Ajker Patrika

আগস্ট: তিরিশ বছর পরে

বিজন সাহা
আগস্ট: তিরিশ বছর পরে

১৯৮৩ সালে মস্কো আসার কয়েক দিন পরেই একটা মিছিলে গিয়েছিলাম। শান্তির জন্য মিছিল। লোকে লোকারণ্য। এরপর অনেক বার গিয়েছি মে দিবস আর অক্টোবর বিপ্লব দিবসের মিছিলে। তবে এদিনের সমাবেশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ প্রাণের টানে হাজির হয়েছিল সেখানে। এরা ছিল মুক্তির স্বাদ পাওয়া মানুষ। দীর্ঘদিন সোভিয়েত শাসনের কড়া নজরে থাকার পর পেরেস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের যে দমকা হাওয়া এদের জীবনে কিছুটা হলেও মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল, সেই স্বাদটুকু ধরে রাখার জন্য, আরও কিছুক্ষণ মুক্তির বাতাস বুকের ভেতর অনুভব করার জন্য এরা রাস্তায় নেমেছিল।

আমি বলছি না যে এর আগে তাদের স্বাধীনতা ছিল না। এদের অন্ন-বস্ত্রের স্বাধীনতা ছিল, শিক্ষা ও চিকিৎসার স্বাধীনতা ছিল, মাথার ওপর বাসস্থান ছিল–কিন্তু এসব পাওয়ার পর তার যে ভাবনার স্বাধীনতা দরকার, মুক্ত মনে জন্ম নেওয়া স্বাধীন চিন্তাকে আকাশের সীমাহীন নীলে ভাসিয়ে দেওয়া দরকার, সেটাকে পাওয়ার স্বাধীনতা তার ছিল না। আর এ কারণেই সে সেদিন জীবন বাজি রেখে নেমেছিল মস্কো, লেনিনগ্রাদসহ বিভিন্ন সোভিয়েত শহরের রাস্তায়। এটা ছিল ১৯৯১ সালের ১৯ আগস্ট। হাজার হাজার মানুষের এই ভিড়ে আমিও ছিলাম সিন্ধুতে বিন্দুর মতো।

রুশরা বলে, ‘একবার কাটার আগে সাতবার মাপ।’ কথাগুলো বেশ নিরাশাবাদী, তবে শেষ বিচারে এসবই ঠিক। দেশে দেশে সাধারণ মানুষ, যাদের সব সময় জীবন-মরণের কানাগলিতে পথ চলতে হয়, জীবন তাদের এই শিক্ষাই দেয়, তারা সহজে পরিবর্তন চায় না। তারা জানে প্রতিটি পরিবর্তন তাদের অবস্থাকে খারাপ থেকে খারাপতর করে আর তাদের কাঁধে বসে অতি আগ্রহী একদল মানুষ রাজপ্রাসাদে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তাই আজ তিরিশ বছর পরেও বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ সেই সময়ের জন্য নস্টালজিক হলেও, সেই সময়ে না হোক, অন্তত পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক আশা করলেও নষ্ট রাজনীতির খপ্পরে পড়ে দেশগুলো হয় পরস্পরের শত্রু।

এটা ঠিক, সে সময় অনেক কিছুই ছিল না। সমাজতন্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারলেও সেটাকে এগিয়ে নিতে পারেনি। কেন? এখানেও তৈরি হয়েছে এলিট শ্রেণি, যারা মানুষের কথা বলে ক্ষমতায় থাকলেও মানুষের জন্য যতটুকু না করলেই নয়, সেটুকু করে নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দিতেই ব্যস্ত থেকেছে। এককথায় এখানেও মানুষের স্বাভাবিক লোভ-লালসা কাজ করেছে। সমাজতন্ত্র সবাইকে একই রকম শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছে কিন্তু ভাবতে দিতে চায়নি। অন্যদিকে পুঁজিবাদ শিক্ষার মধ্য দিয়েই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ গড়ে তোলে।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ পুঁজিবাদের এই ভেলকি বুঝতে পারেনি। তারা একদিন যেভাবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেছিল, সেভাবেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেছে। আর যখন দেখেছে গণতন্ত্র স্বপ্ন দেখায় বটে, তবে সেটা বাস্তবায়নের গ্যারান্টি দেয় না, এমনকি মানুষের মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টিও দেয় না, তাদের মনে আবার প্রশ্ন জাগে।

আগে মানুষের অধিকার কম থাকলেও সেটার কমবেশি গ্যারান্টি ছিল, এখন মানুষের অধিকার অনেক কিন্তু তার কোনো গ্যারান্টি নেই। প্রতিটি মানুষ শুধু নিজেই পারে নিজের চাহিদা পূর্ণ করতে। সমস্যা হলো, সবাই সেটা পারে না। অনেক রক্ত আর লাখো মানুষের দুর্ভাগ্যের বিনিময়ে। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা এই সমাজ, বিশেষ করে সামাজিক সম্পর্ক প্রচণ্ড জটিল। সেটাকে হুট করে ভাঙলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়–অর্থনীতি, সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ, এমনকি মানুষের মানসিকতা এবং সব সময় যে সেটা পজিটিভ হবে, তার কোনো কথা নেই। তা-ই আজ তিরিশ বছর পরেও দেখি অনেকেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়নি। 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডাকসুতে শিবিরের জয়ে উদ্বেগ শশী থারুরের, জবাব দিলেন মেঘমল্লার

‘বেয়াদবি ছুটায় দেব’: সরি বলতে অসুবিধা নেই, বললেন সেই জামায়াত নেতা

শাহজালাল বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের সামনে কোমরপানি

ইসরায়েলের হামলার কী জবাব হবে—আরব-ইসলামিক সম্মেলন ডাকল কাতার

তিন ভোটে দায়িত্ব পালনকারীদের ‘যথাসম্ভব’ দূরে রাখতে হবে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত