Ajker Patrika

বিবিসির নিবন্ধ /স্বীকৃতি তো মিলছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবে কে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪: ৪৪
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

চলতি মাসের শুরুর দিকে ফিলিস্তিনি কূটনীতিক ড. হুসসাম জুমলাতকে লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাথাম হাউসে এক আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। ঠিক সেই সময়টাতেই বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশ জাতিসংঘে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেই আলোচনায় জুমলাত স্পষ্ট বুঝে গিয়েছিলেন যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।

তবে ড. জুমলাত সতর্ক করে বলেন, ‘নিউইয়র্কে আপনারা যা দেখতে যাচ্ছেন, তা হয়তো দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান কার্যকর করার আসল শেষ প্রচেষ্টা হতে পারে। সেটি যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয়।’ জুমলাত যে আশা চ্যাথাম হাউসে প্রকাশ করেছিলেন, কয়েক সপ্তাহ পর সেটাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াও এবার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এ ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে বেড়ে চলা ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে আমরা কাজ করছি শান্তির সম্ভাবনা আর দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান বাঁচিয়ে রাখতে। এর মানে হচ্ছে, একটি নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি টিকে থাকার মতো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তোলা—বর্তমানে দুটোরই অভাব রয়েছে।’

এর আগে ১৫০টিরও বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবে যুক্তরাজ্যসহ নতুন কিছু দেশের যোগ হওয়াকে অনেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন। ফিলিস্তিনি প্রশাসনের সাবেক কর্মকর্তা জাভিয়ের আবু ঈদ বলেন, ‘বিশ্বে এর আগে ফিলিস্তিন কখনোই এতটা শক্তিশালী অবস্থানে ছিল না। বিশ্ব এখন ফিলিস্তিনের জন্য এক হয়ে উঠছে।’

তবে এখানে জটিল কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে—ফিলিস্তিন আসলে কী এবং এমন কোনো রাষ্ট্র আদৌ আছে কি, যাকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়? কোনো রাষ্ট্রের স্বীকৃতির জন্য ১৯৩৩ সালের উরুগুয়ের মন্টেভিডিও কনভেনশনে চারটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে দুটি শর্ত পূরণের দাবি তুলতে পারে ফিলিস্তিন। এর একটি হলো—স্থায়ী জনসংখ্যা (যদিও গাজায় যুদ্ধের কারণে এটি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে) এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতা। ড. জুমলাত নিজেই এর প্রমাণ।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত ও আইজ্যাক রবিন। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নিয়ে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত ও আইজ্যাক রবিন। ছবি: এএফপি

কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের শর্ত পূরণ এখনো হয়নি। চূড়ান্ত সীমান্ত নিয়ে কোনো সমঝোতা নেই (কোনো কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়াও নেই)। ফলে ‘ফিলিস্তিন’ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিতে তাঁদের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গঠিত হবে তিনটি অংশ নিয়ে—পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল এই তিনটি এলাকাই দখল করেছিল।

মানচিত্রে চোখ বোলালেই সমস্যাগুলো ধরা পড়ে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা প্রায় ৭৫ বছর পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা ভৌগোলিকভাবে আলাদা হয়ে আছে। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা ও ইহুদি বসতির কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (যা ১৯৯০-এর দশকের অসলো শান্তি চুক্তির পর গঠিত হয়) হাতে রয়েছে কেবল প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ডের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। ১৯৬৭ সালের পর থেকে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ পশ্চিম তীরকে আরও খণ্ডিত করেছে, যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে এটিকে দুর্বল করে তুলেছে।

অন্যদিকে, পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাঁদের রাজধানী হিসেবে দেখে। কিন্তু শহরটিকে ঘিরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা ইহুদি বসতি এটিকে পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গাজার অবস্থা আরও ভয়াবহ। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে হামাসের হামলার পর শুরু হওয়া যুদ্ধের প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে উপত্যকার বড় একটি অংশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এর বাইরেও সমাধান করার মতো একটি বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে। রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য মন্টেভিডিও কনভেনশনে চতুর্থ যে মানদণ্ড রয়েছে, তা হলো—একটি কার্যকর সরকার। এটাই এখন ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

১৯৯৪ সালে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন—পিএলও) মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ (যা সাধারণভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বা পিএ নামেই পরিচিত)। এটি গাজা ও পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর আংশিক বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ চালাত।

কিন্তু ২০০৭ সালে হামাস ও প্রধান পিএলওর রাজনৈতিক শাখা ফাতাহর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর থেকে গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের অধীনে বসবাস করছে। গাজার ক্ষমতায় হামাস, আর পশ্চিম তীরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যার প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

এভাবে যে ফিলিস্তিনের কথা বলা হয়, তা ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা হয়ে আছে ৭৭ বছর ধরে এবং রাজনৈতিক বিভাজন চলছে ১৮ বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়ে পশ্চিম তীর ও গাজা আরও দূরে সরে গেছে একে অপরের কাছ থেকে। এর মধ্যে ফিলিস্তিনি রাজনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ফিলিস্তিনি তাঁদের নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারিয়েছেন এবং অভ্যন্তরীণ কোনো সমঝোতা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগতির ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়েছেন।

শেষবার ফিলিস্তিনে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছিল ২০০৬ সালে। অর্থাৎ, পশ্চিম তীর বা গাজায় ৩৬ বছরের কম বয়সী কোনো ফিলিস্তিনি জীবনে কখনো ভোট দিতে পারেননি। ফিলিস্তিনি আইনজীবী দিয়ানা বুত্তু বলেন, ‘এত বছর ধরে নির্বাচন না হওয়া সত্যিই মস্তিষ্ক অবশ করে দেওয়ার মতো। আমাদের নতুন নেতৃত্ব দরকার।’

গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এমন দুর্দশায় পতিত হয়েছেন ২৪ লাখ ফিলিস্তিনি। ছবি: এএফপি
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এমন দুর্দশায় পতিত হয়েছেন ২৪ লাখ ফিলিস্তিনি। ছবি: এএফপি

এরপর, ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর বিষয়টি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। হাজার হাজার নাগরিক নিহত হওয়ার মুখে পশ্চিম তীরের সদর দপ্তরে বসে থাকা আব্বাসের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কার্যত অসহায় দর্শকের ভূমিকায় পরিণত হয়েছে।

যখন পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত নির্বাসন থেকে ফিরে এসে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন স্থানীয় ফিলিস্তিনি রাজনীতিকেরা প্রায় উপেক্ষিত হয়ে পড়েন। ‘ভেতরের লোকেরা’ আরাফাতের ‘বাইরের লোকদের’ কর্তৃত্ববাদী ধরন মেনে নিতে পারেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে দুর্নীতির গুজবও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সুনাম ক্ষুণ্ন করে।

সবচেয়ে বড় বিষয়, সদ্য গঠিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ক্রমাগত বসতি স্থাপন রোধে ব্যর্থ হয়। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের যে প্রতিশ্রুতি আরাফাতের ঐতিহাসিক হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে (ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের সঙ্গে ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে হোয়াইট হাউসের লনে) আশাব্যঞ্জকভাবে উত্থাপিত হয়েছিল, সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি।

পরবর্তী বছরগুলোও ধীরস্থির রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য অনুকূল ছিল না। একের পর এক ব্যর্থ শান্তি উদ্যোগ, ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ, দুই পক্ষের চরমপন্থীদের সহিংসতা, ইসরায়েলের ডানপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়া এবং ২০০৭ সালে হামাস–ফাতাহর সহিংস বিভাজন—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে।

ফিলিস্তিনি ইতিহাসবিদ ইয়াজিদ সায়িঘ বলেন, ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নতুন নতুন মুখ, নতুন প্রজন্ম উঠে আসত। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি...দখলকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনিরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলাদা জায়গায় ভেঙে পড়েছে। এতে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে।’

তবু একজন নেতা উঠে এসেছিলেন—মারওয়ান বারঘৌতি। পশ্চিম তীরেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা বারঘৌতি ১৫ বছর বয়সেই আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ গোষ্ঠীতে সক্রিয় হন। দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি ইন্তিফাদা তথা বিদ্রোহের সময় তিনি জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাঁচ ইসরায়েলিকে হত্যার পরিকল্পনার অভিযোগ আনা হয়। তিনি সব সময় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে ২০০২ সাল থেকে তিনি ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী।

তবু যখন ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা হয়, তখন ফিলিস্তিনিরা প্রায় ২৫ বছর ধরে বন্দী একজন ব্যক্তির নামই বেশি উচ্চারণ করেন। পশ্চিম তীরভিত্তিক ‘প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চের’ সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ ফিলিস্তিনি বারঘৌতিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে চান। আর ২০০৫ সাল থেকে এই পদে থাকা মাহমুদ আব্বাসের সমর্থন অনেক কম।

মারওয়ান বারঘৌতি ফাতাহের জ্যেষ্ঠ সদস্য হলেও গাজায় জিম্মি থাকা ইসরায়েলিদের বিনিময়ে হামাস যেসব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তির তালিকা দিচ্ছে, সেখানে তাঁর নামও গুরুত্বের সঙ্গে রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু তাঁকে মুক্তি দিতে ইসরায়েল কোনো আগ্রহ দেখায়নি। গত আগস্টের মাঝামাঝি এক ভিডিও প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, ৬৬ বছর বয়সী কৃশকায় ও দুর্বল বারঘৌতিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির উপহাস করছেন। বহু বছর পর এটাই ছিল বারঘৌতির প্রথম প্রকাশ্য উপস্থিতি।

২২ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী মারওয়ান বারঘৌতি এখনো ফিলিস্তিনিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা। ছবি: এএফপি
২২ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী মারওয়ান বারঘৌতি এখনো ফিলিস্তিনিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতা। ছবি: এএফপি

গাজা যুদ্ধ শুরুরও আগে থেকেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরোধিতা ছিল স্পষ্ট। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বলেন, ‘সবাই জানে, আমি-ই সেই ব্যক্তি, যিনি দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রেখেছি। কারণ, তা হলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ত।’

আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আবার গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে আহ্বান জানানো হলেও নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমিকা থাকবে না। তাঁর যুক্তি, মাহমুদ আব্বাস এখনো ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার নিন্দা করেননি।

গত আগস্টে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে এমন এক বসতি নির্মাণ পরিকল্পনায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়, যা কার্যত পূর্ব জেরুজালেমকে পশ্চিম তীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ৩ হাজার ৪০০টি বাড়ি নির্মাণের অনুমোদন মেলে সে সময়। এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেন, এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ধারণাকে ‘সমাধিস্থ করবে। কারণ, স্বীকৃতি দেওয়ার মতো কিছু নেই, কাউকে স্বীকৃতি দেওয়ারও নেই’।

এ বিষয়কে নতুন কিছু নয় বলে মনে করেন ইয়াজিদ সাইয়িঘ। তিনি বলেন, ‘আপনি চাইলে আর্চএঞ্জেল মাইকেলকেও (ইসলামে যাকে ফেরেশতা মিকাইল বলা হয়) পৃথিবীতে নামিয়ে এনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রধান করতে পারেন। তবু কোনো পার্থক্য হবে না। কারণ, যে পরিবেশে কাজ করতে হবে, তাতে কোনো ধরনের সাফল্য অর্জন একেবারেই অসম্ভব। আর এমন পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।’

একটা বিষয় নিশ্চিত—যদি কোনো দিন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে ওঠেও, সেটা হামাস চালাবে না। ফ্রান্স ও সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিন দিনের এক সম্মেলনে গত জুলাইয়ে একটি ঘোষণা গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘হামাসকে অবশ্যই গাজায় তাদের শাসন শেষ করতে হবে এবং অস্ত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।’

‘নিউইয়র্ক ঘোষণা’—নামে পরিচিত ওই ঘোষণা সব আরব রাষ্ট্র সমর্থন করে। পরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৪২ সদস্য দেশ তা সমর্থন করে। অন্যদিকে হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা গাজার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত—তবে সেটা হবে স্বাধীন টেকনোক্র্যাট বা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি প্রশাসনের কাছে।

বারঘৌতি কারাগারে, আব্বাসের বয়স প্রায় ৯০, হামাস ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং পশ্চিম তীর ছিন্নভিন্ন—এমন অবস্থায় স্পষ্ট যে ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব ও ঐক্য খুবই দুর্বল। তবে এ কারণে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে অমূল্য মনে করা যাবে না। ডায়ানা বুত্তু বলেন, ‘এটা আসলে অনেক মূল্যবান হতে পারে।’ তবে সতর্ক করে দিয়ে তিনি যোগ করেন, ‘কিন্তু সেটা নির্ভর করবে এসব দেশ কেন করছে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী।’

ব্রিটিশ সরকারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শুধু প্রতীকী স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন হলো, আমরা কি কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারব, নাকি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কেবল স্বীকৃতির এক উৎসব হয়ে থাকবে।’

‘নিউইয়র্ক ঘোষণায়’ স্বাক্ষরকারী দেশগুলো—যাদের মধ্যে ব্রিটেনও আছে—প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ফিলিস্তিন প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ‘বাস্তব, সময়ে সীমাবদ্ধ ও অপরিবর্তনীয় পদক্ষেপ’ নেওয়ার। লন্ডনের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দেন, ঘোষণায় গাজা ও পশ্চিম তীরকে ঐক্যবদ্ধ করা, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দেওয়া, ফিলিস্তিনি নির্বাচন আয়োজন এবং গাজা পুনর্গঠনে আরব দেশগুলোর পরিকল্পনা—এমন কিছু পদক্ষেপের কথাই বলা হয়েছে, যা স্বীকৃতির পর অনুসরণ করা উচিত।

তবে তাঁরা জানেন, প্রতিবন্ধকতা ভয়াবহ। ইসরায়েল এখনো অনড়ভাবে বিরোধিতা করছে এবং হুমকি দিচ্ছে, পশ্চিম তীরের কিছু অংশ বা পুরোটা আনুষ্ঠানিকভাবে দখল (অ্যানেক্সেশন) করবে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমার (ব্রিটিশ) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে।’

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নেয়—দশকের পর দশ ফিলিস্তিনি কর্মকর্তার ভিসা বাতিল বা প্রত্যাখ্যান করে। এটা জাতিসংঘের নিজস্ব নিয়ম লঙ্ঘনের সম্ভাবনাও তৈরি করেছে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা আছে এবং ট্রাম্প এখনো তাঁর তথাকথিত গাজা ‘রিভেরা পরিকল্পনায়’ অটল বলে মনে হচ্ছে। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ মেয়াদে গাজার ‘মালিকানা’ নেবে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে শুধু ‘পুনর্গঠিত ফিলিস্তিনি স্বশাসন’ এবং গাজার সঙ্গে পশ্চিম তীরের কোনো ভবিষ্যৎ সংযোগের কথাও এতে নেই।

গাজার দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ হয়তো নির্ধারিত হবে নিউইয়র্ক ঘোষণা, ট্রাম্পের পরিকল্পনা এবং আরব দেশগুলোর পুনর্গঠন পরিকল্পনার মধ্যে কোথাও। সব পরিকল্পনাই—তাদের নিজস্ব ভিন্ন পথে—চেষ্টা করছে গাজাকে গত দুই বছরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে কিছুটা হলেও কিছু উদ্ধার করতে। আর ভবিষ্যতে যা-ই আসুক, সেটা অবশ্যই উত্তর দিতে হবে—ফিলিস্তিন কেমন হবে এবং তাদের নেতৃত্ব কেমন হবে।

কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মতো ডায়ানা বুত্তুর কাছে আরও জরুরি প্রশ্ন হলো অন্য কিছু। তিনি বলেন, আসলে তিনি চাইবেন এসব দেশ আরও হত্যা ঠেকাতে কাজ করুক। তাঁর ভাষায়, ‘রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে বরং হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়াই জরুরি।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রদূত হলেন দুই সেনা কর্মকর্তা

তৌকীর-বিপাশা বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন যে কারণে

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

আশ্বিনে ৯ ঘণ্টায় ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টি কি স্বাভাবিক, যা বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর

ভারতীয় দর্শকদের বিমান ধসের ইঙ্গিত দিয়ে পাকিস্তানি ক্রিকেটারের নতুন বিতর্ক

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত