Ajker Patrika

সাভার পৌরসভা

৭০ শতাংশ কাজ হাতিয়ে নেন মেয়রের ছেলেরা

  • প্রায় সব কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী। চুক্তি অনুযায়ী রড ব্যবহার করা হয়নি। নির্মাণ বা সংস্কারের কয়েক মাসের মধ্যে অনেক সড়ক ও ড্রেন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
  • দুদকের অনুসন্ধানেও শিকদার কনস্ট্রাকশনের কাজে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।
অরূপ রায়, সাভার 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ঢাকার সাভার পৌরসভায় ২০১৬ সাল থেকে ৯ বছরে শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজের ৭০ কোটির কাজই করেছেন সাবেক মেয়রের ছেলেরা। এসব কাজের অধিকাংশই নিম্নমানের হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে বেশির ভাগ কাজের বিলও তুলে নিয়ে গেছেন তাঁরা।

পৌরসভা থেকে জানানো হয়েছে, ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত টানা প্রায় ৯ বছর সাভার পৌরসভার মেয়রের দায়িত্বে ছিলেন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল গনি। এ সময় পৌর এলাকায় ১০১ কোটি টাকার ড্রেন ও সড়ক উন্নয়নের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৬৯ কোটি টাকার কাজ করেছে, যা ওই সময়ের মোট কাজের প্রায় ৭০ শতাংশ।

শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্সের লাইসেন্সে কাজ হলেও মূলত এই বিপুল অঙ্কের টাকার কাজ করেছেন মেয়রের বড় ছেলে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন, মেজ ছেলে কামরুল হাসান শাহীন ও ছোট ছেলে মেহেদী হাসান তুষার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাভার পৌরসভার এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিকদার কনস্ট্রাকশন যেসব কাজ করেছে, তার প্রায় সব কটিতে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী। অধিকাংশ কাজে চুক্তি অনুযায়ী রড ব্যবহার করা হয়নি। এ কারণে নির্মাণ বা সংস্কারের কয়েক মাসের মধ্যে অনেক সড়ক ও ড্রেন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর পরও মেয়র ও তাঁর ছেলেদের কারণে শিকদার কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও শিকদার কনস্ট্রাকশনের কাজে দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে।

তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্সের বিভিন্ন কাজের তথ্য চেয়ে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হয়। আবেদনের পর পৌরসভা থেকে বেশ কিছু তথ্য সরবরাহ করা হয়।

সরবরাহ করা তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ১০১ কোটি টাকার ড্রেন ও সড়কের উন্নয়নকাজ হয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্স ৭০ কোটি ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৫৫৬ টাকার কাজ পেয়েছে। এসব কাজের কোনোটার পুরো এবং কোনোটার আংশিক কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সরবরাহ করা তথ্য অনুযায়ী, শিকদার কনস্ট্রাকশন গত ৯ বছরে ৬৬ কোটি ৯১ লাখ ৯ হাজার ২৩৫ টাকায় ৬৮টি ড্রেন ও সড়কের আংশিক বা পুরো কাজ করে বিলের অধিকাংশই উত্তোলন করে নিয়েছে। মেয়রের ছেলেদের মনোনীত কোনো ব্যক্তি শিকদার কনস্ট্রাকশনের মালিক এ কাদের শিকদারের কাছ থেকে লিখিত ক্ষমতা নিয়ে বিল উত্তোলন করে নেন।

তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একটি প্যাকেজে ৪টি কাজের মধ্যে একটি ড্রেন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ওই প্যাকেজের কোনো কাজের বিল দেওয়া হয়নি। আর বাকি ৫টি কাজের আদেশ দেওয়া হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ নগরকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (আইইউআইডিপি) আওতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১ কোটি ৮৩ লাখ ৭০ হাজার টাকায় রেডিওকলোনি এলাকায় ৩৩৭ মিটার আরসিসি ড্রেন, রাজাসন এলাকায় সড়কসহ ১১০ মিটার আরসিসি ড্রেন এবং গেণ্ডা এলাকায় ১৭৬ মিটার আরসিসি ড্রেন নির্মাণের কাজ পায় শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্স।

কার্যাদেশের পর ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। কাজ শুরুর পাঁচ মাস পর গত ৭ এপ্রিল দুদকের অনুসন্ধানে রেডিওকলোনিতে ৩৩৭ মিটার ড্রেন নির্মাণে বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পড়ে। ড্রেনটিতে রডের দুটি জালি ব্যবহার করার কথা থাকলেও একটি জালি ব্যবহার করেই প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করা হয়।

টানা পাঁচ মাস এই অনিয়ম চলে এলেও কাজের দেখভালের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী ও কার্যসহকারী কোনো ব্যবস্থা নেননি।

দুদকের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আরিফ আহম্মেদ বলেন, ‘ড্রেন নির্মাণের কাজে পুরোটাই অনিয়ম হয়েছে। যার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই প্যাকেজে বাকি তিনটি কাজেও অনিয়ম হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে ওইসব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় তা খতিয়ে দেখা যায়নি।’

জানতে চাইলে রেডিওকলোনির ৩৭৭ মিটার ড্রেন নির্মাণকাজের দেখভালের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী বাপ্পী শাহরিয়ার বলেন, ‘আমাকে একসঙ্গে অনেক কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়। যে কারণে একার পক্ষে সব কাজের তদারকি করা সম্ভব হয় না। এভাবেই হয়তোবা ড্রেন নির্মাণের কাজে অনিয়মের বিষয়টি আমার নজর এড়িয়ে গেছে।’

শুধু ড্রেন নির্মাণে নয়, অনেক কাজে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্সের বিরুদ্ধে। কিন্তু মেয়র আর তাঁর ছেলেদের প্রভাবে পৌরসভার প্রকৌশল বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

আরসিসিস ঢালাই ও ঢালাইয়ের দুপাশে ইউনিব্লক দিয়ে পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া গুদারাঘাট থেকে কালভার্ট হয়ে শুকুরজান স্কুল পর্যন্ত ৩১০ মিটার সড়কের উন্নয়ন করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাজটি করে মেসার্স শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্স।

সম্প্রতি ওই সড়কে গিয়ে দেখা যায়, কালভার্টের পূর্ব পাশে সড়কের বেশ কিছু অংশ দেবে গেছে। অনেক জায়গায় ইউনিব্লক উঠে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে আত্মগোপনে থাকা এক নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রমজান আহম্মেদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের পাশাপাশি চুক্তি অনুযায়ী রড না দেওয়ায় কাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে তা দেবে যায়।’

রমজান আহম্মেদ আরও বলেন, ‘শিকদার কনস্ট্রাকশন আমার ওয়ার্ডে যেসব ড্রেন ও সড়কের কাজ করেছে, সবই নিম্নমানের কাজ হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেক সড়কের বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। ড্রেনের স্লাব ও ম্যানহোলের ঢাকনা ভেঙে গেছে।’

যোগাযোগ করা হলে মেসার্স শিকদার কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড বিল্ডার্সের মালিক এ কাদের শিকদার বলেন, ‘মেয়র আবদুল গনির ছেলেরা আমার লাইসেন্সে কৌশলে সব কাজ হাতিয়ে নিতেন। আর নিম্নমানের কাজ করে এবং কাজে অনিয়ম করেও বাবার সুবাদে বিল পেয়ে যেতেন। এখন সেসবের খেসারত দিতে হচ্ছে আমাকে।’

হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলে মেয়র আবদুল গনির বড় ছেলে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন বলেন, ‘আমার দুই ভাই ও আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা সত্য নয়। আমি ঠিকাদারি করেছি গণপূর্ত অধিদপ্তরে। আর আমার ভাইয়েরা অন্য পেশায় জড়িত ছিলেন।’

তবে সাভার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘শিকদার কনস্ট্রাকশনের লাইসেন্সে যত কাজ হয়েছে সব কাজ করেছেন সাবেক মেয়র আবদুল গনির ছেলেরা। যে কারণে কাজে অনিয়ম হয়ে থাকলেও বলার কিছু ছিল না।’

কাজে অনিয়ম এবং শিকদার কনস্ট্রাকশনের নামে ৭০ কোটি টাকার কাজের প্রসঙ্গে সাভারের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সাভার পৌরসভার প্রশাসক মো. আবুবকর সরকার বলেন, ‘আমি পৌরসভার দায়িত্ব পাওয়ার আগে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই। কার লাইসেন্সে কে কাজ করেছেন, তাও আমি জানি না। তবে দুদক যে কাজে অনিয়ম পেয়েছে, তা আমার নজরে এসেছে। বিষয়টি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের মহাপরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি বাসভবনে একাই থাকতেন শরীয়তপুরের ডিসি, পরিবার থাকত ঢাকায়

স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে ফাঁস দিলেন স্ত্রী

‘তোরা তো পুলিশ মারছিস, ফাঁড়ি জ্বালাইছিস’ বলেই জুলাই যোদ্ধাকে মারধর

ইরানে ভূমিকম্প নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জল্পনা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বুশেহরে হামলা হলে মধ্যপ্রাচ্যে ‘ফুকুশিমা’ ঘটতে পারে, বিশ্লেষকদের হুঁশিয়ারি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত