Ajker Patrika

রাশিয়ায় ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পেও প্রাণহানি নেই, আফগানিস্তানে ৬ মাত্রাতেই এত ক্ষয়ক্ষতি কেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আফগানিস্তানের কম মাত্রার ভূমিকম্পে এত বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটার পেছনে ভূতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও অবকাঠামোগত কারণ রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
আফগানিস্তানের কম মাত্রার ভূমিকম্পে এত বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটার পেছনে ভূতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও অবকাঠামোগত কারণ রয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

গত জুলাইয়ে রাশিয়ার কামচাৎকা উপদ্বীপে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের পরও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। তবে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে সোমবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ৮ শতাধিক প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার। প্রাথমিকভাবে এমন বৈপরীত্য অবাক করলেও, বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ ও ভূতাত্ত্বিক বাস্তবতা বলছে—ভূমিকম্পের মাত্রা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ভূপ্রকৃতি, সময়, অবকাঠামো ও মানববসতির প্রকৃতি।

রাশিয়ার তুলনায় আফগানিস্তানের কম মাত্রার ভূমিকম্পে এত বড় মানবিক বিপর্যয় ঘটার পেছনে ভূতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও অবকাঠামোগত কারণ রয়েছে।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও ভূগঠন

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটি পাকিস্তান সীমান্তের কাছে জালালাবাদ শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে স্থানীয় সময় রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে আঘাত হানে। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার গভীরতায় উৎপত্তি হওয়ায় বেশি ধ্বংসাত্মক হয়েছে। যেখানে সাধারণত অগভীর ভূমিকম্পের প্রভাব বেশি ধ্বংসাত্মক হয়।

অন্যদিকে, রাশিয়ার কামচাৎকা অঞ্চলে আঘাত হানা ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল সমুদ্রের অনেক গভীরে এবং দূরবর্তী অঞ্চলে। এর ফলে বড় মাত্রার হলেও মানববসতির ওপর সরাসরি প্রভাব কম পড়েছে।

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। দেশটি দুটি প্রধান টেকটোনিক প্লেট—ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেট—এর সংযোগস্থলে অবস্থিত। এ দুটি টেকটোনিক প্লেট প্রায়ই ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। কুনার, নানগারহার এবং লাগমান প্রদেশ জুড়ে অঞ্চলটি পাহাড় বেষ্টিত, দুর্গম ও দুর্ভেদ্য। ফলে উদ্ধার কাজও এখানে অনেক জটিল।

উল্লেখ্য, কুনার প্রদেশে ৫ লাখের বেশি, নানগারহারে ২ লক্ষাধিক এবং লাগমান প্রদেশে ৫ লক্ষাধিক মানুষের বাস।

অবকাঠামোর মান ও উপাদান

আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহার প্রদেশের বহু গ্রাম রয়েছে দুর্গম পাহাড়ে এবং মাটির খাঁজে। এই গ্রামগুলোতে সাধারণত ঘরবাড়ি তৈরি হয় কাদামাটি, পাথর ও কাঠ দিয়ে। এগুলো উপাদানে অবকাঠামো নির্মাণে খরচ কম, কিন্তু দুর্বল। এগুলো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিকে থাকার মতো শক্তিশালী নয়।

২০২২ সালের বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘জাপান এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে আফগানিস্তানের তুলনায় আরও বেশি ভূমিকম্প হয়ে থাকে। তবে আফগানিস্তান বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ সেখানকার ঘরবাড়িগুলো ভূমিকম্প-প্রতিরোধী নয়। সাধারণত এসব ঘরবাড়ি তৈরি হয় কাঠ ও অ্যাডোব (এক ধরনের কাদামাটির ইট) দিয়ে, কিংবা দুর্বল কংক্রিট দিয়ে।’

এমন অনিরাপদ কাঠামোগুলোতে যখন অগভীর ভূমিকম্পের তীব্র কম্পন আঘাত হানে, তখন সেগুলো মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এতে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে যখন ভূমিকম্পটি ঘটে রাত ১১টা ৪৭ মিনিটে, যখন অধিকাংশ মানুষ ঘুমাচ্ছিলেন, তখন পালিয়ে বাঁচার সুযোগও কম।

দুর্গম ও উদ্ধারকাজে বিলম্ব

এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এমন যে, সাধারণ সময়েও যাতায়াত করা কষ্টসাধ্য। সরু মেঠো পথ, পাহাড়ি বাঁক এবং অপ্রশস্ত রাস্তার কারণে গাড়ি কিংবা উদ্ধারকারী দল দ্রুত পৌঁছাতে পারে না। এবারের ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিধস হওয়ার কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে, তালেবান প্রশাসনকে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে আহতদের উদ্ধার করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে ত্রাণ সহায়তা দলেরও এমন দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিবিসির তথ্য অনুসারে, আফগানিস্তানের সবচেয়ে কাছের বড় হাসপাতাল জালালাবাদে প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়েই ১ হাজারের বেশি রোগী সেবা নেয়। ভূমিকম্পের পরে সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক রোগীকে মেঝেতে শুইয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কুনার প্রদেশের আসাদাবাদ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মুলাদাদ জানিয়েছেন, প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন করে আহত মানুষ হাসপাতালে আসছে। হাসপাতালে এখন আর জায়গা নেই।

রাশিয়াতে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়াতে ৮.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকম্পে মৃত্যুঝুঁকি কখন বাড়ে?

আফগানিস্তান অতীতেও বহুবার এই ধরনের বিপর্যয় দেখেছে। ২০২২ সালে পাকতিকা প্রদেশে ৫ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ১ হাজার জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালে হেরাতে আরেকটি ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ১ হাজারেরও বেশি মানুষ।

সাধারণত দেখা যায়, যখন ভূমিকম্প দুর্গম অঞ্চলে হয়, তখন প্রথম দিকে হতাহতের সংখ্যা কম মনে হলেও, পর্যাপ্ত অনুসন্ধান এবং উদ্ধারকাজ শুরু হলে সেই সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। এবারের ঘটনাতেও একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আফগান কর্তৃপক্ষ।

বিজ্ঞান কী বলে

আপাতদৃষ্টিতে ছোট ভূমিকম্প কেন বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে—এমন শিরোনামে ২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডভিত্তিক অনলাইন সংবাদ প্ল্যাটফর্ম স্টাফ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে

জেএনএস সায়েন্স এর ভূকম্পবিদ ড. জন রিস্তাও বলেন, ‘একটি ছোট মাত্রার ভূমিকম্পও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে যদি এটি খুব অগভীর হয় এবং জনবসতির একদম কাছে হয়।’ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল, গভীরতা, স্থানীয় মাটি ও পাথরের গঠন এবং মানবনির্মিত অবকাঠামোর দৃঢ়তা—এই সবকিছুই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে।

বেডরক (শিলা) এলাকার তুলনায় নরম মাটির অঞ্চলগুলো বেশি কাঁপে, ফলে ধ্বংস বেশি হয়। পাশাপাশি, পাহাড়ি উপত্যকার বিশেষ ভৌগোলিক গঠন ভূমিকম্পের তরঙ্গ প্রতিফলন ও বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহারের মতো এলাকার জন্য এই ব্যাখ্যা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

রাশিয়ায় কম ক্ষয়ক্ষতি কেন

রাশিয়ার ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের পরে সামান্য সুনামি দেখা গেলেও, বড় শহর বা জনবসতিতে সরাসরি আঘাত না হাওয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা অনেক কম ছিল। এ রকম ভূমিকম্পের উৎপত্তি সমুদ্রের গভীরে হলে এর শক্তি পানিতে ছড়িয়ে পড়ে, ভূমিতে কম কম্পন হয়। তবে সুনামি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

উল্টোভাবে, আফগানিস্তানে এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তি ভূপৃষ্ঠের মাত্র ৮ কিলোমিটার গভীরে হওয়ায়, এর শক্তি সরাসরি মাটির ওপর আঘাত হানে। সেই সঙ্গে দুর্বল বাড়িঘর এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব মিলে মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়াবহতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

ভূমিকম্পে মূলত দুটি ধরনের ভূকম্পন তরঙ্গ সৃষ্টি হয়—পি-ওয়েভ এবং এস-ওয়েভ। পি-ওয়েভ খুব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। মাটি বা ভূমি ভয়ানকভাবে দোলনার মতো দুলতে থাকে। সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় যেমনটি দেখা যায় এই দৃশ্যটি তেমন। এস-ওয়েভ তুলনামূলকভাবে ধীরে চলে এবং ভূমিকে ওপরে-নিচে কাঁপায়, পি-ওয়েভের গতিপথের সাপেক্ষে ঠিক উল্লম্ব দিকে (৯০ ডিগ্রি। আফগানিস্তানের পাহাড়ি দুর্বল নির্মাণ কাঠামোর কারণে এই দুটি তরঙ্গ ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পেরেছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিএনএন, স্টাফ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত