Ajker Patrika

তুমি ‘ছাগল’, তাই বলিয়া আমি ‘পাগল’ হইব না কেন?

অর্ণব সান্যাল
আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২২, ১১: ৫৩
তুমি ‘ছাগল’, তাই বলিয়া আমি ‘পাগল’ হইব না কেন?

অন্যে অধম হলেই যেমন উত্তম হওয়ার পথ ধ্বংস হয়ে যায় না, তেমনি ছাগল দেখে দেখে নিজেরা পাগল হয়ে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। এই পৃথিবীতে কত কিছুই না ঘটে! সুতরাং এ ক্ষেত্রে এবং এ দেশে অন্তত বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি হারিয়ে ফেলা অত্যাবশ্যক। তাতে যদি ছাগলের জন্য বিদেশে যাওয়ার মতো পাগলামি করা যায়, মন্দ কী! 

শুরুতেই কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রতি ক্ষমা চেয়ে নেওয়া যাক। তাঁর লেখা ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের একটি লাইন মেরে দিয়েই তো এই লেখার সূত্রপাত। ‘মেরে দেওয়া’ বাঙালির স্বভাবজাত। ফলে এই স্বভাব নিয়ে আসলে খেদ প্রকাশের তেমন কিছু নেই। আর অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিলে তো সবই হয়ে যায় দুধভাত। 

পাগল-ছাগলের কথা কেন এলো, এবার তার বিশদে যাই বরং। ছাগল নিয়ে ইদানীং দেশে আলোচনা হচ্ছে বেশ। আজকের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা স্থানীয় জাতের কালো ছাগলের বিষয়ে ‘উঁচু স্তরের অভিজ্ঞতা’ নিতে সরকারের ১৬ কর্মকর্তা যাবেন বিদেশ সফরে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর আর কোটি টাকা খরচ না হলে কি মান থাকে? তাই এই বিদেশ সফরের জন্য খরচা হবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। বিদেশে প্রশিক্ষণের এই কার্যক্রম নেওয়া হবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্পের’ আওতায়। শেষ দিকে থাকা এই প্রকল্পের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্রুত বিদেশ সফর করতে চান। 

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের কথায়, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বাংলাদেশের নিজস্ব জাত। এই অঞ্চলে পশুপালনের একেবারে শুরুর সময় থেকে এই ছাগল এখানে ছিল। দেশি এই ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে (জীবনরহস্য উন্মোচন) দেশের বিজ্ঞানীরা সফলতা পেয়েছেন বছর চারেক আগেই। দুই যুগ ধরে দেশে গবেষণাও চলছে এই ছাগলের ওপর। যেহেতু প্রকল্পের মূল কাজ দেশি ছাগলের জাত সংরক্ষণ, তাই দেশীয় পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনাই বেশি প্রয়োজন। এর জন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রকল্প পরিচালক বলছেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। 

অর্থাৎ, কথা দাঁড়াল যে, ছাগল দেশি হলেও জ্ঞানটা আসলে শুধু বিদেশেই আছে। সেই জ্ঞান নিতে আমাদের তাই বিদেশ যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

কর্মকর্তাদের নাকি বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ছাগলের দুধ-বাচ্চা উৎপাদনক্ষমতার জন্য জিন চিহ্নিত করা; ছাগলের টাইপ তৈরির কৌশল, অ্যাডভান্স ব্রিডিং ডেটা ম্যানেজমেন্ট কৌশল; প্রাণিপুষ্টিবিষয়ক আধুনিক ল্যাবরেটরি কলাকৌশল এবং ডিজিস রেজিস্ট্যান্ট জিন চিহ্নিত করার কৌশল বিষয়ে।

আচ্ছা, সেক্ষেত্রে দুয়েকটা ছাগলকেও কি বিদেশে নেওয়া উচিত নয়? যাদের দুধ আর বাচ্চা উৎপাদন নিয়ে এত্ত আয়োজন, তাঁদেরও তো বিদেশ সফরের সুখটা পাওয়া প্রয়োজন, নাকি? নইলে ছাগলের ওপর বেশ অবিচার হয়ে যায়! শেষে যদি এ দেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটেরা ধর্মঘট করে বসে? দুধ-বাচ্চা উৎপাদনে ‘না’ করে দেয়? রোগ প্রতিরোধে অনিচ্ছুক হয়ে ওঠে? তখন কিন্তু হাঙ্গামা হয়ে যাবে। 

তাই ছাগলকে দেখে নিজেরা পাগল হয়ে বিদেশে গেলেও আমাদের কিন্তু ‘তালে ঠিক’ থাকাটা প্রয়োজন। তবেই কিন্তু ছাগল আর পাগলের সহাবস্থান শান্তিপূর্ণ হবে। শান্তি বর্ষিত হবে ছাগল-পাগল উভয়ের মনে। আর দেশে শান্তি থাকলে সমৃদ্ধি তো আসবেই—এ আর নতুন কী! 

আপনারা প্রশ্ন তুলে বলতেই পারেন, ‘এমন পাগলের চেয়ে ছাগল শ্রেয়’। কিন্তু কথাটা আদতে সঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আপনাদের শোনাতে হবে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি গল্প। তাঁকে একদিন গ্রামের লোকেরা জিজ্ঞেস করল—‘আচ্ছা, চাঁদ উপকারী, নাকি সূর্য উপকারী?’ 

হোজ্জা উত্তর দিতে একদমই সময় নিলেন না। তৎক্ষণাৎ অবলীলায় বলে দিলেন, ‘চাঁদ উপকারী।’ 

যারা জিজ্ঞেস করেছিল তারাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, কারণ জানতে চাইল। হোজ্জাও ঘাবড়ে যাওয়ার মানুষ নন। তিনি জানালেন, ‘শোনো, দিনের বেলায় সূর্য যদি না-ও থাকে, তাহলেও আমাদের আলোর অভাব হয় না। কিন্তু রাতে যদি চাঁদ না থাকে, তাহলেই পৃথিবী অন্ধকার। বলো এবার, উপকারী তবে কে?’ 

এবার হোজ্জার যুক্তি অনুযায়ীই বলতে হয়, ছাগল যদি না-ও থাকে, গরু সেই দায়িত্ব নিতে পারবে। কিন্তু পাগলেরা না থাকলে গরু-ছাগলদের বিদেশ ঘুরিয়ে আনবে কে? কে? কে? কে?

সুতরাং মাথাব্যথা হলে মাথাই কেটে ফেলার বিধ্বংসী ভাবনা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতেই হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, ছাগলামি আর পাগলামি এক নয়। ছাগল যেমন আমাদের দেশের নিজস্ব জাতের, পাগলও তেমনি। এভাবেই একদিন কোটি টাকা পানিতে ভাসিয়ে বিদেশে ঘুরে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ছাগলে-পাগলে স্বয়ংপূর্ণ হবে দেশ—এই হোক আমাদের প্রত্যয়!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষের সামনে কর্মকর্তাদের অবস্থান

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত