Ajker Patrika

রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজ

চাকরির ফাঁদে কোটি টাকার প্রতারণা

আব্দুল বাশির, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
মোহা. মনিরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
মোহা. মনিরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহা. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনিক অরাজকতা এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ভর্তি, পরীক্ষা, সার্টিফিকেট ইস্যু থেকে শুরু করে টেন্ডার, নির্মাণ ও অর্থের ব্যবহার—প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন তাঁরই সাবেক অফিস সহায়ক আব্দুস সাত্তার।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি নিয়মিত কলেজে উপস্থিত হচ্ছেন না। এতে কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে ভেঙে পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করেছেন। ২০১৪ সালে অধ্যক্ষ পদ গ্রহণের পর থেকে মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। এসবের মধ্যে রাজশাহীতে জমি কিনে তিনটি বাড়ি নির্মাণ, গ্রামের বাড়ি দোতলা করা, পরিবার সদস্যদের নামে লাখ লাখ টাকার ডিপিএস—সবই করেছেন কলেজের অর্থ থেকে।

পরীক্ষা, টেন্ডার ও ভর্তির টাকা আত্মসাৎ

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, কলেজে প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এতে ভর্তি বাবদ আয় হয় প্রায় ৩৮ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে শিক্ষার্থী ভর্তি বাবদ আয় হয় ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। আর খরচ দেখানো হয় মাত্র ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাকি ২৩ লাখ টাকার বেশি অর্থ ভুয়া বিল ও ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়।

এদিকে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে উন্মুক্ত পরীক্ষায় প্রক্সির সুযোগ করে দিতেন অধ্যক্ষ। এ ছাড়া পরীক্ষায় প্রশ্ন সহজ করার নামে শিক্ষার্থীপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা নেওয়াসহ ভর্তি বাতিল, অন্য কলেজে স্থানান্তর, মৌখিক পরীক্ষা, সার্টিফিকেট ইস্যু এবং হাজিরার ঘাটতি পূরণের জন্যও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া টেন্ডার ছাড়াই বিভিন্ন নির্মাণকাজ, জমি লিজ, দোকানঘর, ক্যানটিন ও ভাস্কর্য নির্মাণেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

চাকরির নামে কোটি টাকার প্রতারণা

শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এই অধ্যক্ষ। সাবেক অফিস সহায়ক আব্দুস সাত্তার জানান, নয়জনের কাছ থেকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। পরে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিলেও ভুক্তভোগীরা এখনো তা পাননি। এ ছাড়া শিক্ষকদের জাতীয়করণের কথা বলে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। কিছু সুবিধাবাদী শিক্ষক এই কাজে সহযোগিতা করেছেন।

এদিকে ৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অধ্যক্ষ ও সাবেক অফিস সহায়ক আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে বসে তদন্তের জন্য ৯ সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করেন। বোর্ডের ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করার কথা। প্রতিবেদনে টাকা নেওয়ার প্রমাণ মিললে ১৮ লাখ টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়।

জানতে চাইলে ফিশ সহায়ক পদে চাকরিরত মিজানুর রহমান বলেন, ‘অফিস সহায়ক পদে চাকরি দেবে বলে অধ্যক্ষের নাম করে আব্দুস সাত্তার আমার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়েছিল। আমি চার বছর কলেজের পদার্থ ও ভূগোল বিভাগে চাকরি করেছি। হঠাৎ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অধ্যক্ষ স্যার আমাকে কলেজে আসতে নিষেধ করেছেন। তারপর থেকে আমি আর কলেজে যাচ্ছি না।’

একই পদের আরেক চাকরিপ্রত্যাশী হিমেল বাবু বলেন, ‘আমার থেকে আব্দুস সাত্তার দুবার ৯০ হাজার করে মোট ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অধ্যক্ষ আমাকে চাকরি দেয়নি। কয়েকবার অধ্যক্ষের কাছে টাকার জন্য গেছি। কিন্তু টাকাও দিচ্ছে না, চাকরিও দিচ্ছে না।’

চৌডালা জোহুর আহম্মেদ মিঞা কলেজের প্রভাষক শাহরিয়ার কামাল বলেন, ‘রহনপুর ইউসুফ আলী সরকারি কলেজে নিয়োগ হওয়ার জন্য সেখানকার কমিটির মাধ্যমে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু অধ্যক্ষ আমার কাগজ মাউশিতে পাঠায়নি। যে কারণে সেখানে আমার নিয়োগটা হয়নি। তারপর থেকে আমার টাকা ফেরত চাচ্ছি, কিন্তু দিচ্ছে না। আমার মতো বহু শিক্ষককে নিয়োগের কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ মোহা. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হয়েছে। অধিদপ্তরের লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি তাদের সরেজমিনে তদন্ত করতে বলেছি।’

অপর প্রশ্নের উত্তরে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে টাকা সরানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সকল কিছু পরিপত্র অনুযায়ী হয়। আর টাকা কলেজের অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়। অভ্যুত্থানের পর থেকে অসুস্থতা ও নানা ঝুট-ঝামেলার কারণে নিয়মিত কলেজ করতে সমস্যা হচ্ছে।’ ওমরাহ হজ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আ. ন. ম. মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, ‘কলেজ অধ্যক্ষের অনিয়ম-দুনীতির বিষয়গুলো মাউশি দেখে। আমাদের দপ্তরের যেটা করণীয় আছে, আমরা সেটা অবশ্যই অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে করব।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সরকারি কলেজ শাখা-১-এর উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম সিকদার বলেন, ‘অধ্যক্ষ মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। সেগুলো নিয়ে কাজ চলছে। তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত