Ajker Patrika

সিলেটের সাদা পাথর কাদের পেটে গেল, তাদের শক্তির উৎস কী

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০০: ০৫
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

লুটপাটের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবল। মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তিনি সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়েছিলেন সম্পদ লুণ্ঠনের অধিকার। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেশে রয়ে গেছে লুটেরা সিন্ডিকেট। গণমাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলদারত্বের খবর কমবেশি পাওয়া গেলেও সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর এসেছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা সোনাখ্যাত দেশের শীর্ষ পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জ থেকে। সাদা পাথরে অবাধে পাথর লুটপাট চলছে; যেন দেখার কেউ নেই। দিনদুপুরে অবাধে লুটপাটের কারণে বিলীন হওয়ার উপক্রম ওই পর্যটনেকন্দ্রটি। লুটপাটের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার রুবেল হোসেন। আজ মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক পেজে এক সংক্ষিপ্ত পোস্টে তিনি লুটপাট বন্ধ করে প্রকৃতি রক্ষার আহ্বান জানান। ফেসবুক পোস্টে রুবেল লিখেছেন, ‘সিলেটের সাদা পাথর নেই তো হারাবে সিলেটের সৌন্দর্যের গল্প। সাদা পাথর লুটেরাদের থামাও—প্রকৃতি লুট নয়, প্রকৃতি রক্ষা করুন।’

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে সাদা পাথরে শুরু হয় এই লুটপাট। পরে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর কারণে তা কিছুটা বন্ধ হয়। কিন্তু সুযোগ বুঝে অব্যাহত থাকে এই লুটপাট। বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ধলাই নদে অভিযান চালালেও বন্ধ হয়নি এই লুটপাট। এক সপ্তাহ লুটপাট হলে অভিযান হয় এক দিন আর ওই দিন বাদে অন্য ছয় দিনই চলে এই লুটপাট। যেদিকে পাথর কেনাবেচা হয় এবং গাড়ি বা বড় নৌকায় করে পাথর যায়, সেদিকে অভিযান না হওয়াতে এই লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না বলে দাবি করছেন এলাকাবাসী। আর এ কারণে এখন বিলীনের পথে রয়েছে সাদা পাথর।

সিলেটের পাথরের রাজ্যে এখন আর পাথর নেই। চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। এক বছর আগেও যেখানে ছিল পাথরের স্তূপ, সেখানে এখন ধু ধু মাঠ। দিনরাত শত শত নৌকা দিয়ে প্রকাশ্যে বালু-পাথর লুটপাট হলেও প্রশাসন ছিল নির্বিকার। একাধিকবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

জানা গেছে, সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ধ্বংসের নেপথ্যে রয়েছে এক অদ্ভুত ও বিপজ্জনক সর্বদলীয় ঐক্য—বিএনপি, জামায়াত, স্থানীয় প্রভাবশালী, লুটেরা সিন্ডিকেট ও কিছু তথাকথিত আন্দোলনকর্মীর যৌথ সমঝোতা। প্রকাশ্যে ও দিনের আলোয় শত শত নৌকা ভরে পাথর-বালু তুলে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন নীরব দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন এই অবৈধ কর্মকাণ্ড কোনো গোপন অপরাধ নয়, বরং প্রকাশ্য ও অনুমোদিত ব্যবসা।

এই লুটপাটের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নতুন নয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত ছিল আওয়ামী ঘরানার দুর্বৃত্তরা। সরকার বদলের পর সিলেটের অন্যান্য পাথর কোয়ারির মতো সাদা পাথর লুট শুরু করে নতুন লুটেরা দল। দেখা যায়, স্থানীয় বিএনপি-যুবদল নেতারা নেতৃত্বে থাকলেও তাঁদের পেছনে রয়েছে জামায়াত ও বিভিন্ন সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সমন্বয়কারীর নেপথ্য ভূমিকা। এই ‘পাথরখেকো ঐক্য’ আসলে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর আর্থিক উৎসের নতুন ভরসা হয়ে উঠেছে; যেখানে রাজনৈতিক ব্যানার ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক—সম্পদ লুটে অর্থ সংগ্রহ।

এর আগে এই একই গোষ্ঠী সাহস করে সিলেটের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের ঘেরাও করেছিল। প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, আইনগত পদক্ষেপ ব্যাহত করা এবং মাঠপর্যায়ের অভিযান ভেস্তে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। এই সাহস ও শক্তির উৎস মূলত আসে দুই জায়গা থেকে। প্রথমত, ৫ আগস্ট-পরবর্তী প্রশাসনিক শূন্যতা ও আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার দুর্বলতা; দ্বিতীয়ত, স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আঁতাত। যখন আইন প্রয়োগকারীরা নিজেরাই রাজনৈতিক সংকেতের অপেক্ষায় থাকে, তখন লুটেরা চক্রের জন্য ভোলাগঞ্জ হয়ে ওঠে ‘নিরাপদ খনি খাত’।

তাদের কার্যপদ্ধতিও পরিকল্পিত—দিনে ছোট নৌকা, রাতে বড় স্টিল বডির জাহাজ দিয়ে পাথর তোলা; স্থানীয় ও বহিরাগত হাজারো শ্রমিক ভাড়া করে নিয়মিত পরিবহন আর পাথরের পাইকারি বাজারে দ্রুত বিক্রি করে অর্থ তুলে ফেলা। যাঁরা মাঠে কাজ করেন, তাঁদের বড় অংশই দৈনিক আয়ের জন্য এ কাজে যুক্ত, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের হাতে। এই অর্থের একটি অংশ দলীয় তহবিলে, অন্য অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীদের পকেটে যায়।

ফলে সাদা পাথর আজ শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নির্মম প্রতিচ্ছবি, যেখানে বিরোধী দল ও ক্ষমতার বাইরে থাকা শক্তিগুলোও নিজেদের স্বার্থে সম্পদ লুণ্ঠনে যুক্ত হতে দ্বিধা করে না। উপদেষ্টাদের ঘেরাও করার মতো দুঃসাহস, সীমান্তবর্তী এলাকায় সেনা ও বিজিবির উপস্থিতির মধ্যেও খোলাখুলি লুট চালানোর মতো শক্তি—এসবই এসেছে রাজনৈতিক মদদ, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও লুটের অর্থে পোষা গুপ্ত শক্তির মেলবন্ধন থেকে। যদি এই ঐক্য ভাঙা না যায়, তবে সাদা পাথর শুধু ইতিহাসের পাতা আর পুরোনো ছবিতেই থাকবে, বাস্তবে নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিসিএসে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর নিয়ে প্রশ্ন, নেই মুক্তিযুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, নিহত ও নিখোঁজ বহু

স্বামীকে হত্যার পর ইয়াবা সেবন করে লাশ টুকরো করেন স্ত্রী ও প্রেমিক

ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে বাংলাদেশমুখী এলপিজির জাহাজ

সমুদ্রের নিচে উদ্বেগজনক কিছু নজরে এল বিজ্ঞানীদের

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত