আজকের পত্রিকা ডেস্ক
নেপালে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। আপাতদৃষ্টিতে এটি নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে হলেও এটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত উদ্বেগের বিষয়। এটি নয়াদিল্লির জন্য সতর্কসংকেত।
জেন–জিদের নেতৃত্বে সংঘটিত এই আন্দোলনকে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ হিসেবে তুলে ধরা হলেও প্রকৃত ঘটনা তা নয়। এটি ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। দশকের পর দশক ধরে নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গন কয়েকজন মাত্র নেতার দখলে থেকেছে। তাঁরা ক্ষমতার খেলায় বারবার ফিরে এসেছেন, কিন্তু বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো মূল সমস্যাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই বিক্ষোভের সূচনা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে। এরপর তা আরও উসকে দেয় এক দুর্ঘটনা। এক মন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় ১১ বছরের এক স্কুলছাত্রী মারা যায়। তবে এই আন্দোলনের শিকড় নিহিত দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সর্বব্যাপী দুর্নীতি আর তরুণদের গভীর হতাশার মধ্যে।
নেপালে তরুণ বেকারত্বের হার অত্যন্ত বেশি, মাথাপিছু জিডিপি কম। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ কাজের খোঁজে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, এ বিক্ষোভে বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। পরে সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে এবং আলোচনার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। এতে প্রশ্ন ওঠে, প্রেসিডেন্টের ভূমিকা আসলে কী?
এ ধরনের অরাজকতা ভারতের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়ও এমন অস্থিরতা দেখা গেছে। ভারতের জন্য বিষয়টি স্পষ্ট—পুরোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব—যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির সম্পর্ক ছিল, তারা আর আগের মতো প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। তরুণ প্রজন্ম চাচ্ছে, নতুন নেতৃত্ব, যারা অতীতের বোঝা বহন করবে না। তারা বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলছে, কারণ সংসদ সদস্যদের তারা অযোগ্য ও অবিশ্বস্ত বলে মনে করছে। ভারতকে স্বীকার করতে হবে—নেপালে এক নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের উত্থান ঘটেছে এবং দিল্লির প্রচলিত প্রভাবের হাতিয়ারগুলো হয়তো আর তেমন কার্যকর থাকছে না।
কিন্তু আমরা কি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকতে পারি? নেপালের অস্থিতিশীলতা ভারতের স্বার্থের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কতগুলো বড় হুমকি তৈরি করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তা। নেপালের সঙ্গে ভারতের উন্মুক্ত সীমান্ত যেমন আশীর্বাদ, তেমনি অভিশাপও। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা আর আইনশৃঙ্খলার ভেঙে পড়া সীমান্তপথে চোরাচালান, মানব পাচার এবং ভারতবিরোধী শক্তির কার্যক্রম বাড়িয়ে দিতে পারে।
নেপালে সম্ভাব্য নিরাপত্তাশূন্যতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মতো শত্রুশক্তি ভারতে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। এ কারণেই ভারত সরকার কিছুদিনের জন্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে পরে সীমান্ত আবার খুলে দেওয়া হয় এবং এখন বাণিজ্য ও যাতায়াত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা কড়াকড়ি রাখা হয়েছে। সীমান্তের সংবেদনশীল অংশে পরিচয় যাচাই থেকে শুরু করে ড্রোন নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও উদ্বেগের বিষয়। নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের প্রভাব কমতে থাকায় সেখানে চীনের প্রভাব দ্রুত বাড়ছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও নানা অবকাঠামো প্রকল্পের—যেমন সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ—মাধ্যমে বেইজিং নেপালে সক্রিয়ভাবে জড়িত। একই সময়ে এটা স্পষ্ট যে নেপালের তরুণ বিদ্রোহীরা তাঁদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘ভারতের প্রভাব’ বা ‘চীনের প্রভাব’ রয়েছে—এমন ধারণা নিয়েও যথেষ্ট সতর্ক।
ভারতীয় কিছু মহল, বিশেষ করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ‘সেইম টুলকিট’ তত্ত্বকে সামনে এনেছে। তাদের দাবি, যুব নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া শাসন পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর ‘অস্বাভাবিক মিল’ রয়েছে। তাই তাদের আশঙ্কা, এর পেছনে হয়তো কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনা কাজ করছে, যার উদ্দেশ্য গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করা—অর্থাৎ, পশ্চিমা শক্তিগুলোর কোনো সাজানো খেলা।
আমি সাধারণত এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে সন্দিহান থাকি। বাস্তব পৃথিবী অনেক সময়ই এলোমেলো ঘটনাবলির প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তবে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকেরা এদিকটা ভাবেন না। তবু ভারতকে অবশ্যই এ ধরনের আশঙ্কাকে মাথায় রাখতে হবে এবং ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তবু সুশীলা কার্কিকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের সাজানো কোনো ‘কালার রেভল্যুশন’ তত্ত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। ৭৩ বছর বয়সী কার্কির স্বদেশি নেপালি প্রতিরোধ আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাজতন্ত্র উৎখাতে তিনি অংশ নিয়েছেন, লড়েছেন সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
কার্কি পড়াশোনা করেছেন ভারতের বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারত নিয়ে তিনি প্রায়ই স্মৃতিচারণ করেন। ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ আমাদের আশ্বস্ত করার মতো বিষয়। বিচার বিভাগের ভেতর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন অবস্থান, সঙ্গে তাঁর স্বামীর তৎকালীন রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা (১৯৭৩ সালের বিখ্যাত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার নায়ক তিনি)—এগুলো ব্যাখ্যা করে—কেন তাঁকে বেছে নেওয়া হলো। আরও বড় কথা, বিক্ষোভকারীরা গেমিং চ্যাট অ্যাপ ‘ডিসকোর্ড’ ব্যবহার করে তাঁকে বেছে নিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, আন্দোলনটি কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও বিশৃঙ্খল—যা কোনো সুচারুভাবে সাজানো অভ্যুত্থানের ধারণার সঙ্গে মেলে না।
তবে স্বল্প মেয়াদে নেপালে ভারতের ‘বিশেষ ভূমিকা’ প্রভাবিত হতে পারে। এই অস্থিরতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় প্রকল্প, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ খাত থমকে যেতে পারে বা ব্যাহত হতে পারে। অরুণ-৩ ও ফুকোত কর্ণালি প্রকল্প ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার ভারতের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে দেরি হলে তা হবে বড় ধরনের ধাক্কা। আন্দোলনের সময় প্রায় ৩৩ হাজার বন্দী জেল থেকে পালিয়ে গেছেন। যাঁদের মধ্যে খুন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও রয়েছেন। অনেকেই এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কারও কারও হাতে লুট করা অস্ত্র রয়েছে। এই অবস্থায় সমাজের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি হয়েছে।
এই অবস্থায় ভারত কী করতে পারে? নয়াদিল্লির হাতে সীমিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ খোলা রয়েছে। একদিকে সার্বভৌম প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সম্মান প্রদর্শনের জন্য হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ জরুরি। অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় সূক্ষ্ম অথচ সক্রিয় কৌশলও নিতে হবে।
অবশ্যই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলা জরুরি। নেপালের রাজনীতিতে ভারতের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের প্রবণতা প্রতিহত করতে হবে। অতীতে ২০১৫ সালের অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত অবরোধের মতো কূটনৈতিক চাপ উল্টো ফল দিয়েছে। এতে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়েছে এবং দেশটি চীনের দিকে ঝুঁকেছে। এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে নেপালের রাজনীতির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না করে দূরত্ব বজায় রাখা।
একই সময়ে নেপালের উন্নয়ন এবং ভারতের ‘সফট পাওয়ার’–এর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে আমাদের আরও বেশি করে উন্নয়ন সহায়তা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। চলমান প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা, সাধারণ নেপালি জনগণের উপকারে আসবে—এমন নতুন উদ্যোগ নেওয়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানো—এসব পদক্ষেপ নেপালে ভারতের প্রতি শুভেচ্ছা বাড়াবে এবং সম্পর্ক মজবুত করবে।
নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোও দরকার। নেপালের উঠতি রাজনৈতিক নেতা ও তরুণ কর্মীদের সঙ্গে নয়াদিল্লিকে নতুন যোগাযোগের পথ খুলতে হবে। তাঁদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভ বোঝা ছাড়া ভবিষ্যৎমুখী পররাষ্ট্রনীতি তৈরি সম্ভব নয়। এই নতুন প্রজন্মকে উপেক্ষা করা বড় ভুল হবে। তবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করাও বাদ দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় সহিংসতার প্রভাব ভারতে ছড়িয়ে পড়া বা অবাঞ্ছিত উপাদান ঢুকে পড়া ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
নেপাল এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারতের জন্য এটা ‘ওরা ওদের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা নয়। নয়াদিল্লিকে বুঝতে হবে, এই গণ-অসন্তোষ কত গভীর ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি ও সূক্ষ্ম কৌশল নিতে হবে—যেখানে পারস্পরিক সম্মান, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা গুরুত্ব পাবে আর নেপালের রাজনৈতিক সমাধান নেপালিদের হাতেই থাকবে।
নতুন সরকারকে এখন নির্বাচন প্রস্তুতি, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, যুবকদের বেকারত্ব কমানো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এরপর কী আসবে, তা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও নির্ধারণ করার দায়িত্ব ভারতের নয়।
নেপাল আমাদের কাছে কেবল প্রতিবেশী নয়, বরং ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ—যার সঙ্গে সংস্কৃতি, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। তাই একদিকে হস্তক্ষেপ না করা, অন্যদিকে উদাসীনও না থাকা—এই ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে। নেপালে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে নতুন সরকারকে আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়াই হবে ভারতের মূল ভূমিকা। স্বীকার করতে হবে, সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের কূটনীতিকদের জন্য সহজ কাজ নয়। কিন্তু ঠিক এই কাজের জন্যই তো আমরা তাঁদের বেতন দিই—নাকি!
এনডিটিভি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
নেপালে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। আপাতদৃষ্টিতে এটি নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে হলেও এটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত উদ্বেগের বিষয়। এটি নয়াদিল্লির জন্য সতর্কসংকেত।
জেন–জিদের নেতৃত্বে সংঘটিত এই আন্দোলনকে সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ হিসেবে তুলে ধরা হলেও প্রকৃত ঘটনা তা নয়। এটি ছিল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। দশকের পর দশক ধরে নেপালের রাজনৈতিক অঙ্গন কয়েকজন মাত্র নেতার দখলে থেকেছে। তাঁরা ক্ষমতার খেলায় বারবার ফিরে এসেছেন, কিন্তু বেকারত্ব আর অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো মূল সমস্যাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এই বিক্ষোভের সূচনা হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে। এরপর তা আরও উসকে দেয় এক দুর্ঘটনা। এক মন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় ১১ বছরের এক স্কুলছাত্রী মারা যায়। তবে এই আন্দোলনের শিকড় নিহিত দুর্বল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সর্বব্যাপী দুর্নীতি আর তরুণদের গভীর হতাশার মধ্যে।
নেপালে তরুণ বেকারত্বের হার অত্যন্ত বেশি, মাথাপিছু জিডিপি কম। ফলে বিপুলসংখ্যক তরুণ কাজের খোঁজে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। এতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, এ বিক্ষোভে বাইরের লোকজন ঢুকে পড়ে সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। পরে সেনাবাহিনী কারফিউ জারি করে এবং আলোচনার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। এতে প্রশ্ন ওঠে, প্রেসিডেন্টের ভূমিকা আসলে কী?
এ ধরনের অরাজকতা ভারতের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়ও এমন অস্থিরতা দেখা গেছে। ভারতের জন্য বিষয়টি স্পষ্ট—পুরোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব—যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির সম্পর্ক ছিল, তারা আর আগের মতো প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পারছে না। তরুণ প্রজন্ম চাচ্ছে, নতুন নেতৃত্ব, যারা অতীতের বোঝা বহন করবে না। তারা বর্তমান সংসদ ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলছে, কারণ সংসদ সদস্যদের তারা অযোগ্য ও অবিশ্বস্ত বলে মনে করছে। ভারতকে স্বীকার করতে হবে—নেপালে এক নতুন রাজনৈতিক প্রজন্মের উত্থান ঘটেছে এবং দিল্লির প্রচলিত প্রভাবের হাতিয়ারগুলো হয়তো আর তেমন কার্যকর থাকছে না।
কিন্তু আমরা কি এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে থাকতে পারি? নেপালের অস্থিতিশীলতা ভারতের স্বার্থের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কতগুলো বড় হুমকি তৈরি করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপত্তা। নেপালের সঙ্গে ভারতের উন্মুক্ত সীমান্ত যেমন আশীর্বাদ, তেমনি অভিশাপও। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা আর আইনশৃঙ্খলার ভেঙে পড়া সীমান্তপথে চোরাচালান, মানব পাচার এবং ভারতবিরোধী শক্তির কার্যক্রম বাড়িয়ে দিতে পারে।
নেপালে সম্ভাব্য নিরাপত্তাশূন্যতার সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মতো শত্রুশক্তি ভারতে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। এ কারণেই ভারত সরকার কিছুদিনের জন্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে পরে সীমান্ত আবার খুলে দেওয়া হয় এবং এখন বাণিজ্য ও যাতায়াত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। তা সত্ত্বেও নিরাপত্তা কড়াকড়ি রাখা হয়েছে। সীমান্তের সংবেদনশীল অংশে পরিচয় যাচাই থেকে শুরু করে ড্রোন নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবও উদ্বেগের বিষয়। নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ভারতের প্রভাব কমতে থাকায় সেখানে চীনের প্রভাব দ্রুত বাড়ছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ও নানা অবকাঠামো প্রকল্পের—যেমন সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ—মাধ্যমে বেইজিং নেপালে সক্রিয়ভাবে জড়িত। একই সময়ে এটা স্পষ্ট যে নেপালের তরুণ বিদ্রোহীরা তাঁদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘ভারতের প্রভাব’ বা ‘চীনের প্রভাব’ রয়েছে—এমন ধারণা নিয়েও যথেষ্ট সতর্ক।
ভারতীয় কিছু মহল, বিশেষ করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ‘সেইম টুলকিট’ তত্ত্বকে সামনে এনেছে। তাদের দাবি, যুব নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনগুলো আপাতদৃষ্টিতে স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া শাসন পরিবর্তনের সঙ্গে এগুলোর ‘অস্বাভাবিক মিল’ রয়েছে। তাই তাদের আশঙ্কা, এর পেছনে হয়তো কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনা কাজ করছে, যার উদ্দেশ্য গোটা অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করা—অর্থাৎ, পশ্চিমা শক্তিগুলোর কোনো সাজানো খেলা।
আমি সাধারণত এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে সন্দিহান থাকি। বাস্তব পৃথিবী অনেক সময়ই এলোমেলো ঘটনাবলির প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তবে ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকেরা এদিকটা ভাবেন না। তবু ভারতকে অবশ্যই এ ধরনের আশঙ্কাকে মাথায় রাখতে হবে এবং ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তবু সুশীলা কার্কিকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের সাজানো কোনো ‘কালার রেভল্যুশন’ তত্ত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। ৭৩ বছর বয়সী কার্কির স্বদেশি নেপালি প্রতিরোধ আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাজতন্ত্র উৎখাতে তিনি অংশ নিয়েছেন, লড়েছেন সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
কার্কি পড়াশোনা করেছেন ভারতের বারানসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারত নিয়ে তিনি প্রায়ই স্মৃতিচারণ করেন। ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ আমাদের আশ্বস্ত করার মতো বিষয়। বিচার বিভাগের ভেতর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর আপসহীন অবস্থান, সঙ্গে তাঁর স্বামীর তৎকালীন রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা (১৯৭৩ সালের বিখ্যাত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার নায়ক তিনি)—এগুলো ব্যাখ্যা করে—কেন তাঁকে বেছে নেওয়া হলো। আরও বড় কথা, বিক্ষোভকারীরা গেমিং চ্যাট অ্যাপ ‘ডিসকোর্ড’ ব্যবহার করে তাঁকে বেছে নিয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, আন্দোলনটি কতটা স্বতঃস্ফূর্ত ও বিশৃঙ্খল—যা কোনো সুচারুভাবে সাজানো অভ্যুত্থানের ধারণার সঙ্গে মেলে না।
তবে স্বল্প মেয়াদে নেপালে ভারতের ‘বিশেষ ভূমিকা’ প্রভাবিত হতে পারে। এই অস্থিরতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় প্রকল্প, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ খাত থমকে যেতে পারে বা ব্যাহত হতে পারে। অরুণ-৩ ও ফুকোত কর্ণালি প্রকল্প ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং আঞ্চলিক শক্তিকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার ভারতের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রকল্পে দেরি হলে তা হবে বড় ধরনের ধাক্কা। আন্দোলনের সময় প্রায় ৩৩ হাজার বন্দী জেল থেকে পালিয়ে গেছেন। যাঁদের মধ্যে খুন ও ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিরাও রয়েছেন। অনেকেই এখন বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কারও কারও হাতে লুট করা অস্ত্র রয়েছে। এই অবস্থায় সমাজের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি হয়েছে।
এই অবস্থায় ভারত কী করতে পারে? নয়াদিল্লির হাতে সীমিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু পথ খোলা রয়েছে। একদিকে সার্বভৌম প্রতিবেশীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দূরত্ব বজায় রেখে সম্মান প্রদর্শনের জন্য হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ জরুরি। অন্যদিকে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় সূক্ষ্ম অথচ সক্রিয় কৌশলও নিতে হবে।
অবশ্যই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলা জরুরি। নেপালের রাজনীতিতে ভারতের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের প্রবণতা প্রতিহত করতে হবে। অতীতে ২০১৫ সালের অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত অবরোধের মতো কূটনৈতিক চাপ উল্টো ফল দিয়েছে। এতে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব বেড়েছে এবং দেশটি চীনের দিকে ঝুঁকেছে। এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে নেপালের রাজনীতির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা না করে দূরত্ব বজায় রাখা।
একই সময়ে নেপালের উন্নয়ন এবং ভারতের ‘সফট পাওয়ার’–এর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে আমাদের আরও বেশি করে উন্নয়ন সহায়তা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। চলমান প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ করা, সাধারণ নেপালি জনগণের উপকারে আসবে—এমন নতুন উদ্যোগ নেওয়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ানো—এসব পদক্ষেপ নেপালে ভারতের প্রতি শুভেচ্ছা বাড়াবে এবং সম্পর্ক মজবুত করবে।
নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোও দরকার। নেপালের উঠতি রাজনৈতিক নেতা ও তরুণ কর্মীদের সঙ্গে নয়াদিল্লিকে নতুন যোগাযোগের পথ খুলতে হবে। তাঁদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভ বোঝা ছাড়া ভবিষ্যৎমুখী পররাষ্ট্রনীতি তৈরি সম্ভব নয়। এই নতুন প্রজন্মকে উপেক্ষা করা বড় ভুল হবে। তবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করাও বাদ দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় সহিংসতার প্রভাব ভারতে ছড়িয়ে পড়া বা অবাঞ্ছিত উপাদান ঢুকে পড়া ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়াতে হবে।
নেপাল এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভারতের জন্য এটা ‘ওরা ওদের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা নয়। নয়াদিল্লিকে বুঝতে হবে, এই গণ-অসন্তোষ কত গভীর ক্ষোভ থেকে তৈরি হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদি ও সূক্ষ্ম কৌশল নিতে হবে—যেখানে পারস্পরিক সম্মান, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা গুরুত্ব পাবে আর নেপালের রাজনৈতিক সমাধান নেপালিদের হাতেই থাকবে।
নতুন সরকারকে এখন নির্বাচন প্রস্তুতি, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, যুবকদের বেকারত্ব কমানো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এরপর কী আসবে, তা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও নির্ধারণ করার দায়িত্ব ভারতের নয়।
নেপাল আমাদের কাছে কেবল প্রতিবেশী নয়, বরং ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ—যার সঙ্গে সংস্কৃতি, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান ও ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। তাই একদিকে হস্তক্ষেপ না করা, অন্যদিকে উদাসীনও না থাকা—এই ভারসাম্য খুঁজে নিতে হবে। নেপালে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে নতুন সরকারকে আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়াই হবে ভারতের মূল ভূমিকা। স্বীকার করতে হবে, সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের কূটনীতিকদের জন্য সহজ কাজ নয়। কিন্তু ঠিক এই কাজের জন্যই তো আমরা তাঁদের বেতন দিই—নাকি!
এনডিটিভি থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
ভারত সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, এই চুক্তি দুই দেশের ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার ও বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও দৃঢ় ও সহনশীল করে তোলার যৌথ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন’। সহজভাবে বললে, এটি এমন চুক্তি, যা দীর্ঘ মেয়াদে ভারত ও ইসরায়েলের অর্থনীতিকে যুক্ত করে রাখবে।
২ দিন আগেআওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালে দমন ও হয়রানির শিকার জামায়াতে ইসলামী এখন পুনরায় আত্মপ্রকাশ ও প্রভাব শক্তিশালী করার জন্য উর্বর ভূমি পাচ্ছে। ঢাকার মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাজনীতির জমিনে জামায়াতে ইসলামী-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের এ জয় দলটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
৪ দিন আগেরক্ষণশীল ইনফ্লুয়েন্সার ও টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএর প্রতিষ্ঠাতা চার্লি কার্ককে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনা ঘিরে অনলাইনে একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়েছে।
৪ দিন আগেমার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে খুব একটা পিছিয়ে নেই। তবে বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্র আসলেই এই খাতে পিছিয়ে আছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো টম কারাকো বলেন, ‘আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) যখন...
৪ দিন আগে