Ajker Patrika

আন্দামানের যে দ্বীপে প্রবেশ নিষিদ্ধ

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৩, ১১: ৫৯
আন্দামানের যে দ্বীপে প্রবেশ নিষিদ্ধ

এই একুশ শতকে এটা হয়তো আপনার জন্য বিশ্বাস করা কঠিন, পৃথিবীতে এমন জনবসতিপূর্ণ দ্বীপও আছে, যেখানে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাইরের দুনিয়ার মানুষের পা পড়েনি। তাঁদের সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানাও নেই বিজ্ঞানী বা গবেষকদের। শুধু তাই নয়, সেখানে প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা আছে। 

আশ্চর্য এই দ্বীপের নাম নর্থ সেন্টিনেল আইল্যান্ড বা উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ। ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ এটি। এমনকি ভারতীয়দেরও দ্বীপটিতে পা রাখার কোনো উপায় নেই। 

এই দ্বীপে বাস করা আদিবাসীরা নিজেদের মতো থাকতেই পছন্দ করে। বাইরের মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়। যত দূর জানা যায়, ১৫০ জনের মতো আদিবাসীর বাস দ্বীপটিতে। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার যেমন কোনো উপায় নেই, তেমনি সুযোগ নেই একে অস্বীকার করারও। এমনকি গবেষকদেরও অনুমতি নেই দ্বীপটিতে প্রবেশের। 

দ্বীপটি এবং এর অধিবাসীরা যে আইনে সংরক্ষিত, সেটি হলো আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর আইল্যান্ডস প্রোটেকশন অব অ্যাবরিজিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট অব ১৯৫৬। এটা অনুসারে দ্বীপটিতে যেকোনো ধরনের ভ্রমণ নিষেধ। শুধু তাই নয়, এর পাঁচ নটিক্যাল মাইলের (৯.২৬ কিলোমিটার) মধ্যেও প্রবেশ করতে পারবেন না। 

সৈকতে দ্বীপবাসীরাদ্বীপবাসী বহিরাগতদের পছন্দ তো করেই না, কেউ দ্বীপে পা রাখলে শত্রু মনে করে দ্বীপ রক্ষায় তাকে প্রতিরোধ করে। গত কয়েক শ বছরে দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া সেই অর্থে বাইরের মানুষ প্রবেশ না করায় একজন মানুষ সাধারণত যে ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়, এগুলো প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা নেই তাদের শরীরে।

ভাবা যায়, এমন জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে এখনো যাদের গোটা পৃথিবীতে কী ঘটছে সে সম্পর্কেও তাঁদের ধারণা নেই! টিকটক, কোভিড—এসব বিষয় কী তা তারা জানে না। সেন্টিনেলের অধিবাসীরা আমাদের মতো একই পৃথিবীর বাসিন্দা হলেও এমন একটি জীবন যাপন করছে, যা আমাদের জন্য চিন্তা করাও কঠিন। 

তার মানে এই নয় যে এদের সম্পর্কে জানার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। আর এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যাই তৈরি করেছে। উনিশ শতকের দিকে ‘দ্বীপবাসীদের জানা’র প্রথম প্রচেষ্টাটি চালানো হয়। আর এটা এই আদিবাসীদের জন্য বড় এক দুর্বিপাক হয়েই দেখা দেয়। মোরিস ভিদাল পোর্টম্যান নামের এক ব্যক্তি এ সময় ছয়জন দ্বীপবাসীকে নিয়ে আসে তাদের একেবারে অপরিচিত এক জায়গায় (পোর্ট ব্লেয়ার)। দ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে বিষয়টি ছিল অপহরণের মতোই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আনার সঙ্গে সঙ্গে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে দুজন মারা যায়। বাকি চারজনকে দ্বীপে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারা মূল ভূমির মানুষের কোন রোগে আক্রান্ত হয় এটা জানা যায়নি।

অস্ত্র হাতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দ্বীপের একজন অধিবাসী

পরে দ্বীপে প্রবেশের এবং দ্বীপবাসীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আরও কয়েকটি চেষ্টা চালানো হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই প্রচণ্ড আক্রমণ করে সেন্টিনেলের অধিবাসীরা।মোদ্দা কথা, তাদের যে বাইরের পৃথিবী কিংবা এর বাসিন্দাদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই, তা জানিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেনি তারা।

তবে ১৯৯১ সালে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ওই সময়ে পরিচালক ত্রিলোকনাথ পণ্ডিত সহকর্মীদের নিয়ে প্রথম শান্তিপূর্ণ একটি সাক্ষাৎ করতে পারেন দ্বীপবাসীর সঙ্গে। অবশ্য তিনি প্রথমবার দ্বীপটির মাটিতে পা রেখেছিলেন আরও ২৪ বছর আগে, ১৯৬৭ সালে। তবে দ্বীপের বাসিন্দাদের সম্পর্কে জানার তেমন কোনো সুযোগ তাঁরা পাননি। কারণ বেশি সময় সেখানে থাকলে ওই সুসম্পর্ক থাকত না সেটা পরিষ্কার।

এমনিতে উত্তর ও দক্ষিণ সেন্টিনেল দ্বীপ পাখিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। তবে সেখানে কী ধরনের পাখির বাস, তা অজানাই রয়ে গেছে। এখানকার প্রবাল এলাকা, ম্যানগ্রোভ জঙ্গলও অচেনা বাইরের মানুষের কাছে।

তবে সবকিছু মিলিয়ে দ্বীপবাসী সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য জোগাড় করা গেছে। যদিও এর মধ্যেও ফাঁকফোকর আছে। তারা থাকে ঢালু ছাদের কুঁড়েতে। ত্রিলোকনাথ পণ্ডিত জানান, এভাবে পাশাপাশি বেশ কিছু কুঁড়ে তৈরি করে বাস করে তারা। একটা কুঁড়ের মুখোমুখি অন্য একটা কুঁড়ে থাকে। প্রতিটি কুঁড়ের সামনে সাবধানে আগুন জ্বালানো হয়।

তির-ধনুক হাতে উল্লাস

সরু, লম্বা ক্যানু তৈরি করে সেন্টিনেলের বাসিন্দারা। এই নৌকা দিয়ে তারা মাছ ধরে ও কাঁকড়া চাষ করে। তারা জঙ্গলে শিকার করে। যদি আন্দামানের অন্য অধিবাসীদের মতো হয়, তবে তারা বুনো ফল সংগ্রহ করে, গাঙচিল ও কচ্ছপের ডিম খায় বলে ধারণা করা হয়। তেমনি বুনো শূকর আর পাখি শিকার করে।

দ্বীপবাসী তির ও ধনুক ব্যবহার করে। বর্শা, ছুরিও আছে তাদের অস্ত্রের তালিকায়। এ ধরনের অনেক অস্ত্রেই লোহার ব্যবহার চোখে পড়ে। সম্ভবত এই লোহা পানির তোড়ে বা যেকোনোভাবে দ্বীপের তীরে এসে ভেড়ে। তারপর এগুলো সেন্টিনেলের লোকেরা কাজে লাগায়।

সেন্টিনেলের অধিবাসীরা ঝুড়ি তৈরি করে। ১৯৯০-এর দশকে জাহাজডুবির ঘটনায় দ্বীপের কাছাকাছি ভেড়া নাবিকেরা জানান, সৈকতে আগুন জ্বলতে দেখেছেন এবং দ্বীপের বাসিন্দাদের গান গাইতে শুনেছেন। তবে এখন পর্যন্ত ওখানকার ভাষা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এমনকি দ্বীপবাসী নিজেদের কী নামে পরিচয় করিয়ে দেয়, তা-ও জানা যায়নি।

পাখির চোখে দেখা। ছবি: ফেসবুক১৯৯৭ সালে দ্বীপে যেকোনো ধরনের ভ্রমণ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার পরও দুটি ঘটনা ঘটার সংবাদ পাওয়া যায়, যার পরিণতি ভালো হয়নি। ২০০৬ সালে দুজন জেলে দ্বীপে এসে মারা পড়েন। ২০১৮ সালে জন এলেন চাও নামে আমেরিকান এক নাগরিক দ্বীপে পা দিয়ে একই পরিণতির শিকার হন। এই তিনজনই অবৈধভাবে দ্বীপে ঢুকে সেন্টিনেলের বাসিন্দাদের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ দুই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধ এখন পর্যন্ত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হবেই বা কীভাবে? এমন কিছু মানুষ, যাদের কাছে নিজেদের দ্বীপের বাইরের কিছুর অস্তিত্ব নেই, তাদের আইন বা নিয়মকানুনের আওতায় আনবেনই বা কেমন করে?

বার্তাটা সহজ, সেন্টিনেলের বাসিন্দারা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। আর তাদের অবশ্যই নিজেদের মতো থাকার অধিকার আছে। আর যুক্তিও বলে, দ্বীপবাসীদের নিরুপদ্রব থাকতে দিলেই নিজেদের মতো ভালো থাকবে। 

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ফোর্বস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

বিবাহিতদের পুলিশ ক্যাডারে না নেওয়ার প্রস্তাব র‍্যাব ডিজির

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত