Ajker Patrika

‘কখন সে ঝরে গেল’

সেলিম জাহান
‘কখন সে ঝরে গেল’

সারাদিন আজ দুটো লাইন হৃদয়ে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা’ কইছে। সরাতে পারছি না মন থেকে, ভুলতেও পারছি না সেই কথাগুলো। জলের বুদ্বুদের মতো উঠে আসছে তারা বারবার, ‘কখন সে ঝরে গেল, কখন ফুরাল, আহা, চলে গেল কবে যে নীরবে।’

ঝরে গেল সে গতকাল, চলে গেল আমাদের ছেড়ে। সখ্য ছিল না তার সঙ্গে আমার, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ছিল। সখ্য হওয়ার সম্ভাবনা খুব একটা ছিল না। মহসীন হলের আবাসিক হওয়ার কারণে মুশতাকের (সৈয়দ মুশতাক আহমেদ) সঙ্গে এবং ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কারণে নিসার (নিসার আহমেদ) কিংবা হাফিজ (সুলতান হাফিজ রহমান) এর সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সেই দুই বলয়ের মধ্যে আমি ছিলাম না।

তার খুব কাছের না হওয়াতে আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তার নাম কি ‘অলোক’ না ‘আলোক’ ছিল। সম্ভবত, তার নামের ইংরেজি বানান দেখে কেউ কেউ তাকে অলোক বললেও, আমাদের সদ্যপ্রয়াত সতীর্থ ও বন্ধু মমিনুল হক খানকে আমি চিরকালই আলোক বলে ডেকেছি—কারণ ‘আলোর’ মতোই ছিল সে। সে আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছি আমরা সবাই।

১৯৬৯ সালে রংপুর থেকে সে এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়তে। সেখানেই পরিচয় তাঁর সঙ্গে আমার। মূল বিষয় ভিন্ন ঐচ্ছিক বিষয় আমার মতো তার ছিল গণিত আর সংখ্যাতত্ত্ব। সুতরাং কলা ভবনের আঙিনা ভিন্নও দেখা হতো শহীদ মিনারের উল্টো দিকের যোজিত ভবনে—গণিত, ভূগোল, সংখ্যাতত্ত্বের আখড়ায়।

ঊনসত্তুরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের দলটিকে তারকাখচিত বলা চলে। ১৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে জনা তিরিশেক ছিল বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের প্রথম দশজনার একজনা, আরও জনাবিশেক ছিল মেধা তালিকার মধ্যে—প্রথম বিভাগের কথা তো ওঠেই না। সেই তারকাখচিত গগনে, আলোক তার মেধার কারণের চেয়ে তার মানবিক গুণাবলিতে জ্বলজ্বল করত।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্গনে আসার পরে পরে আলোক সারা বিভাগে এক পরিচিত ও অপরিহার্য নাম হয়ে দাঁড়াল। বিভাগের সব যৌথকাজে যেমন সে পরিচিত মুখ, তেমনি আমাদের বর্ষের সব প্রয়োজনে সে এক অপরিহার্য স্বত্ত্বা। ছাত্র রাজনীতির সম্পৃক্তার কারণে সে আমাদের চেয়ে উঁচু শ্রেণির পড়–য়া রিজওয়ান ভাই (রিজওয়ানুল ইসলাম) কিংবা সাবিহ ভাইয়ের (সাবিহউদ্দীন) খুব পরিচিত, তেমনি আমাদের বর্ষের নবীনবরণ অনুষ্ঠান, চড়–ইভাতি সবকিছুতে আলোক না হলে চলত না।

আলোক ছিল তেমন একজন মানুষ, যে সবার প্রয়োজনে এগিয়ে যেত, সাহায্যের হাত বাড়িয় দিত। এ কথা তার বন্ধু-সতীর্থদের। আমাদের বর্ষের দুজন সতীর্থ যে এবং যা-কিছুনির্বিশেষে সবার কাছে পৌঁছাতে পারত, তাদের একজন আলোক, অন্যজন এহসান (এহসানুর রহমান)। আমাদের সবার বন্ধুত্বের, সখ্যের, পরিচিতির এক একটি নির্দ্দিষ্ট বলয় ছিল। কিন্তু আলোক এবং এহসানের অবাধ ও অবারিত গতিবিধি ছিল সর্ববলয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে আলোকের সাথে তেমন একটা দেখা হয়নি। আলোকের প্রয়াত স্ত্রী কচির সঙ্গে সম্ভবত দেখা হয়েছিল আবিদজানে একবার যখন কার্যোপলক্ষে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কচির সঙ্গে জানাশোনা ছিল আমাদের অনেক আগে থেকেই।

বছর ১৫ আগে ঢাকায় গেলে ওর গুলশানের বাসায় আমাদের কয়েক বন্ধুকে ডেকেছিল আলোক। বছর চারেক আগে ঢাকায় গেলে আমাদের বন্ধু আমিনের (আমিনুর রহমান খান) আমন্ত্রণে আমরা কয়েকজন একত্রিত হয়েছিলাম। সেখানেই কচির সঙ্গে শেষ দেখা। কচি খুব ভালো ছবি তুলত। আমাদের বেশকিছু ছবি তুলেছিল সে।

২০১৭ সালের ৬ আগস্ট সতীর্থ ৬৯-এর এক সভায় আলোকের সঙ্গে শেষ দেখা। তারপর ওর নানান অসুস্থতার সংবাদ পেয়েছি, কিন্তু চাক্ষুষ দেখা আর হয়নি। এখন লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে

কয়েকটি লাইন—

‘উজ্জ্বল আলোর দিন নিভে যায়,

মানুষের আয়ু শেষ হয়,

পৃথিবীর পুরানো সে পথ

মুছে ফেলে রেখা তার—

কিন্তু এই স্বপ্নের জগৎ

চিরদিন রয়।’

দেখা না হোক, আলোক আমার স্বপ্নের জগতে চিরদিন আলো ছড়াবে। শীর্ষেন্দুর ‘ফিরে দেখা’ গল্পটির শেষ দুটো কথা মনে পড়ে যায়—

‘দেখা হবে’।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

কবরস্থানে রেখে যাওয়া নবজাতক হঠাৎ নড়ে উঠল, হাসপাতালে ভর্তি

উপদেষ্টার সভায় শেখ মুজিব-হাসিনার ছবি!

১২ জেলায় বন্যার শঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে কত দিন—জানাল আবহাওয়া অফিস

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চান অধ্যক্ষ, স্ক্রিনশট দিয়ে ব্যানার কলেজ গেটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত