Ajker Patrika

জিনিসপত্রের দাম কমা নিয়ে কেন উদ্বেগে চীন সরকার?

আপডেট : ১০ আগস্ট ২০২৩, ২১: ৫০
জিনিসপত্রের দাম কমা নিয়ে কেন উদ্বেগে চীন সরকার?

করোনার ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই ইউরোপের উঠানে বেধে গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে অবশ্য আবার পোয়াবারো হয়েছে অনেক ভোগ্যপণ্য প্রতিষ্ঠানের। করোনার পর অনেক ব্যবসায়ীর পকেট ফুলেফেঁপে আরও ভারী হওয়ার খবরও বের হয়। এর একটা কারণ হচ্ছে, লকডাউনের পর মানুষ প্রচুর খরচ করা শুরু করে। চাহিদা ও জোগানের সূত্র মেনে তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় হু হু করে। 

সারা বিশ্বে মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম খাচ্ছে তখন চীনে ঘটছে উল্টোটা—দেশটিতে দ্রব্যমূল্য কমছে। দেখা দিয়েছে মুদ্রা সংকোচন। এমন পরিস্থিতি দেশটির কর্তাব্যক্তিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই বছরের বেশি সময় পর চীনে গত জুলাই মাসে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ার ফলে মুদ্রা সংকোচন দেখা দিয়েছে। চীনের সরকারি তথ্যমতে, দেশটির মূল্যস্ফীতি গত বছরের তুলনায় দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ায় চাপে পড়েছে চীন সরকার। তারা বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এর মধ্যে দুর্বল আমদানি-রপ্তানির তথ্য মহামারি-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির নেওয়া পদক্ষেপ প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন স্থানীয় সরকারের করা ঋণ এবং আবাসন খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে দেশটির বেকারত্বের হার। বিবিসির এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশটিতে এখন বেকারের সংখ্যা রেকর্ড ছড়িয়েছে। চীনের প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বিশ্ববিদ্যালয় পাস তরুণ বর্তমানে বেকার। 

সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা বলছেন, দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়া এবং এর থেকে উদ্ভূত সব চ্যালেঞ্জ, যেমন—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীর গতির কারণে চীন ঋণ পরিশোধে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। 

চীনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইএফজি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের এক কর্মকর্তা ডেনিয়েল মুরে বলেন, গোপন কোনো দাওয়াই নেই যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তাঁর পরামর্শ, সরকারের উচিত আরও ব্যয় বাড়ানো ও ট্যাক্স কমানো। একই সঙ্গে আরও সহজ মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা।

বেশির ভাগ উন্নত দেশে মহামারির বিধিনিষেধ শেষ হওয়ার পর ভোক্তাদের খরচের প্রবণতা বেড়ে যায়। যারা এত দিন সঞ্চয় করেছিলেন তাঁরা হঠাৎ ব্যয়ের সুযোগ পেয়ে হাত খুলে খরচ করা শুরু করেন। এতে জিনিসপত্রের আকস্মিক চাহিদা বেড়ে যায়। পণ্যের জোগান দিতে ব্যবসায়ীরা হিমশিম খেতে থাকেন। 

সীমিত পণ্য সরবরাহের বিপরীতে ব্যাপক হারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তবে আরেকটি বিষয় বলে রাখা ভালো, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াও পণ্যের দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ। 

কিন্তু চীনে এসব কোনো সূত্রই খাটছে না। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশটিতে বাড়েনি পণ্যের দাম। ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের পতন ঘটে সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই মুদ্রা সংকোচন কয়েক মাস স্থায়ী হয়। চীনের পণ্য উৎপাদনকারীদের ঠিক করে দেওয়া মূল্য যা ‘মিলগেট মূল্য’ হিসেবেও পরিচিত—সেটিও এখন নিম্নমুখী। 

হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অ্যাডজান্ট প্রফেসর আলিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে ভোগ্যপণ্যের প্রচুর চাহিদা দেখা যাচ্ছে। তখন চীনের মানুষের মধ্যে চাহিদা কমতে দেখা যাচ্ছে, এটি সত্যি উদ্বেগজনক। 

তিনি আরও বলেন, ‘মুদ্রা সংকোচন চীনকে সাহায্য করবে না। ঋণের বোঝা আরও ভারী হবে। এটি চীনের জন্য সুখবর নয়।’

বলা বাহুল্য, সারা বিশ্বে বিক্রি হওয়া পণ্যের একটি বড় অংশ উৎপাদন করে চীন। 

তবে আশার বিষয় হচ্ছে, চীনে বর্ধিত মুদ্রা সংকোচনের একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাব হতে পারে যে এটি যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এতে সমস্যাও আছে। চীনের উৎপাদিত এসব কম মূল্যের পণ্য বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়লে তা অন্যান্য দেশের ব্যবসায়ী তথা উৎপাদনকারীদের জন্য সুখকর হবে না মোটেও। এটি ব্যবসায় বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং কর্মসংস্থানে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। 

চীনের উহানে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীরা একটি চাকরি মেলায় অংশ নেন। ছবি: এএফপি 

চীনে পণ্যের মূল্য কমে যাওয়া কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশে রাশ টেনে ধরতে পারে এবং ভোক্তাদের খরচের প্রবণতার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মুনাফা কম হলে তারা কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পদক্ষেপ নেবে। একপর্যায়ে এর কারণে বেকারের সংখ্যাও বেড়ে যেতে পারে। 

ব্যবসায় মন্দা দেখা দিলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে পরিচিত চীন আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে। তারা জ্বালানি, কাঁচামাল ও খাদ্য আমদানি কমিয়ে দিলে অন্যান্য দেশের রপ্তানি আয় কমে যাবে। যা বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো কিছু হবে না। 

চীনের অর্থনীতি এরই মধ্যে আরও অনেক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, করোনা মহামারির ধাক্কা তারা যে গতিতে সামলে ওঠার কথা, প্রত্যাশামতো তা হচ্ছে না। 

গত মঙ্গলবার চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় তাদের রপ্তানি আয় প্রায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে। একইভাবে কমেছে আমদানিও। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় দেশটির আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছর আরও মন্থর হতে পারে।

চীন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার এভারগ্রান্ডের পতনের পরে চলমান আবাসন ব্যবসার সংকট নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করছে।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির ট্রেড পলিসি অ্যান্ড ইকোনমিকসের অধ্যাপক ঈশ্বর প্রসাদ বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে বিনিয়োগকারী ও ভোক্তাদের মধ্যে আস্থা তৈরিই হতে পারে মূল চাবিকাঠি। 

ঈশ্বর প্রসাদ বলেন, ‘দেখার বিষয় হলো বেসরকারি খাতে আস্থা ফেরাতে পারে কি না সরকার, যাতে ভোক্তারা সঞ্চয়ের পরিবর্তে খরচের দিকে ঝোঁকে। ভোক্তারা খরচ করলেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ শুরু করবেন এবং অর্থনীতিতে গতি ফিরে পাবে। তবে সরকার এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি যাতে বেসরকারি খাতে আস্থা তৈরি হয় এবং ভোক্তারা ব্যয় করতে উৎসাহী হন।’

বিবিসি অবলম্বনে রাকিব হাসান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শিক্ষার্থীদের ‘কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে’ সপরিবারে পালিয়েছেন বিএসবির বাশার

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: পাকিস্তানে নিহত বেড়ে ২৬, ভারতে ১০

সীমান্তে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত: পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী

কাশ্মীরে বিধ্বস্ত বিমানের অংশবিশেষ ফরাসি কোম্পানির তৈরি, হতে পারে রাফাল

পাকিস্তানে হামলায় ‘লোইটারিং মিউনিশনস’ ব্যবহারের দাবি ভারতের, এটি কীভাবে কাজ করে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত