Ajker Patrika

রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমানবহরে ইউক্রেনের হামলায় যুদ্ধের মোড় কোন দিকে ঘুরবে

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৩ জুন ২০২৫, ১৫: ২৯
সাইবেরিয়ার ইরকুতস্ক অঞ্চলের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলার দৃশ্য দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত
সাইবেরিয়ার ইরকুতস্ক অঞ্চলের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলার দৃশ্য দেখা যায়। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমানবহরে ইউক্রেনের সাম্প্রতিক হামলার প্রশংসা করতেই হয় সামরিক নৈপুণ্যের আলোকে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দারা জানিয়েছে, গত রোববার তারা রাশিয়ার চারটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এসব ঘাঁটির মধ্যে আর্কটিক ও সাইবেরিয়া অঞ্চলের বিমানঘাঁটিও আছে। এ ছাড়া, হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪১টি যুদ্ধবিমানের মধ্যে সুপারসনিক টিইউ-২২ এম দূরপাল্লার বোমারু বিমান, টিইউ-৯৫ ফ্লাইং ফোর্ট্রেস এবং এ-৫০ আর্লি ওয়ার্নিং যুদ্ধবিমানও আছে।

মস্কো বিমানগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে নিশ্চিত করেছে যে, বিমানঘাঁটিগুলোতে ‘ইউক্রেনীয় সন্ত্রাসী হামলা’ হয়েছিল। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউ ‘দ্য স্পাইডারওয়েব’ নামে এই অভিযানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের পোস্ট করা ভিডিওতে মাত্র কয়েকটি বিমানে আঘাত লাগতে দেখা গেছে।

এই কৌশলগত বোমারু বিমানগুলো রাশিয়ার আকাশসীমা থেকে ইউক্রেনজুড়ে লক্ষ্যবস্তুতে ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বোমারু বিমানবহরটি মস্কোর ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়াড বা পারমাণবিক ত্রয়ীর’ অংশ, যা মূলত পারমাণবিক অস্ত্র বহনে ব্যবহৃত হয়।

কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, এই হামলা রাশিয়ার পারমাণবিক পরাশক্তির বৈশ্বিক ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জেনারেল স্টাফের সাবেক ডেপুটি প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইগর রোমানেনকো আল-জাজিরাকে বলেন, এই হামলা অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও ‘পশ্চিমা বিশ্বকে সাহায্য করেছে। কারণ, এই হামলায় (রাশিয়ার) পারমাণবিক সক্ষমতাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।’

রোমানেনকো বলেন, এই হামলা ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপে রাশিয়ার সক্ষমতাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করলেও ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্ধচন্দ্রাকার ফ্রন্টলাইন বরাবর স্থল যুদ্ধকে প্রভাবিত করবে না। তিনি ‘দ্য স্পাইডারওয়েব’ অপারেশনের পরিধি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া দখল করার পর ইউক্রেনের মস্কোর কৃষ্ণসাগর নৌবহরের ওপর চালানো ধারাবাহিক হামলার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

সে সময় ইউক্রেনের নৌবাহিনীতে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি ছোট, কয়েক দশকের পুরোনো যুদ্ধজাহাজ। এই জাহাজের সংখ্যা এতই কম যে, তা একটি ফুটবল মাঠ আকারের বন্দরেও এটে যেত। তারপরও এই সক্ষমতা নিয়েই সে সময় কিয়েভ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের সহায়তায় রুশ যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দিয়ে নৌযুদ্ধকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছিল। এরপর, মস্কো দ্রুতই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষ্ণসাগর নৌবহরকে পূর্বে নভোরোসিস্ক বন্দরে সরিয়ে নেয়। এরপর রাশিয়া দীর্ঘদিন আর শস্য ও ইস্পাতবাহী ইউক্রেনীয় বেসামরিক জাহাজগুলোকে বাধা দিতে ব্যবহার করেনি।

‘দ্য স্পাইডারওয়েব’ রাশিয়ার সামরিক কৌশলবিদদের অপ্রস্তুত করে ফেলে। কারণ, তারা ক্ষেপণাস্ত্র বা ভারী এবং দূরপাল্লার আক্রমণ ড্রোনের হামলা প্রতিরোধের জন্য নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। এর পরিবর্তে, ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা এসবিইউ ১১৪টি খেলনার মতো ফার্স্ট পার্সন ভিউ (এফপিভি) ড্রোন ব্যবহার করে, যার প্রতিটির খরচ মাত্র কয়েক শ ডলার। এগুলো কাঠের ক্রেটে লুকিয়ে ট্রাকে লোড করা হয়েছিল।

তারপর রুশ কর্তৃপক্ষের কাছে সন্দেহভাজন নয়, এমন ট্রাকচালকেরা সেগুলোকে বিমানঘাঁটিগুলোর একদম কাছে নিয়ে যায়। এসবিইউ দাবি করেছে, ‘এরপর সেগুলো উড়ে গিয়ে (রাশিয়ার) ৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি সাধন করায় তারা হতবাক হয়ে যায়।’

রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলের বিমানঘাঁটি মারমানস্কেও হামলা চালায় ইউক্রেন। হামলার পর নরওয়ের কাছাকাছি অবস্থিত ওলেনেগোরস্ক বিমানঘাঁটি থেকে ঘন কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এই হামলার প্রত্যক্ষদর্শী এক রুশ নাগরিক বলেন, হামলার পর ‘চালক আতঙ্কে দিগ্‌বিদিক দৌড়াতে শুরু করে।’

বিমানঘাঁটিগুলোর সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো ক্ষুদ্র এফপিভি ড্রোন শনাক্ত করা ও সেগুলো ধ্বংস করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। তবে রেডিও জ্যামিং সরঞ্জাম এই ড্রোনগুলোকে তাদের গতিপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারলেও তা সম্ভবত হামলার সময় চালু ছিল না বা ত্রুটিপূর্ণ ছিল।

এসবিইউ রাশিয়াকে খোঁচা দিয়ে লিখেছেন, ‘দ্য স্পাইডারওয়েবের’ কমান্ড সেন্টার রাশিয়ার প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) কার্যালয়ের কাছাকাছি এক অজ্ঞাত স্থানে ছিল। রাশিয়ার এই গোয়েন্দা সংস্থার উত্তরসূরি কেজিবির প্রধান ছিলেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রোমানেনকো বলেন, ‘এটি রাশিয়া, এফএসবি এবং পুতিনের গালে এক শক্ত চপেটাঘাত।’

জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিন আল-জাজিরাকে বলেন, ‘তারা (ইউক্রেন) রাশিয়ার কৌশলগত বিমান এ কারণে ধ্বংস করেনি যে, এগুলো পারমাণবিক ওয়ারহেডসহ ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম, বরং অ-পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ব্যবহার করা হয় বলেই সেগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।’

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি করেছেন, এই অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছে ১৮ মাস ধরে। এই অভিযানে রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমানের বহরের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যায় টেলিগ্রামে তিনি লিখেন, ‘এটি আমাদের সবচেয়ে দূরপাল্লার অভিযান। ইউক্রেনের এই কার্যক্রম নিশ্চিতভাবে ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে থাকবে। আমরা রাশিয়াকে এই যুদ্ধ শেষ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করানোর জন্য সবকিছু করছি।’

ক্ল্যাশ রিপোর্ট—নামে এক সামরিক ব্লগার গতকাল সোমবার বলেছেন, এসবিইউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ড্রোনগুলোকে ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলের একটি বিমান চলাচল জাদুঘরে প্রদর্শিত সোভিয়েত-যুগের বিমানগুলো শনাক্ত করতে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

এই হামলা ইউক্রেনীয় ও রুশ কূটনীতিকদের ইস্তাম্বুলে দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করার একদিন আগে ঘটে। তবে, কিয়েভভিত্তিক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, এটি আলোচনার ‘যুক্তিতর্ককে’ প্রভাবিত করবে না।

পেন্টা থিংক ট্যাংকের প্রধান ভলোদিমির ফেসেঙ্কো আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আবেগীয় দিক থেকে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে এই অভিযান ইউক্রেনীয় আলোচকদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে। কিন্তু আলোচনার প্রক্রিয়ার মূল যুক্তি পরিবর্তন হবে না।’

ফেসেঙ্কো বলেন, ‘উভয় পক্ষই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিবেচনা করবে এবং যে প্রথমে আলোচনা ছেড়ে যাবে, সে তার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার অবস্থান হারাবে।’ আবার, আলোচনা সম্ভবত দেখাবে যে উভয় পক্ষই মীমাংসার জন্য প্রস্তুতও নয়। কারণ, রাশিয়া ইউক্রেনের আরও অঞ্চল নিজেদের জন্য দখল করার আশা করছে এবং ইউক্রেনও হার মানতে রাজি নয়।

ফেসেঙ্কো বলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনকে শেষ করতে চায় এবং আমরাও দেখাচ্ছি যে, আমরা প্রতিরোধ করব, হাল ছাড়ব না, আত্মসমর্পণ করব না।’

ওয়াশিংটনভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক ক্রিস বিগার্স সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘একটি সু-সম্পাদিত অভিযানে কী অসাধারণ সাফল্য।’ পোস্টে তিনি ইরকুতস্ক অঞ্চলের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে আটটি বিমান ধ্বংসের একটি মানচিত্রও শেয়ার করেন। ইউক্রেনীয় বিশ্লেষকদের দল ওকো হোরার মতে, মারমানস্ক ঘাঁটিতে আরও ৫টি বিমান ধ্বংস হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাশিয়া সম্ভবত ‘দ্য স্পাইডারওয়েবের’ প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের বেসামরিক স্থানগুলোতে আরও ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে। ফেসেঙ্কো বলেন, ‘আমি ভয় পাচ্ছি তারা আবার ওরেশনিক ব্যবহার করবে।’ এটি রাশিয়ার সবচেয়ে উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, যা প্রতি ঘণ্টায় ১২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বা শব্দের গতির ১০ গুণ পর্যন্ত গতিতে চলতে পারে এবং নভেম্বর মাসে পূর্ব ইউক্রেনের একটি কারখানায় আঘাত হানতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে ফাঁস দিলেন স্ত্রী

ইরানে ভূমিকম্প নিয়ে পারমাণবিক পরীক্ষার জল্পনা, যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

‘আমেরিকা যুদ্ধে জড়ালে ইরানের হাতে অনেক বিকল্প আছে’

‘ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় নয়, গুণে বিশ্বাসী ইরান, ইসরায়েল এবার আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখবে’

এবার আক্রমণের অগ্রভাগে ড্রোন, ইরানের ‘হাইব্রিড’ হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ ইসরায়েল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত