Ajker Patrika

জনসচেতনতা সৃষ্টিই ক্ষতি কমানোর প্রধান উপায়

  • এক সপ্তাহে ৭ ভূমিকম্পে জনমনে উদ্বেগ
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আতঙ্ক নয়, সচেতন হওয়াতেই সমাধান
  • নির্মাণে নিরাপত্তা ও নজরদারির পরামর্শ
সৈয়দ ঋয়াদ, ঢাকা 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাসহ দেশজুড়ে অনুভূত ২১ নভেম্বরের প্রবল ভূমিকম্পের জের মানুষের মন থেকে কাটেনি। ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর এক সপ্তাহে আরও সাতবার কিছুটা কম মাত্রার ভূমিকম্প বা পরাঘাতে কেঁপেছে দেশ। এই অবস্থায় লাখ লাখ বহুতল ভবনসহ অসংখ্য পাকা বাড়িতে ঠাসা রাজধানীজুড়েই উদ্বেগ রয়ে গেছে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধিবিধান মানা এবং এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সক্রিয় নজরদারি কম থাকা উদ্বেগের বড় কারণ। বড় ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকদের প্রস্তুতি কতটা, সেই প্রশ্নও অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা বলছেন, রাজধানীতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। শতাব্দীর বেশি সময় এই অঞ্চলে খুব বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হওয়ায় ভূগর্ভে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংযোগস্থলে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয়েছে। এ কারণে এখানে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু আগে-পরে তা ঘটবেই। তবে তা কবে হবে, আগেই বলা সম্ভব নয়। এ কারণে ভবন নির্মাণ ও সংস্কারে সতর্কতা এবং ভূমিকম্প ঘটলে করণীয় বিষয়ে সচেতনতার দিকে নজর দেওয়াই সবচেয়ে জরুরি কাজ। এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

গত ১০ বছরে রাজউক, বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানীর নদী-তীরবর্তী বা নিচু জলাভূমি ভরাট করে তৈরি করা এলাকাগুলো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব স্থানে ভবন নির্মাণে বাড়তি সতর্কতার কথা বলা হয়েছে। তবে রাজধানীর আরও অনেক এলাকার মতো নিচু জমি ভরাট করে নির্মিত ভবনগুলোরও বেশির ভাগ তৈরি হয়েছে যথাযথভাবে নিয়ম না মেনে। খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নিজেদের সমীক্ষার বরাত দিয়ে বলেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে (চ্যুতি) ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে।

বুয়েটসহ বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকার অর্ধেকের বেশি ভবনের বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছর। নিচু জমিতে বালু ফেলে অসংখ্য বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে।

ফায়ার সার্ভিসের প্রস্তুতি

ভূমিকম্পের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির পরিচালক (প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল এম এ আজাদ আনোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের মাত্রার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। আমাদের যথেষ্ট দক্ষ জনবল রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন যন্ত্রপাতির কথা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ৭ বা ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৪ থেকে ৬ লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। এই অবস্থায় শুধু যন্ত্রপাতির সংখ্যার বিষয়টি আর বিবেচ্য হবে না; তখন এটি আর সক্ষমতার মধ্যে থাকবে না। ভয়াবহ ভূমিকম্পে আধুনিক প্রযুক্তিও কখনো কখনো অপর্যাপ্ত হয়ে পড়ে।’

আজাদ আনোয়ার আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে, কিছু জায়গায় ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতেও পারবে না। আর ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ কিছু হবে না। এই ধরনের দুর্যোগে পুরো জাতিকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ প্রয়োজন হবে।’

গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার ৫০ শতাংশ ভবন নির্মিত হয়েছে মাটির সঠিক গুণগত মান পরীক্ষা ছাড়াই। নকশা অনুযায়ী রড বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয়নি ৪০ শতাংশ ভবনে। আর ২৫ শতাংশ বাণিজ্যিক ভবনে অনুমোদিত নকশা পরে পরিবর্তন করা হয়েছে। এই বাস্তবতায় প্রকৌশলী ও স্থপতিরা ঢাকায় ভবন নির্মাণের বিষয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ভূমিকম্প বিশারদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহর দিনের পর দিন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এখন হঠাৎ রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো কিছু পরিবর্তন করা যাবে না। তবে জনগণকে সচেতন করা, এই বিষয়ে গণমাধ্যমে বেশি বেশি প্রচার করা, বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। তাহলে ক্ষতি কমানো সম্ভব।’

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভবনের কলামে ৩ মিলিমিটারের বেশি চওড়া ফাটল, বিমে তির্যক ফাটল এবং বেসমেন্ট, ছাদ বা লিফটের শ্যাফটে দীর্ঘ ফাটল থাকলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

পুরান ঢাকার চকবাজারের এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর দরজা আটকে যায়। দেয়ালেও ফাটল। কিন্তু এখান থেকে বের হয়ে যাব কোথায়? নিরাপদ বাসা কোথায় পাব? নিশ্চয়তা কী?’

আতঙ্কিত হওয়া যাবে না

আমাদের দেশে সাধারণত ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত শুক্রবারের ভূমিকম্পটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেওয়ায় তা আতঙ্কিত করেছে সবাইকে। তবে এ বিষয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক আয়শা আক্তার বলেন, ‘ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না; বিশেষ করে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা ট্রমাটাইজড হয়ে পড়ে। এতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। ভূমিকম্পের সময় সবাইকে ভবনের নিরাপদ স্থানে থাকার চেষ্টা করতে হবে। ফায়ার সার্ভিসসহ কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মানতে হবে।’

বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

পরিস্থিতি মোকাবিলায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ভবনের তালিকা প্রকাশ, সরকারি-বেসরকারি জরুরি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট গঠন, ফল্টলাইনভিত্তিক রিস্ক জোন চিহ্নিত করা, পুরান ঢাকা ও মিরপুরে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা সমীক্ষা, ভবন সংস্কারে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বা তহবিল ও জনগণকে ফাটল-নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য নগর ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার ভবনগুলোর ৯৪ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে অবৈধ ও অনুমোদনহীন। একটি নীতিমালার মধ্য দিয়ে প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করে সেগুলো নিরাপদ করার একটি সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় সেটি বাস্তবায়ন করছে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাজধানীতে অপরাধ: ১৪ ভাগ করে মিরপুর নিয়ন্ত্রণ করছে চার শীর্ষ সন্ত্রাসী

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক আটক

উত্তরায় জুলাই রেভেলসের দুই সদস্যকে কুপিয়ে জখম

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে: তিন দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা

আজকের রাশিফল: প্রাক্তন ফোন করবে ও পুরোনো পাওনা টাকার কথা স্মরণ হবে, তবে পরিণতি একই

এলাকার খবর
Loading...