Ajker Patrika

টাঙ্গাইলের মধুপুর: ঘুষ ছাড়া হয় না নিবন্ধন

  • মনঃপূত ঘুষ না দিলে সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে জমির দলিল নিবন্ধন ছাড়াই ফিরতে হয়।
  • ৫০ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় নিবন্ধন হয়নি।
  • জেলা রেজিস্ট্রার ও দুদকে অভিযোগ এক ব্যক্তির।
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের মধুপুরে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো দলিল নিবন্ধন হয় না বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মনঃপূত ঘুষ না দিলে জমির দলিল নিবন্ধন ছাড়াই ফিরে আসতে হয় ক্রেতা-বিক্রেতাদের। এ নিয়ে লিখিত অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। গত মঙ্গলবার জেলা রেজিস্ট্রার ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এ বিষয়ে লিখিত দেন আয়েজ উদ্দিন আজাদ নামের এক ব্যক্তি। তাঁর অভিযোগ, ৫০ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় দলিল করা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধুপুর উপজেলা থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সাবরেজিস্ট্রার অফিস। রাজস্ব আদায়ে সহযোগিতা করেন দেড় শতাধিক দলিল লেখক ও ভেন্ডর। দলিলের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করে দলিল সম্পাদন করেন সাবরেজিস্ট্রার। অভিযোগ রয়েছে, মধুপুরের সাবরেজিস্ট্রার অঞ্জনা রানী দেবনাথ যোগদানের পর থেকেই তাঁর অধস্তন কর্মচারী, নকলনবিশ, দলিল লেখক, ভেন্ডররা তাঁর বেঁধে দেওয়া নিয়মেই দলিল নিবন্ধনের কার্যক্রম চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। চলতি বছরের মে মাসে অঞ্জনা রানী দেবনাথ এখানে যোগদান করেন।

বিধি অনুসারে একটি জমির দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে জমি বিক্রেতার স্বত্ব নিশ্চিত করার জন্য পরচা, খাজনা-খারিজ, এনআইডি ও ছবি অত্যাবশ্যকীয়। এসব কাগজপত্র সঠিক থাকলে সরকারি রেজিস্ট্রেশন ফি ১ হাজার ১০০ টাকা ও ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের সাড়ে ৭ ভাগ এবং পৌর এলাকায় সাড়ে ৯ ভাগ হারে কর জমা দিতে হয়। তারপরই একটি দলিল সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হওয়ার কথা। তবে মধুপুরে এই বিধি অনুসরণে নানা ঘোরপ্যাঁচ অবলম্বন করা হয়। ফলে এতে ধাপে ধাপে টাকা (ঘুষ) দিতে হয় বলে অভিযোগ।

জমির ক্রেতা-বিক্রেতা, দলিল লেখক ও ভেন্ডররা বলছেন, এখানে দলিলসহ অন্যান্য কাগজপত্রের ফটোকপি হলে নির্ধারিত ফিসের বাইরে ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা দিতে হয়। একই দাতার একাধিক দলিল হলে, হেবা দলিল, হেবার ঘোষণাপত্র, দানপত্র এবং জমি বিক্রেতার বাবা-মায়ের নামে পরচা হলে ২-৫ হাজার টাকা দিতে হয়। জমি বিক্রেতার দাদা, দাদি, নানা, নানির নামে পরচা থাকলে, নামের সঙ্গে যুক্ত অন্য নাম বা ডাকনাম থাকলে ৫-১০ হাজার টাকা গুনতে হয়। বণ্টননামা দলিল ও রেজিস্ট্রি বায়না এবং আয়কর বা টিন সার্টিফিকেট না থাকলে নির্ধারিত ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। সাবরেজিস্ট্রার অঞ্জনা রানী দেবনাথের এই নিয়ম তিনি যোগদানের পরই চালু করেছেন। তবে তিনি নিজ হাতে কোনো টাকা নেন না। এই টাকা তাঁর হাতে পৌঁছায় দলিল লেখক বা নকলনবিশদের মাধ্যমে। ঘুষের টাকা না দিলে দলিল নিবন্ধন হয় না, এমন অভিযোগও রয়েছে অনেকের।

আয়েজ উদ্দিনের অভিযোগ, ২৮ সেপ্টেম্বর ৫৫ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় এবং তাঁর অপর ৬ অংশীদার জমির দলিল করতে পারেননি। ৮১ বছর বয়স্ক জমি বিক্রেতা আব্দুল মজিদকে নিয়ে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে টানা চার ঘণ্টা অপেক্ষা করে দলিল নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন তাঁরা। পরে তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলা রেজিস্ট্রার ও দুদকে অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

আয়েজ উদ্দিন বলেন, ‘আমিসহ সাতজন অংশীদার মিলে মালাউড়ী গ্রামের আব্দুল মজিদের নিকট থেকে ছয় শতাংশ জমি ক্রয়ের জন্য ৩১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে নগদ ১ লাখ টাকা বায়না করি। আমরা জমি ক্রেতা সাতজন এবং বিক্রেতাসহ তাঁর সন্তানেরা মিলে ২৮ সেপ্টেম্বর রোববার জমির দলিল নিবন্ধন করতে যাই।’

আয়েজ উদ্দিন বলেন, ‘ভেন্ডর আব্দুস সামাদের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় সরকারি ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে সাবরেজিস্ট্রারের কাছে দলিল নিবন্ধনের জন্য কাগজপত্র উপস্থাপন করি। জমি বিক্রেতা বার্ধক্যজনিত কারণে দোতলায় উঠতে পারেননি। তাই সাবরেজিস্ট্রার অঞ্জনা রানী দেবনাথ নিচে হুইল চেয়ারে বসা আব্দুল মজিদের সম্মতি নেওয়ার জন্য নকলনবিশ জসিম উদ্দিনকে পাঠান। জসিম উদ্দিন দলিলদাতা আব্দুল মজিদের সঙ্গে কথা বলেন। কিছুক্ষণ পরে ভেন্ডর মিরাজ আলী ও আব্দুস সামাদের মাধ্যমে আমাদের জানানো হয়, ৫০ হাজার টাকা দিলে দলিল হবে, অন্যথায় নয়। পরে আবার জানানো হয়, জমি ক্রেতাদের মধ্যে একজনের আয়কর সনদ নেই, তাই আরও ৫ হাজার টাকা দিতে হবে। ৫৫ হাজার টাকা দিলে দলিল হবে, অন্যথায় হবে না। পরে চার ঘণ্টা চেষ্টা ও অপেক্ষার পর আমরা জমির দলিল করতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি।’

ভেন্ডর মিরাজ আলী বলেন, ‘জমিদাতা আব্দুল মজিদ বৃদ্ধ মানুষ। ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না। জমি বিক্রিতে তাঁর সম্মতি আছে কি না, বিষয়টি অস্পষ্ট। তাই সাবরেজিস্ট্রার ৫০ হাজার টাকা চাইছেন। বিষয়টি সামাদ ভেন্ডর জমির ক্রেতা আয়েজ উদ্দিন আজাদকে জানিয়েছিলেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁর দলিল নিবন্ধন হয়নি। পরবর্তীকালে ব্যাংকে জমাকৃত ফিসের টাকাও তাঁদের ফেরত দেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে মধুপুর সাবরেজিস্ট্রার অঞ্জনা রানী দেবনাথ বলেন, ‘আমি দলিল গ্রহণে কোনো প্রকার টাকা নিই না। যদি কেউ নিয়ে থাকেন, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’ আয়েজ উদ্দিনের অভিযোগের ব্যাপারে বলেন, ‘জমিদাতা খুবই বৃদ্ধ। আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে তাঁর দলিল সম্পাদন করা সম্ভব হবে।’

টাঙ্গাইল জেলা রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘৫০ হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় দলিল করতে পারেনি, এমন অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত