অরুণাভ পোদ্দার
আমার প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ট্রেনে চড়া হয়। গত মার্চে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়ার পর এখন আর ঢাকা-চট্টগ্রাম; ঢাকা-সিলেটের ট্রেনগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থামে না। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। দুর্জনেরা বলে, রেল কর্তৃপক্ষ নাকি ইচ্ছে করে স্টেশন মেরামতে দেরি করছে, জেলাবাসীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সত্য-মিথ্যা জানি না, কিন্তু দুর্ভোগ যে চরমে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে কোথাও যেতে বা আসতে গেলে আশুগঞ্জ, ভৈরব, আজমপুর, আখাউড়া এসব জায়গা থেকে ট্রেনে উঠতে বা নামতে হয়। আমিও তাই সিলেটের ট্রেনে ঢাকা গেলে আজমপুর থেকে উঠি। ছোটখাটো ছিমছাম মফস্বল স্টেশন। ছায়া সুনিবিড় একটা পরিবেশ। স্টেশনের পাশেই আম, জাম, কাঁঠালগাছ। গত গ্রীষ্মে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময় দেখেছি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গাছ থেকে ফল পেড়ে বিক্রি করতে। একেবারে ফরমালিনমুক্ত।
সেদিন প্রায় মাস দেড়েক পর পূজার ছুটিতে ঢাকা আসছি। দেখলাম স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম ভেঙে সংস্কার হচ্ছে। তাই কিছুটা বিশৃঙ্খলা। ট্রেন আসতে দেরি। প্ল্যাটফর্মের একেবারে সামনের দিকের একটা চা-স্টলের সামনের বেঞ্চিতে বসে সময় পার করছি। দোকানের গান শোনার যন্ত্রে উচ্চ স্বরে গান ভেসে আসছে, ‘ও পরানের বন্ধু রে তুই কেন আমায় গেলি ছাড়িয়া...’। এরপর কবিয়াল গান চলছে, দেহতত্ত্বের গান। মাটির গন্ধমাখা গান, সোঁদা মাটির গন্ধ পাচ্ছি যেন। আমার আশপাশে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজ করছেন। কেউ কাজের ফাঁকে প্রচণ্ড গরমে চা ও সস্তা শিঙাড়া, বড়া খাচ্ছেন। কেউ গুনগুন করে গানের কলিও ভাঁজছেন। ভদ্দরলোকের সমাজে এই গানগুলো খুব একটা প্রচলিত নয়, সমাদৃতও নয়। একজনকে দেখলাম কাজ ফাঁকি দিয়ে গানের সিডির মোড়কের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে, হয়তো তাঁর বাড়িতে প্রিয়জনকে ফেলে এসেছেন, যে তাঁর জন্য অপেক্ষায়। দোকানের যে রাঁধুনি তাঁকে দেখা যাচ্ছে কড়াইয়ে গরম তেলে শিঙাড়া নাড়া দিচ্ছেন আর গানের তালে দুলছেন। হঠাৎ গান থেমে গেল। কেউ কেউ ভেবেছেন মালিক হয়তো গান বন্ধ করে দিয়েছেন। ‘এই মিয়া, এইডা একটা কাণ্ড করলায়নি, গানটা বন্ধ করি দিলা!’ মালিকও বলে উঠলেন, ‘আরে মিয়া, আমি কিতা করলাম, বিদ্যুৎ চলি গেছে।’
এই প্রান্তিক মানুষেরা কাজের ফাঁকের বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত। আর আমাদের মতো শহুরে ভদ্দরলোকেরা ভেবেই নিয়েছেন পুরো বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পরে পড়ছে। গান, বাজনা সব একদিন উঠে যাবে। তাঁদের জন্য কিন্তু এটা একটা বার্তা। প্রান্তিক মানুষদের মনস্তত্ত্ব আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। তাঁদের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। তাঁদের মননে এখনো জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিয়াল গানের সুর। মনে রাখতে হবে একাত্তরে দেশটা স্বাধীন করেছিলেন কিন্তু এঁরাই। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকেরা হাতে অস্ত্র নিয়েছিলেন বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ। তারপর তাঁরা ফিরে গেলেন মাঠে, ঘাটে, কলকারখানায়। আমরা ব্যস্ত রইলাম রাজনীতি আর ক্ষমতার নোংরা খেলায়। ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। মুখে মুখে শুধু আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে চিৎকার করলে তো আর দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা তাঁদের অনেকটা জেনে-বুঝেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে ঠেলে দিচ্ছি না তো? শুধু শহুরে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের জন্য সংস্কৃতিচর্চা দেশের মধ্যে এক বিশাল সাংস্কৃতিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যার ফাঁক দিয়ে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি।
এঁদের আবার ফিরিয়ে আনতে হবে গানে, যাত্রাপালায়, মেলায়। তা হলেই–
‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা
অঘ্রানে নবান্নের উৎসবে
সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়
বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’
আমার প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ট্রেনে চড়া হয়। গত মার্চে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশন পুড়িয়ে দেওয়ার পর এখন আর ঢাকা-চট্টগ্রাম; ঢাকা-সিলেটের ট্রেনগুলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থামে না। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। দুর্জনেরা বলে, রেল কর্তৃপক্ষ নাকি ইচ্ছে করে স্টেশন মেরামতে দেরি করছে, জেলাবাসীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। সত্য-মিথ্যা জানি না, কিন্তু দুর্ভোগ যে চরমে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ট্রেনে কোথাও যেতে বা আসতে গেলে আশুগঞ্জ, ভৈরব, আজমপুর, আখাউড়া এসব জায়গা থেকে ট্রেনে উঠতে বা নামতে হয়। আমিও তাই সিলেটের ট্রেনে ঢাকা গেলে আজমপুর থেকে উঠি। ছোটখাটো ছিমছাম মফস্বল স্টেশন। ছায়া সুনিবিড় একটা পরিবেশ। স্টেশনের পাশেই আম, জাম, কাঁঠালগাছ। গত গ্রীষ্মে স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময় দেখেছি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের গাছ থেকে ফল পেড়ে বিক্রি করতে। একেবারে ফরমালিনমুক্ত।
সেদিন প্রায় মাস দেড়েক পর পূজার ছুটিতে ঢাকা আসছি। দেখলাম স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম ভেঙে সংস্কার হচ্ছে। তাই কিছুটা বিশৃঙ্খলা। ট্রেন আসতে দেরি। প্ল্যাটফর্মের একেবারে সামনের দিকের একটা চা-স্টলের সামনের বেঞ্চিতে বসে সময় পার করছি। দোকানের গান শোনার যন্ত্রে উচ্চ স্বরে গান ভেসে আসছে, ‘ও পরানের বন্ধু রে তুই কেন আমায় গেলি ছাড়িয়া...’। এরপর কবিয়াল গান চলছে, দেহতত্ত্বের গান। মাটির গন্ধমাখা গান, সোঁদা মাটির গন্ধ পাচ্ছি যেন। আমার আশপাশে পরিযায়ী শ্রমিকেরা কাজ করছেন। কেউ কাজের ফাঁকে প্রচণ্ড গরমে চা ও সস্তা শিঙাড়া, বড়া খাচ্ছেন। কেউ গুনগুন করে গানের কলিও ভাঁজছেন। ভদ্দরলোকের সমাজে এই গানগুলো খুব একটা প্রচলিত নয়, সমাদৃতও নয়। একজনকে দেখলাম কাজ ফাঁকি দিয়ে গানের সিডির মোড়কের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে, হয়তো তাঁর বাড়িতে প্রিয়জনকে ফেলে এসেছেন, যে তাঁর জন্য অপেক্ষায়। দোকানের যে রাঁধুনি তাঁকে দেখা যাচ্ছে কড়াইয়ে গরম তেলে শিঙাড়া নাড়া দিচ্ছেন আর গানের তালে দুলছেন। হঠাৎ গান থেমে গেল। কেউ কেউ ভেবেছেন মালিক হয়তো গান বন্ধ করে দিয়েছেন। ‘এই মিয়া, এইডা একটা কাণ্ড করলায়নি, গানটা বন্ধ করি দিলা!’ মালিকও বলে উঠলেন, ‘আরে মিয়া, আমি কিতা করলাম, বিদ্যুৎ চলি গেছে।’
এই প্রান্তিক মানুষেরা কাজের ফাঁকের বিনোদনে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত। আর আমাদের মতো শহুরে ভদ্দরলোকেরা ভেবেই নিয়েছেন পুরো বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পরে পড়ছে। গান, বাজনা সব একদিন উঠে যাবে। তাঁদের জন্য কিন্তু এটা একটা বার্তা। প্রান্তিক মানুষদের মনস্তত্ত্ব আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। তাঁদের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে। তাঁদের মননে এখনো জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিয়াল গানের সুর। মনে রাখতে হবে একাত্তরে দেশটা স্বাধীন করেছিলেন কিন্তু এঁরাই। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকেরা হাতে অস্ত্র নিয়েছিলেন বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ। তারপর তাঁরা ফিরে গেলেন মাঠে, ঘাটে, কলকারখানায়। আমরা ব্যস্ত রইলাম রাজনীতি আর ক্ষমতার নোংরা খেলায়। ফলাফল দেখতে পাচ্ছি। মুখে মুখে শুধু আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক’ ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে চিৎকার করলে তো আর দেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আমরা তাঁদের অনেকটা জেনে-বুঝেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে ঠেলে দিচ্ছি না তো? শুধু শহুরে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের জন্য সংস্কৃতিচর্চা দেশের মধ্যে এক বিশাল সাংস্কৃতিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যার ফাঁক দিয়ে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তি।
এঁদের আবার ফিরিয়ে আনতে হবে গানে, যাত্রাপালায়, মেলায়। তা হলেই–
‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা
অঘ্রানে নবান্নের উৎসবে
সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায়
বিশ্ব অবাক চেয়ে রবে।’
গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে আঙুর চাষের চেষ্টা চলেছে। দেশের মাটিতে আঙুরের ফলন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাদ ছিল বেজায় টক। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তখনো জানত না আঙুরগাছ দেখতে কেমন।
১০ ঘণ্টা আগেমে মাসে সূর্য যেন শুধু তাপ নয়, আগুন ছড়াচ্ছে। আকাশ থেকে যেন নেমে এসেছে মাথার ওপর, ওপর থেকে ঢুকে গেছে, যাচ্ছে ভেতরে। শহরের রাস্তায় আগুনের মতো উত্তাপ, গ্রামগঞ্জে পানির জন্য হাহাকার।
১০ ঘণ্টা আগেউপকূলীয় এলাকায় জেগে ওঠা চরাঞ্চলে ১৯৬৫ সাল থেকে বন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাকে প্যারাবন বলা হয়। বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর এবং কক্সবাজার জেলায় এই প্যারাবন গড়ে উঠেছে। প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর ভূমিতে এই বন তৈরি করা হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেকুড়িগ্রামের উলিপুরের একটি গ্রামে সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রচলিত বিচারব্যবস্থা ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোই বটে। একই সঙ্গে আমাদের গ্রামীণ সমাজকাঠামোতে যে এখনো গ্রাম্য মাতবরদের দৌরাত্ম্য আছে, সেটা স্পষ্ট হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে