী জানিয়েছেন, এর চেয়ে ভালো জায়গা থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে করা হোক।

দেখার হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত বাতিলের তাগিদ দিয়ে হাওর এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে হাওরের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। দেখার হাওরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি ধান ও মাছের উৎপাদন কমবে। সম্প্রতি প্রকাশিত দেশের নদ-নদীর তালিকাভুক্ত নাইন্দা নদী একদম মরে যাবে। এ ছাড়া মহাসিং নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তবে এ নিয়ে ভিন্নমত আছে স্থানীয়দের। জয়কলম বাজারে গেলে কথা প্রসঙ্গে ওই গ্রামের মো. মুজিবুর রহমান ও পার্শ্ববর্তী ফতেপুর গ্রামের রামচরণ দাস বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শান্তিগঞ্জ না, গোটা সুনামগঞ্জের জন্য আশীর্বাদ। বিশ্ববিদ্যালয় হাওরে না, সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের কিনারে হবে। হাওরের বিষয় টেনে ক্ষতির কথা বলা হলেও আসলে সে রকম ক্ষতি হবে না।

তবে ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস জেলা সদরে বাস্তবায়ন’ আন্দোলনের আহ্বায়ক আইনজীবী হুমায়ুন মঞ্জুর চৌধুরী বলেন, ‘হাওর ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হোক, এটা কেউ চায় না। আমরা লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের জুগিরগাঁও, গৌরারং ইউনিয়নের রতনশ্রী ও পৌর এলাকার হাসননগরে ক্যাম্পাস স্থাপনের প্রস্তাবনা তুলে ধরেছি।’

আবার শান্তিগঞ্জের নির্ধারিত স্থানেই দ্রুত ক্যাম্পাস করার দাবিতে একাট্টা শান্তিগঞ্জ ও আশপাশের লোকজন। তাঁরা মনে করছেন, সুনামগঞ্জ পুরো জেলাই হাওরবেষ্টিত। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হাওরে করা ছাড়া বড় কোনো জায়গা নেই।

যে জায়গায় ক্যাম্পাস হবে, সেটা হাওরের দক্ষিণ প্রান্তে, মাঝখানে না; অভিমত শান্তিগঞ্জ উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মো. আবু সঈদের। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত স্থানের বেশির ভাগই খাসজমি। এখানে ইরি ধানের আবাদ হয়। এই ধান আবাদের জমি বেশি গভীর থাকে না। পরিবেশ নষ্টের দোহাই দিয়ে শান্তিগঞ্জবাসীর সঙ্গে হিংসাত্মক আচরণ করছেন সুনামগঞ্জের কিছুসংখ্যক মানুষ।

হাওর ভরাট করে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় করার পক্ষে না, এমনটি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় করার সিদ্ধান্ত আগের সময়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা দায়িত্ব নিয়ে জলাভূমি, বনভূমি, বসতভিটা, পাহাড় অধিগ্রহণ করে তা করা যাবে না, এমন নির্দেশনা দিয়ে রেখেছি।’

তবে সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার জানিয়েছেন, হাওর কিংবা জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ পরিবেশ অধিদপ্তর সমর্থন করে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি সাপেক্ষে সেটা করা যাবে।

দ্বন্দ্ব নিরসন করে বিশ্ববিদ্যালয় হোক, এমনটা চাইছেন সুবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নিজাম উদ্দিন। উপাচার্য বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি নির্ধারণসংক্রান্ত কাজ গেল সরকার ও প্রশাসনের আমলে হয়েছে। এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আইনে দেখার হাওর পারের কথা বলা আছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মতান্ত্রিক যে কাজ করার কথা, সেগুলো করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত