Ajker Patrika

একটু বসে ভাবি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

মামুনুর রশীদ
একটু বসে ভাবি, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

গত কয়েক দিনে আমি বেশ কয়েকটি ওয়েব সিরিজ দেখেছি এবং আরও কিছু দেখব বলে ভেবেছি। প্রথম ওয়েব সিরিজ দেখেছিলাম মুম্বাইয়ের বড় বড় অভিনেতার দ্বারা নির্মিত। দেখে রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। যৌনতা, ভায়োলেন্স, নৃশংসতা এবং মানুষের কদর্যতম ভয়াবহ রূপ সেখানে দেখলাম। পুরো সিরিজগুলোর কোথাও বিন্দুমাত্র কোনো মানবিকতার ছোঁয়া দেখিনি। এরপর কলকাতার ওয়েব সিরিজ শুরু হলো, সেখানেও এর ব্যত্যয় হয়নি।

আমাদের এখানেও একই অবস্থা। সিনেমায়ও তা-ই দাঁড়িয়ে গেছে সে-ও বহুদিন ধরে। এসব দেখে বিভ্রান্ত হই। ভাবি, শিল্প-সাহিত্যের তাহলে কাজটা কী? ছোটবেলা থেকে গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটকে যা দেখেছি তাতে একজন অন্তত মহৎ মানুষকে দেখতে পেয়েছি। দেখে মনে হয়েছে আমি ওই মানুষটার মতো হব। অথবা যাঁরা বয়স্ক তাঁরা ভেবেছেন আমি কেন ওই মানুষটার মতো হলাম না।

সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তানে তালেবানের দখল দেখে মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশের কথা। সেখানে একজন আবদুর রহমান আছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প কাবুলিওয়ালাতেও আরেক কাবুল সন্তান আছেন। কাবুলের ইতিহাস বহু শতাব্দী ধরেই রক্তাক্ত। যুদ্ধে পারদর্শী এই আফগানদের মোগল সাম্রাজ্য থেকে বাংলার নবাবি আমল পর্যন্ত যুদ্ধবিদ্যায় তাদের দক্ষতা সুবিদিত। বহু আফগান সেনাপতি সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু লেখকদের চিন্তায় এসেছে একজন আবদুর রহমান। সরলহৃদয়, অভিমানী, নীতিপরায়ণ। আবার আরেকজনের লেখায় এসেছে কাবুলিওয়ালা, যার হৃদয়ে শিশু মিনির জন্য অপার স্নেহ। কারণ, দেশেও তার ওই রকম একটি কন্যা রয়েছে। সেই কাবুলিওয়ালা জেল খেটে ফিরে এসে শিশু মিনিকে খুঁজছে। তখন তরুণী মিনির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। মিনির সঙ্গে দেখা হলো না, কিন্তু সেই বিশালদেহী কাবুলিওয়ালার চোখে অশ্রু। মানুষের মহত্তম সম্ভাবনাকে চিত্রিত করতে হবে শিল্পকর্মে–এটাই ছিল সর্বকালের আহ্বান। কিন্তু মিডিয়ার কল্যাণে চল্লিশ বছর ধরে মহৎ চরিত্রের কাঠামো বদলে যাচ্ছে। পেশিশক্তি, অশ্লীলতা এসবই সনাতন ভারতবর্ষের শিল্প-সাহিত্যকে প্রবলভাবে আক্রমণ করেছে।

প্রাচ্য দেশীয় সংস্কৃতিতে মহৎ, পরোপকারী, আদর্শ বোধসম্পন্ন মানুষ, আপসহীনভাবে মূল্যবোধকে রক্ষা করার কাজে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরাই শিল্পের নায়ক হতেন। পশ্চিমা বিশ্বেও এক শ বছর আগে যে শিল্প-সাহিত্য, তাতেও একই অবস্থা বিরাজ করত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধের যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তাতেও মানবতার জয়গান ছিল বেশ উচ্চকিত। আজও আমরা স্মরণ করি রাশিয়ান চলচ্চিত্র ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’ এবং ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’। এ ছাড়া হলিউডে নির্মিত চলচ্চিত্রেও একই বাণী প্রচারিত হতো।

আমাদের দেশে কিছু লেখক, নির্মাতা উল্টো পথটা বেছে নিলেন। সেই পথটায় কিছুটা জনপ্রিয়তাও এসে গেল। শিক্ষাব্যবস্থায় ধস, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এবং অর্থের প্রতি মানুষের নিদারুণ লোভ–সবটা মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র এবং মিডিয়া ক্রমাগত উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। কিছু সাহিত্যিকের চানাচুর-মার্কা লেখা দেখে তরুণসমাজ ধাবিত হয়। যার ফলে চিরায়ত যে সাহিত্য মানুষকে মেধা ও মননে উন্নত করে, সেই সাহিত্য ক্রমাগতভাবেই ঢাকা পড়ে যায়। আমাদের দেশেও যেসব সাহিত্যিক গভীর মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, মহৎ চরিত্র নির্মাণ করেছেন, তাঁরাও গৌণ হয়ে যান। বিপরীতে মিডিয়ার জন্য শত শত লেখকের আবির্ভাব ঘটে। মূল্যবোধহীন, শিক্ষাহীন এই সব লেখক কিছু সৃজনহীন পরিচালকের মাধ্যমে মিডিয়ায় প্রবেশ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এর মধ্যেই এদের লেখায় এবং প্রযোজনায় দর্শকশূন্য হয়ে পড়েছে। পরিবর্তে আবার যা আসে, তা-ও ক্ষতিকর হয়। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে অবিরাম প্রচারিত হয় যেসব ধারাবাহিক নাটক, সেগুলোতে শুধুই হিংসা-প্রতিহিংসা, পরকীয়া এই সব। বিপুলসংখ্যক দর্শক মাদক সেবনের মতো এই সব ধারাবাহিক দেখে দিনরাত কাটাচ্ছে।

এর মধ্যেই এল ইউটিউব নামে এক বিশাল যন্ত্র। যে যার মতো শিল্পের যত আবর্জনা আছে, সবকিছুই এর মধ্যে ঠেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। শিল্পের যত বর্জ্য তা-ই যেন একটা মস্ত বড় কড়াই দিয়ে প্রতিনিয়ত রান্না করা হচ্ছে সেখানে। সিনেমা হলগুলোর ভগ্নদশা। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার ফলে চলচ্চিত্রশিল্প যখন ক্ষীয়মাণ, তখন একটা বৃহৎ লগ্নিতে প্রবেশ করল ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। সাত থেকে দশটি কুড়ি মিনিটের পর্ব নিয়ে শুরু হয় এই প্ল্যাটফর্মের কাজ। আগেই বলেছি, এই প্ল্যাটফর্মে প্রধান প্রবণতা হিংসা-বিদ্বেষ, যৌনতা, ভায়োলেন্স, মৃত্যু, লাশ এই সব। জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুদক্ষ পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফারদের সমন্বয়ে একেকটি ওয়েব সিরিজ যথার্থই দর্শকধন্য হচ্ছে। যারা এই সব সিরিজের দর্শক, তারা সাধারণত তরুণ। যৌনতা এবং অস্ত্রের কারসাজি তাঁদের মাতিয়ে তোলে। একধরনের উন্মাদনা তাঁদের অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মানবিক কোনো বোধে তাঁরা অনুপ্রাণিত হন না।

‘মৃত্যু ও কয়েকটি প্রশ্ন’ নামে আমি একটি নাটক লিখেছিলাম। নাটকটি ছিল এক পড়ুয়া তরুণের জীবনকাহিনি। তরুণটি ভীষণভাবে থ্রিলার পড়তে পড়তে তার মধ্যে এক হন্তারকের মানসভূমি গড়ে ওঠে। সে-ও ওই থ্রিলারের বর্ণনানুযায়ী একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষকে খুন করে ফেলে। এবং খুন করে সে ধরা পড়ে যায়। কারণ, পালানোর কৌশলটা সে রপ্ত করতে পারেনি। ছেলেটি যখন কারাগারে, তখন তার বাবা ওই লেখকের নামে একটি মামলা করে দেয়। এই অভিনব মামলায় লেখকের কোনো সাজা হয় না। কিন্তু তরুণটির ফাঁসি হয়ে যায়। ফাঁসির প্রাক্কালে তার বোধোদয় হতে থাকে। তখন তার মনে হয় পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যকে সে দেখেনি। মানুষের মহান কর্মকাণ্ডকে সে অবহেলা করেছে। সে মায়ের স্নেহ, বোনের মমতা, পিতার উদারতা এসব তার চোখে পড়েনি। সে অন্তিম সময়ে উপলব্ধি করে এই সাহিত্যই তাকে ধ্বংসের কাছে দাঁড় করিয়েছে।

আমরা বহু মেধাবী তরুণকে অনেক অপকর্মে লিপ্ত হতে দেখেছি। তাঁরা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান এবং সবকিছু বোঝার ক্ষমতাও তাঁদের আছে। কিন্তু কোথা থেকে যেন অর্থকে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ বলে ভাবতে শুরু করেছে। এই সব ওয়েব সিরিজের মধ্যেও একটা টাকার ব্যাপার থাকে এবং টাকাটি দুর্নীতি, পেশিশক্তির জোরে পাওয়া সম্ভব। প্রতিদিন খবরের কাগজে এই সব লোকের সফলতার কাহিনি লেখা থাকে। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার বৃত্তান্তও তাতে থাকে। খুবই অল্প করে থাকে মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। রাজনীতি এই অর্থ উপার্জনকে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। রাজনীতি শিল্প-সাহিত্য এবং তার মধ্যে অর্থলিপ্সা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকে, রাজনৈতিক বক্তৃতায় মূল্যবোধের কথা বলে গলা ফাটিয়ে কিছু লোক চিৎকার করে যাচ্ছে। যে শিক্ষকটি মহৎ মানুষের জীবনী পড়াচ্ছেন অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে, সেই শিক্ষক ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নিজের কোচিংয়ের ব্যবসাটি ফুলে ফেঁপে তুলছেন। তাতে জ্ঞানের বাজার কমে যাচ্ছে এবং ছাত্রদের সামনে শিক্ষার ব্যবসার বাজারদর বেড়ে যাচ্ছে। ফলে অশ্রদ্ধার দাঁড়িপাল্লাটা ভারী হয়ে যাচ্ছে। একদিকে আস্থাহীন তরুণেরা যখন ওয়েব সিরিজের গল্পগুলোকে দেখছে সেগুলোকেই মনে হচ্ছে আসল পৃথিবী আর যা কিছু সব অভিভাবক, শিক্ষক বা সত্যিকারের সাহিত্যে লেখা হচ্ছে, তা-ই হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কাছে অবাস্তব। 

আমরা যাঁরা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের শিক্ষকদের দেখেছি আন্দোলনের মিছিলে, যেসব মুখ মনে পড়ে, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া তরুণদের কথা মনে পড়ে, তাদের কাছে আজকের সফল মানুষদের কাহিনি কখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়। ওয়েব সিরিজগুলোতে একধরনের মানুষরূপী দানবদের দেখতে পাই। যারা সত্যিই স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা থেকে একেবারেই বহুদূরের মানুষ। এতে মনে হয় পরিবার থেকে, বিদ্যালয় থেকে এবং সমাজ থেকে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমাজ গড়ে উঠেছে। আজকের দিনে সৎ মানুষদের কোনো আন্দোলন, প্রকৃতি রক্ষার কোনো শুভ প্রয়াস বা মনুষ্যত্ব রক্ষার কোনো প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে, তা-ও সন্দেহ জাগে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একক প্রচেষ্টায় বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করার কাজে নেমেছিলেন। হিন্দু ব্রাহ্মণেরা প্রবলভাবে এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তারপরও তিনি ক্ষান্ত হননি। শেষ পর্যায়ে তিনিই জয়ী হয়েছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন কিছু প্রগতিশীল ছাত্রের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল। এর প্রবল বিরোধিতা হয়েছিল কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সশস্ত্র বিরোধিতার মুখে শুরু হলেও শুধু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অস্ত্র চালনার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছে। স্বাধীন দেশের পতাকা আমরা পেয়েছি। যুদ্ধের শেষে দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যাও করা হয়েছে।

এ কথা অত্যন্ত সত্য, বাংলাদেশের বড় বড় অর্জনের পেছনে রয়েছে সংস্কৃতিকর্মীদের অন্তহীন লড়াই। আজ মিডিয়ার সম্প্রসারণকালে আমরা যদি এই সত্যগুলো ভুলে যাই, তাহলে দ্রুত মুছে যাওয়া মিডিয়ার এই সব কাজ বর্তমান প্রজন্মের স্মৃতিতেও দ্রুতই মুছে যাবে। একটু বসে ভাবি, আমরা কোথায় যাচ্ছি? 

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ডাকসুতে শিবিরের জয়ে উদ্বেগ শশী থারুরের, জবাব দিলেন মেঘমল্লার

‘বেয়াদবি ছুটায় দেব’: সরি বলতে অসুবিধা নেই, বললেন সেই জামায়াত নেতা

নতুন ট্রেন্ড ন্যানো ব্যানানা, নিজের থ্রিডি ফিগারিন বানাবেন যেভাবে

ইসরায়েলের হামলার কী জবাব হবে—আরব-ইসলামিক সম্মেলন ডাকল কাতার

রাজাকারের বাচ্চারা মুক্তিযুদ্ধকে বিনাশ করতে পারবে না: ফজলুর

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত