Ajker Patrika

জেনারেশন জেড: আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে

ড. সুব্রত বোস
আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২১, ১৩: ০২
জেনারেশন জেড: আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে

এখন থেকে ১০ বা ১৫ বছর পরে যে মানুষগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দেবে,  তাঁরা কীভাবে চিন্তা করে?  কোন সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে, কীভাবে তার সমাধান খোঁজে? অপরিচিত, ভিনদেশিদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে কীভাবে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে? বৈশ্বিক সমস্যা সম্পর্কে এদের ধারণা কী? 
সম্প্রতি একটা সুযোগ হয়েছিল এসব যুবার কাছ থেকে দেখার।

লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ আর চীনের সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সেরা সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। শখানেক মেধাবী–অধিকাংশই পিএইচডি করছে, তবে মাস্টার্সেরও কিছু শিক্ষার্থী ছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে সেল এবং জিন থেরাপি নিয়ে কাজ করে এমন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অর্থনীতি বা গণিতের শিক্ষার্থীরাও শামিল।  উদ্দেশ্য এমন কিছু অ্যাপ বানানো,  যেগুলো মানুষকে সুস্থ থাকতে, ভালো থাকতে সহায়তা করবে। ভালো অ্যাপগুলো পুরস্কৃত হবে, অর্থমূল্য প্রায় ত্রিশ লাখ টাকার মতো। সেই সঙ্গে প্রত্যেক প্রতিযোগীকে ব্যবসা কীভাবে শুরু করতে হয়, উদ্ভাবন থেকে কীভাবে উৎপাদনে যাওয়া যায়, সমস্যা সমাধানে সৃজনশীলতার গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

দুই দশক ধরে সারা বিশ্বের বিভিন্ন বয়সের অদম্য মেধাবীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। মেধাবীদের সঙ্গে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো,  কোনো কাজই তখন আর একঘেয়ে লাগে না। তাই কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও আয়োজকদের অনুরোধে প্রতিযোগিতার বিচারক হতে এবং প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হলাম। সবকিছুই ভার্চুয়াল। প্রতিযোগীদের অধিকাংশই জেনারেশন জেড অর্থাৎ যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২। প্রতিযোগীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। আমাকে সময় দিতে বলা হলো।  লন্ডনে আমার যখন সকাল তখন প্রতিযোগীদের অনেকেরই মধ্যরাত। আমাকে বলা হলো,  টাইম জোন নিয়ে চিন্তা না করতে।  আমি সময় দিলেই তারা হাজির হবে।  একটু অবাক হলাম।

তবে কাজের প্রতি আগ্রহ দেখে ভালো লাগল। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বৈশ্বিক সমস্যা সম্পর্কে তাদের ধারণাগুলো শুনলাম। সমস্যা সম্পর্কে তাদের ধারণা বেশ চমৎকার। বিভিন্ন বিষয়ের খুঁটিনাটি তারা জেনে গেছে গবেষণার মাধ্যমে, মোটামুটি নির্ভুল। তথ্যের সঙ্গে, উপাত্ত নিয়ে এসেছে দারুণভাবে। আসলে এটাই তো খুবই স্বাভাবিক। জন্মের পর থেকেই তথ্যের অবাধ প্রবাহ এরা দেখে এসেছে। সত্য জানার জন্য এক নয়,  একাধিক তথ্যের ওপরে এরা ভরসা করেছে। সবচেয়ে অবাক হলাম, এরা সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে দারুণভাবে জানে। অর্থাৎ সীমিত সময়ে, সীমিত বাজেটে বড় সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সে কারণে সমস্যাকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে তার একটির সমাধান খোঁজাই বাস্তব।

পেশাগত জীবনে দেখছি, যে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে, সেই সমস্যাটিকে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সমস্যাকে নির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা গেলে তার সমাধান খুঁজে পাওয়াও অনেক সহজ হয়ে যায়। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এখনো দেখি অনেক পেশাদার লোক যে সমস্যার সমাধান দরকার, তা ঠিক করে বর্ণনা করতে পারেন না। যাই হোক, অংশগ্রহণকারীদের ধারণাগুলো শুনে,  আমি কিছু পরামর্শ দিলাম। আমি যখন পরামর্শ দিচ্ছিলাম,  প্রতিযোগীরা বিনীতভাবে আমাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করছিল। প্রশ্নগুলো অত্যন্ত যুক্তিসংগত। কোনো রকম কুণ্ঠাবোধ ছাড়াই প্রশ্ন করা, আজকের কর্মক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজন্ম, আসলে প্রশ্ন করতে একদমই কুণ্ঠাবোধ করে না। আমার যুক্তির পেছনে, কোনো তথ্য বা উপাত্ত আছে কি না, সেটা জানতে চাইছিল কোনো সংকোচ ছাড়াই।

আমাদের সমাজে এই প্রশ্ন করার অভ্যাসটাকে উৎসাহিত করা খুবই প্রয়োজন। শুরুটা বাড়ি থেকেই হওয়া উচিত। বিলেতে স্কুলে, শিশুদের শিক্ষককে প্রশ্ন করা উৎসাহিত করা হয়। কোনো শিশু স্কুলে প্রশ্ন করলে, এটাকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে ধরা হয়ে থাকে। এমনকি বাৎসরিক রিপোর্টে, এই প্রশ্ন করার প্রবণতা প্রশংসনীয়ভাবে উল্লেখ করা হয়। পাশ্চাত্যে কাজের জায়গায়, প্রশ্ন করার প্রবণতাকে নেতৃত্বদানের গুণাবলি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। আর যেসব ম্যানেজার তাঁদের অধীনস্থদের প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করেন, পুরস্কৃত করেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করার ভিড় লেগে যায়। তাঁদের অনুসারীসংখ্যা বাড়তে থাকে। 

যাই হোক, আমার মতো আরও অনেকের পরামর্শ এবং আরও কিছু গবেষণা করে, সব কটি দল মাত্র  ১০  দিনে যে অ্যাপগুলো তৈরি করল, এককথায় অভূতপূর্ব। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পেশা, একে অপরকে কখনোই দেখেনি;  কিন্তু লক্ষ্য এক। মাত্র ১০ দিনেই মোটামুটি একটা স্টার্টআপ কোম্পানি তৈরি। আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, জেনারেশন জেড বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী। নিজের এক পরিচয়ে এরা বেঁচে থাকতে চায় না। এরা পরিবর্তনশীল পরিচয়ে বিশ্বাসী।  অন্যের মতামতকে এরা অত্যন্ত সম্মান করে। অনায়াসে নিজের মতামত এরা পরিবর্তন করে, যদি কিনা পর্যাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত থাকে। এরা সংলাপে বিশ্বাসী।  সংলাপের মাধ্যমেই এরা সমস্যার সমাধান করতে চায়। সরাসরি সংঘর্ষে একদমই যেতে চায় না। অত্যন্ত বাস্তববাদী। এরা সমাজবদ্ধভাবে বাঁচতে বিশ্বাসী। এদের কাছে বাস্তবের বন্ধু আর অনলাইনের বন্ধুর কোনো পার্থক্য নেই। শর্ত একটাই–একই চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে। এরা পুরোপুরি বৈশ্বিক নাগরিক।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,  এই প্রজন্ম অত্যন্ত মেধাবী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং পরিশ্রমী। এরা অনেক বেশি বিশ্বনাগরিক। এক নই, একাধিক বিষয়ে এদের আগ্রহ এবং জ্ঞান রয়েছে। ন্যায় এবং সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় এদের বিশ্বাস। আমি আশাবাদী, বাংলাদেশে এই প্রজন্মকে সঠিক প্রশিক্ষণ, উৎসাহ এবং দিকনির্দেশনা দিতে পারলে, নিজের দেশের অর্থনীতিতে এরা একটি বড় অবদান রাখতে পারবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার এখনই সবচেয়ে ভালো সময়।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না জাবি শিক্ষক মৌমিতার

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত