Ajker Patrika

রবীন্দ্রজয়ন্তী

আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়

জাহীদ রেজা নূর
যে সমাজটা নিজে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, সে সমাজের কথাই তিনি বলেছেন। ছবি: সংগৃহীত
যে সমাজটা নিজে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, সে সমাজের কথাই তিনি বলেছেন। ছবি: সংগৃহীত

আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। বাংলাভাষী মানুষের পরম সৌভাগ্য, বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির রুচি নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের তুলনা কি আর আছে? শিল্প-সাহিত্যে আমাদের যেটুকু অর্জন, তার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নাম সর্বোচ্চ শিখরে। তাঁকে গ্রহণ করার জন্য যে মন ও রুচি লাগে, তা অনেক সময়ই অনেকের মধ্যে তৈরি হয় না, ফলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অকারণ বিতর্ক তুলে মজা পায় একশ্রেণির মানুষ।

দুদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ মার খেয়েছেন। একদিকে রয়েছে রবীন্দ্রবিদ্বেষী অংশ, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথে অন্ধবিশ্বাসীর দল। দুদিকে বিভক্ত দুই দলের একদল রবীন্দ্রনাথকে দানবরূপে দেখাতে চাইছে, অন্য দল তাঁকে বানাতে চাইছে পয়গম্বর। এই টানাপোড়েনে বাংলা সাহিত্যের সেরা মানুষটি হচ্ছেন ক্ষতবিক্ষত। সাহিত্যে যাঁদের অনুরাগ, তাঁরা জানেন, জীবনভর সাহিত্যেই সমর্পিত থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ, আর অন্য যে কাজগুলো করেছেন, সেগুলোও শৈল্পিক হয়ে উঠেছে তাঁর বিশাল পর্যবেক্ষণ শক্তির সহজ অনুবাদে।

কথাগুলো বলছি এ রকম এক সময়ে, যখন ইতিহাস নিয়েও নানা নতুন বয়ান তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্ক তো আজকের নয়। বাঙালি মুসলমান বহুদিন ধরে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করবে কি করবে না, তা নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মুসলমানকে জয় করতে পারলেন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বাঙালি মুসলমানের আগ্রহ জেগে ওঠার কারণে। ভাষা আন্দোলন তাতে জলসিঞ্চন করেছিল।

পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালি মুসলমানের ছিল প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহের পেছনে বৈষয়িক কারণটাই ছিল মুখ্য। হিন্দু জমিদারেরা এই অঞ্চল থেকে চলে গেলে বাঙালি মুসলমানের হাতে আসবে অর্থনৈতিক শক্তি—এই ছিল মূল বিষয়। ধর্মীয় সাদৃশ্য পরের ব্যাপার। অর্থনৈতিক ভাবনা থেকেই মূলত বাঙালি মুসলমান পাকিস্তানের কাছে নিজেদের সমর্পিত করেছিল একটা অযৌক্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে। মুসলমান মাত্রেই যে ভাই-ভাই নয়, বরং রাজনৈতিক পাশাখেলায় শাসক-শোষক হওয়ার জন্য ধর্ম-বর্ণ-জাতি পরিচয় যে কোনো ব্যাপার নয়, এ কথা বোঝার জন্য বাঙালিকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বাঙালি মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তান নামক তার ভাই-বেরাদারদের কাছ থেকে ইংরেজদের মতো একই রকম আচরণ পাওয়া শুরু করার পর পরই সেটা বুঝতে পেরেছিল। এই জায়গায় এসেই ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে আগ্রহ জন্মেছিল সামগ্রিকভাবে এই পূর্ববঙ্গে, তাতেই যেন জীবিত হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

২. বিস্ময়কর সত্য হলো, রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া সাহিত্যিক বলে অগ্রাহ্য করেছিল সাম্যবাদীরাও। সাম্যবাদীরা নেতাকে মান্য করে। যদি সোভিয়েত বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন লিয়েফ তলস্তোয়কে ‘রুশ বিপ্লবের আয়না’ না বলতেন, তাহলে কমিউনিস্ট ধ্যান-ধারণায় নিমজ্জিত এলিটরা কবেই তলস্তোয়কে বুর্জোয়া হিসেবে নিক্ষেপ করতেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে! লেনিন বাঁচিয়ে দিলেন রুশ সাহিত্যের অন্যতম সেরা লেখককে। এবং তাতে রুশ সাহিত্যও বেঁচে গেল। বেঁচে গেলেন পুশকিন, লেরমন্তভ, গোগল, দস্তইয়েফস্কি, তলস্তোয়, চেখভ। বিপ্লবের আগে তাঁদের জন্ম, বিপ্লবের আগেই তাঁরা মারা গেছেন। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে তাঁরা যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তাঁকে কি ফেলে দিতে পারতেন সমাজবিপ্লবের নেতা লেনিন?

রবীন্দ্রনাথের সে সৌভাগ্য হয়নি। বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের দ্বন্দ্বের সরাসরি বলি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যদিও ধর্ম নিয়ে নিজের অবস্থান বারে বারে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানরা যে যার মতো করে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছে অথবা গ্রহণ করেনি। মুসলমানদের বোঝানো হয়েছে, ভিন্নধর্মী একজন লেখককে তারা নিজেদের লেখক বলে মনে করবে কেন?

অনেকে দাবি করেছেন, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে তো মুসলিমরা প্রায় উঠে আসেনি। যাঁরা এসব কথা বলেন, তাঁরা মোটেই ভাবেন না, যে সমাজটা নিজে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, সে সমাজের কথাই তিনি বলেছেন। যে বিষয়ে জানেন না, সে বিষয়ে কখনো কথা বলেননি। ইসলাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক পর্যবেক্ষণ আছে, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিয়ে রয়েছে তাঁর ভাবনার প্রকাশ, এগুলো নিবিড়ভাবে দেখলে বোঝা যাবে, সংকটটাকে কতটা নির্মোহভাবে দেখেছেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গে বসবাসের দিনগুলোকেও দেখতে হবে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে। খেয়াল রাখতে হবে তাঁর সেরা ছোটগল্পগুলোর বেশির ভাগই লেখা হয়েছে এই অঞ্চলে বসবাসের সময়। ভালো কবিতাগুলোও।

সাম্যবাদীদের ভাবনা সোভিয়েত কেউকেটা ঝ্দানভের তৈরি করা সংস্কৃতির বয়ানে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল যে মার্ক্সীয় সাহিত্য ছাড়া আর কোনো সাহিত্যকে জীবনে ঠাঁই দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সামন্ত বা বুর্জোয়া বলে সাহিত্যিকদের গায়ে তকমা এঁটে দেওয়া শুরু হয়েছিল। এই অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরের সাহিত্যাঙ্গনেও। আমাদের প্রগতি লেখক সংঘ কিংবা গণনাট্য সংঘও তা থেকে রেহাই পায়নি। সে রকম এক কট্টর সাহিত্য দর্শনে রবীন্দ্রনাথ যে অবহেলিতই থাকবেন, কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে, তিনি যে অপমানিত হবেন, সেটা নতুন করে বলে দিতে হয় না। সামগ্রিক বিবেচনায় ধর্ম এবং রাজনীতি—এই দুই জায়গা থেকেই বেদম মার খেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

৩. তখনকার মার্ক্সবাদী নন্দনতত্ত্বের থাপ্পড়ে রবীন্দ্রনাথের দশা কী হয়েছিল, তার একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া দরকার। ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’ রবীন্দ্রনাথের শরতের গান। সে গানটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এভাবে—গানে উল্লিখিত নৌকাটি হচ্ছে সামন্ততন্ত্র। পাল হলো ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা, নরম ও উদারপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের হাওয়া সেই পালকে মন্দ মধুর দোলা দিচ্ছে। ঠিক আছে, এটা না হয় কোনোভাবে মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু তারপর? পরের লাইনটার অর্থ কী করা হচ্ছে? ‘দেখি নাই কভু দেখি নাই, এমন তরণী বাওয়া।’ এর ব্যাখ্যা শুনলে জ্ঞান হারানোও অসম্ভব নয়। ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, কার্ল মার্ক্স যে পড়েনি, সে তো কিছুই দেখতে পায় না, বুঝতে পারে না।’ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।

রবীন্দ্রনাথকে মুসলিমবিদ্বেষী প্রমাণ করার জন্য এমন এক মিথ্যেকে সামনে নিয়ে আসেন একদল সমালোচক, যা বহু আগেই মীমাংসিত। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন বলে যেসব তথ্য হাজির করার চেষ্টা হয়েছে, তার সবই ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রজা-নিপীড়নসংক্রান্ত তথ্যগুলোও অমূলক। এসব ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কারণ, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুধর্মের প্রতিভূ হিসেবে দাঁড় করিয়ে মুসলমানদের শত্রু প্রমাণিত করতে পারলে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয়।

৪. হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন। লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের... মুসলমান অংশ ভাষা সাহিত্য শিক্ষা প্রভৃতির একত্ববশত হিন্দুদের সঙ্গে অনেকগুলি বন্ধনে বদ্ধ আছে। যদি বাংলাকে হিন্দুপ্রধান ও মুসলমানপ্রধান এই দুই অংশে একবার ভাগ করা যায়, তবে ক্রমে ক্রমে হিন্দু-মুসলমানের সকল বন্ধনই শিথিল করিয়া দেওয়া সহজ হয়। (সদুপায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

লিখেছেন, ‘আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলো ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখে দুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি, যে একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোদিনই ক্ষমা করিতে পারিবেন না।’ (ব্যাধি ও তার প্রতিকার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

ধর্মীয় ভেদাভেদ যে জাতির উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়, সেটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। আর বুঝতেন বলেই তিনি ধর্ম-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আঘাত পেয়েছেন এবং পেয়ে যাচ্ছেন। এইসব তুচ্ছ বাধা তিনি পেরিয়ে যাবেন তাঁর অমর কীর্তির মাধ্যমে। সেখানেই তাঁকে খুঁজতে হবে। রূপনারানের কূলে যেভাবে তিনি জেগে উঠলেন, নিজেকে চিনলেন ‘আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়’, সেভাবেই তাঁকে চিনতে হবে।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আস্থায় বাজিমাত ইসলামী ব্যাংক

চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

‘ফের ধর্ষণচেষ্টার ক্ষোভে’ বাবাকে খুন, ৯৯৯-এ কল দিয়ে আটকের অনুরোধ মেয়ের

আ. লীগের ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিদের বিএনপির সদস্য হতে বাধা নেই: রিজভী

১৫ স্থাপনায় পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, আকাশেই ধ্বংসের দাবি ভারতের

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত