Ajker Patrika

মেধাবীদের ফেরানোর উদ‍্যোগ নিতে হবে

ড. রউফুল আলম
মেধাবীদের ফেরানোর উদ‍্যোগ নিতে হবে

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও চীনের গবেষণা এতটা উন্নত ছিল না। এতটা বহুমুখী ও বৈচিত্র‍্যময় ছিল না। ইউরোপ-আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো মান ছিল না। কিন্তু আজ তাদের গবেষণা অনেক উন্নত। বৈশ্বিক মানদণ্ডে প্রথম সারির। দুনিয়ার যত বড় বড় সায়েন্টিফিক জার্নাল আছে, সেগুলোয় ৩০-৪০ শতাংশ আর্টিকেল জমা পড়ে শুধু চীন থেকেই। তাহলে কী করে ঘটেছে এই বিপ্লব?

চীনের বিপুলসংখ‍্যক শিক্ষার্থী নব্বইয়ের দশক থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় ছড়িয়েছেন। সরকার নিজের অর্থায়নেও অনেক নবীন-প্রবীণ গবেষককে বিদেশে পাঠিয়েছে। এসব গবেষক সারা দুনিয়া থেকে শিখেছেন। নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। সরকার তখন তাঁদের একটা অংশকে ফিরিয়ে নেওয়ার একটা কার্যকর প্রকল্প চালু করেছে। সেই প্রকল্পের নাম ‘সহস্র মেধাবী প্রকল্প’ বা থাউজেন্ড ট্যালেন্ট প্ল‍্যান।

প্রতিবছর চীন সরকার সহস্রাধিক ব্রিলিয়ান্ট তরুণকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই তরুণদের পিএইচডি থাকে, পোস্টডক গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকে। ভালো মানের পাবলিকেশন থাকে। খ‍্যাতনামা গবেষকদের অধীন কাজের অভিজ্ঞতা থাকে। অ্যাস্ট্রোফিজিকস, বায়োকেমেস্ট্রি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজেন্সি, কম্পিউটার সায়েন্স, রোবটিক ইঞ্জিনিয়ারিং—এমন বহু ক্ষেত্রে খুব মেধাবী তরুণদের বাছাই করে নিয়োগ দেয় সরকার। সেসব তরুণ গবেষককে ভালো বেতন দেয়, আবাসনের সুবিধা দেয়। গবেষণার জন‍্য অনেক অর্থের ফান্ড দেয়।

ফলে দেখা গেছে, গত এক যুগে সারা দুনিয়া থেকে সেরা সেরা তরুণ চীনে ফিরে গেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই চায়নিজ তরুণ, তবে চীন সরকার অন‍্যান‍্য জাতীয়তার মেধাবীদেরও উৎসাহিত করছে। যে তরুণ নিজের প্রচেষ্টায়, নিজের মেধায় সারা দুনিয়া থেকে শিখলেন, বিশ্বের সেরা সেরা ইউনিভার্সিটিতে কাজ করে দক্ষ হলেন, সেই সব তরুণকে সরকার একটা কার্যকর প্রকল্পের মাধ‍্যমে পেয়ে যাচ্ছে। সহস্র মেধাবী প্রকল্প ছাড়াও চীনের রাজ‍্যগুলোয় ট‍্যালেন্ট হান্ট প্রকল্প থাকে। এতে চীন সরকার প্রতিবছর ব্রেইন গেইন করছে। সহস্র মেধাবী প্রকল্পের মাধ‍্যমে চীন যেসব তরুণকে ফিরিয়ে নেয়, তাঁদের বেশির ভাগেরই বয়স থাকে ৩০-৩৫-এর মধ‍্যে। এই তরুণেরা একটা সমাজকে রাতারাতি বদলে দিতে পারেন। আর সেটার ফলাফল চীনে এখন দৃশ‍্যমান। গবেষণার এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেটিতে চীনের সাফল‍্য নেই।

আমরা যখন শুধু ব্রেইন ড্রেইন নিয়ে চিন্তা করছি, চীন সরকার তখন প্রতিবছর সহস্র ব্রেইন গেইন করছে। একই প্রক্রিয়া দক্ষিণ কোরিয়া করেছে। একসময় জাপান করেছে। এখন ভারত করছে। উন্নত দেশগুলো মেধাবী স্টুডেন্টদের লুফে নেওয়ার জন‍্য বসে থাকে। আমেরিকা সম্ভবত সারা দুনিয়ায় এ বিষয়ে সবচেয়ে এগিয়ে। এ জন‍্যই আমেরিকার নাম হয়েছে ‘দ্য ল‍্যান্ড অব অপরচুনিটি’।

দক্ষিণ কোরিয়া জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ অর্থ খরচ করে রিসার্চ অ্যান্ড ডিভেলপমেন্টের জ‍ন‍্য। শুধু যে অধিক টাকা খরচ করে তা-ই নয়, সেই টাকাটা তুলে দেয় সবচেয়ে যোগ‍্য মানুষটির হাতে। গবেষণার জন‍্য দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ—অর্থ এবং মেধা। যদি যত্রতত্র প্রচুর অর্থ খরচ করা হয়, তাহলে সবকিছু নিষ্ফল হবে। সঠিক গবেষক বাছাইয়ের এই প্রক্রিয়াটার জন‍্য থাকতে হয় এক্সপার্ট কমিটি। সেসব কমিটিতে বিদেশি এক্সপার্টদেরও রাখা হয়। এতে করে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং যাচাই-বাছাইটা হয় সঠিক। আমাদের দেশে এখনো সবকিছুতেই আমলাতন্ত্রের একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া থাকে। যেটা সব সময় ভালো ফল বয়ে আনে না। এ বিষয়টুকু উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

আমাদের অসংখ‍্য তরুণ আছেন। তাঁদের ভেতর অদম‍্য স্পৃহা আছে। তাঁদের আছে পৃথিবী থেকে শেখার নেশা। তাঁরা ছুটছেন নিজের প্রচেষ্টায়। প্রতিবছর দেশ থেকে বহু স্টুডেন্ট সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা গবেষণা করছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। নিজেদের চেষ্টা ও মেধায় তাঁরা দক্ষ হয়ে উঠছেন। এই যে স্রোত, এই যে জোয়ার—এটা আরও বাড়াতে হবে। উন্নত বিশ্ব থেকে আমাদের তরুণদের জ্ঞান-গবেষণা নিতেই হবে। আর এ জন‍্য সরকারের দরকার সহযোগিতা।

সরকারকে বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোয় গবেষণা জোরদার করতে হবে; যাতে করে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্সে স্টুডেন্টরা ভালো গবেষণা করতে পারেন। তাহলে আরও অধিকসংখ‍্যক স্টুডেন্ট বিশ্ব প্রতিযোগিতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন। পাশাপাশি আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, সরকারকে একটা শক্তিশালী পরিকল্পনার মাধ‍্যমে বিদেশ থেকে মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ‍্যোগ নিতে হবে। প্রক্রিয়াটিতে থাকতে হবে কঠোর প্রতিযোগিতা। এ কাজটা যদি মাত্র তিন দশকও আমরা করতে পারি, তাহলে কয়েক হাজার দক্ষ তরুণ বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব। তাঁদের হাত দিয়ে গড়ে উঠবে গবেষণার এক বিশ্বমানের সংস্কৃতি। কী করে দেশেই বিশ্বমানের পিএইচডি ও পোস্টডক গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। আর এর মধ‍্য দিয়ে দেশের বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলো আরও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠবে। সেসব ক‍্যাম্পাসে অন‍্যান‍্য দেশের স্টুডেন্টরাও কাজ করতে আসবেন।

ব্রেইন ড্রেইনের কথা না বলে, আমাদের ব্রেইন গেইনের পরিকল্পনা করতে হবে। দেশের অনেক তরুণ-তরুণী বিদেশে পড়াশোনা ও গবেষণা শেষে দেশে ফিরতে চান। কিন্তু তাঁরা ফেরার জন‍্য সেই সুযোগ, পরিবেশ বা সাহস পান না। রাষ্ট্রকে সেই সুযোগটা তৈরি করে দিয়ে তাঁদের ফেরার ইচ্ছা ও পথকে সহজ করে দিতে হবে। তাহলে তাঁরা দেশে গিয়ে বিপুল উদ‍্যমে কাজ করতে পারবেন। তাঁরা যেন কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে, কর্মস্পৃহায় ভাটা না পড়ে, সে বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে। কারণ এই তরুণেরা যখন সাত-আট বছর বিদেশে কাটান, তাঁদের সেসব জটিলতায় পড়তে হয় না। তাঁরা সে বিষয়গুলোতে অনভ‍্যস্ত থাকেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষক নিয়োগের সময় পিএইচডি ডিগ্রি থাকা শিক্ষার্থীদের প্রাধান‍্যই দেওয়া হয়নি; বরং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে করে একজন বিদেশফেরত শিক্ষার্থীকে নিরুৎসাহিতই করা হয়। দেশের গবেষণাকেন্দ্রগুলোয়ও সরাসরি পিএইচডি ডিগ্রি থাকা প্রার্থীদের নিয়োগে প্রাধ‍ান‍্য দেওয়া উচিত। গবেষণার অভিজ্ঞতা ছাড়া বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগটাই যুগোপযোগী নয়।

বাংলাদেশ যদি বিশ্বমানের তরুণ গড়তে চায়, বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের আদলে গড়তে চায়, তাহলে ব্রেইন গেইন একটা অন‍্যতম উদ‍্যোগ। মেধাবী তরুণদের দেশে ফেরানোর উদ‍্যোগ নিতেই হবে। এটা আজ হোক কাল হোক, করতেই হবে। তবে যত দ্রুত করা যায়, 
ততই মঙ্গল। 

লেখক: সিনিয়র সায়েন্টিস্ট, পিটিসি থেরাপিউটিকস, নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেঘমল্লারের জবাবের পর ডাকসু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যা লিখলেন শশী থারুর

সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ডে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করবেন যেভাবে

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইলেন ফখরুল

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না জাবি শিক্ষক মৌমিতার

অনিয়মের অভিযোগ এনে জাকসু নির্বাচন কমিশন সদস্যের পদত্যাগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত