Ajker Patrika

শচীন দেববর্মনের জন্মভিটায় জাদুঘর

ফিরবে কুমিল্লার সুরের স্মৃতি

  • একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর, মুক্তমঞ্চ, গবেষণাকক্ষ ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা।
  • গত শনিবার জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা সেরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে জন্মভিটা পরিদর্শন।
  • শচীনের জন্মভিটা একসময় ছিল প্রায় ৬০ একর জমির ওপর বিস্তৃত প্রাসাদ।
  • প্রতিবছর শচীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জন্মভিটায় মেলার আয়োজন করা হয়।
দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ, কুমিল্লা 
কুমিল্লার চর্থায় অবস্থিত শচীন দেববর্মনের ভিটেবাড়ি গত শনিবার পরিদর্শন করে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় দলটির সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
কুমিল্লার চর্থায় অবস্থিত শচীন দেববর্মনের ভিটেবাড়ি গত শনিবার পরিদর্শন করে জাতীয় জাদুঘরের একটি প্রতিনিধিদল। এ সময় দলটির সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

কুমিল্লা নগরীর চর্থা এলাকার যে ঐতিহাসিক প্রাসাদ একসময় রাজপরিবারের গৌরবময় স্মৃতি বহন করত, আজ তা অবহেলা আর ভগ্নদশার চিহ্ন বহন করছে। তবে পরিস্থিতি বদলাতে যাচ্ছে শিগগির। সংস্কারের মাধ্যমে এই প্রাসাদ গড়ে তোলা হবে শিল্প ও সংগীতচর্চার এক অনন্য কেন্দ্র হিসেবে। বাংলার ভাটিয়ালি থেকে হিন্দি চলচ্চিত্রের কালজয়ী সুর পর্যন্ত তাঁর জীবন ও সৃষ্টিশীলতার পূর্ণাঙ্গ প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হবে এই কেন্দ্রে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের আশা, এর ফলে কুমিল্লা আবারও সংগীত ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকেরাও শচীন দেববর্মন সম্পর্কে জানতে পারবেন।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এরই মধ্যে গঠন করেছে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল। গত শনিবার জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা মো. সেরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে দলটি শচীনের জন্মভিটা পরিদর্শন করে। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা।

১৯০৫ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন শচীন দেববর্মন। তাঁর পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মন ছিলেন ত্রিপুরা রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরিবার কুমিল্লায় চলে আসে এবং এখানেই শচীনের শৈশব কাটে। গোমতী নদীর ধারে মাঝিদের ভাটিয়ালি, গ্রামীণ লোকগান এবং বেদেদের সুরে শচীনের অন্তরে জন্ম নিল সেই সুরের বীজ, যা পরবর্তীকালে বাংলার ও হিন্দি চলচ্চিত্রের ক্যানভাসে রং ছড়িয়ে দেয়। ছোটবেলা থেকেই কুমিল্লার প্রকৃতি, নদীর ঢেউ, বাজারের মানুষের কথ্যসংগীত—সবকিছু শচীনের সংগীতজীবনের অনন্য শিক্ষালয়। শিক্ষাজীবনে তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গান গেয়ে পরিচিতি পান। ১৯৩০ সালে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে অংশ নিয়ে তাঁর সরল অথচ হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠ সবার নজর কাড়ে। কলকাতা বেতার থেকে শুরু করে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে সংগীত পরিচালকের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়া—শচীনের সংগীতভ্রমণ ছিল এক বিস্ময়কর অধ্যায়।

শচীনের সুরে গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, গীতা দত্তের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা। অন্যদিকে নিজস্ব ভাটিয়ালি ছোঁয়া কণ্ঠে তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গান, যা আজও শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাঁর ছেলে আরডি বর্মনও পরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগীতজগতে নতুন মাত্রা যোগ করেন।

নজরুল ইসলামের গানও সুর করেছেন শচীন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী মীরা দেববর্মনও ছিলেন তাঁর সংগীতচর্চার সাথী।

শচীনের জন্মভিটে একসময় ছিল প্রায় ৬০ একর জমির ওপর বিস্তৃত প্রাসাদ। পাকিস্তান আমলে এর একটি অংশ সরকারি খামার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পরও ভিটেবাড়ি দখল, অবহেলা ও ধ্বংসের শিকার হয়। রাজবাড়ির অনেক অংশ ভেঙে যায়, স্মৃতিচিহ্ন মুছে যেতে থাকে।

১৯৯০-এর দশক থেকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক মহল সংরক্ষণের দাবি তোলে। বারবার স্মারকলিপি ও প্রশাসনিক অনুরোধের পর ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসন জায়গার একটি অংশ উদ্ধার করে। আংশিক সংস্কার করা হলেও পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও জাদুঘরে রূপায়ণ শুরু হয়নি। ২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় শিল্পীরা ‘শচীন মেলা’ আয়োজন করে তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ভিটেবাড়ির ভেতরে শচীনের একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়।

শচীনের ভিটেবাড়ি পরিদর্শনের পর সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীতশিল্পী শচীন দেববর্মন এবং নবীনগরের শাস্ত্রীয় সংগীতের আচার্য সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পৈতৃক বাড়ি দুটি পরিদর্শন করেছি এবং এখানে জাদুঘর করার পর্যাপ্ত যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করি। বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়কে জানাব। আশা করি, শিগগির এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে এবং দুটি ঐতিহাসিক ভিটেবাড়ি দেশের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।’

ঐতিহ্য কুমিল্লার সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বলেন, ২০১২ সাল থেকে শচীন দেববর্মনের ভিটেবাড়ি সংরক্ষণের জন্য ঐতিহ্য কুমিল্লাসহ সাংস্কৃতিক কর্মীরা ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছেন। সেই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পর্যায়ে বাড়িটি উদ্ধার করা হয়েছে এবং প্রতিবছর শচীনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়। এখানে জাদুঘর স্থাপন করা হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা শচীন দেববর্মন সম্পর্কে জানতে পারবেন।

জাতীয় জাদুঘরের প্রতিনিধিদল জানায়, ভিটেবাড়িতে একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে থাকবে শচীনের জীবন ও কর্মের দলিলচিত্র, সংগীত আর্কাইভ ও গবেষণাকক্ষ, মুক্তমঞ্চ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানস্থল এবং সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

দাওয়াত না দেওয়ায় মাদ্রাসার সব খাবার খেয়ে গেলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা

উত্তাল ভাঙ্গা: থানাসহ চারটি সরকারি দপ্তরে হামলা-ভাঙচুর, পুলিশসহ আহত অনেকে

সন্তানের গলা কেটে লাশ বাবার হাতে তুলে দিলেন মা

কক্সবাজার, মাদারীপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত