Ajker Patrika

সংকটের মুখে ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
সংকটের মুখে ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র

ইন্দোনেশিয়া আজ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত। প্রায় ২৮ কোটি মানুষের এই বহুজাতিক ও বহু সাংস্কৃতিক দেশটি দীর্ঘ সামরিক শাসন, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি ও দুর্নীতির গভীর সংকট অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করেছে। কিন্তু সেই অর্জিত গণতন্ত্র আবারও অস্থিতিশীলতার ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১১ মাসের মাথায় প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোকে ঘিরে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু তাঁর নেতৃত্ব নয়, গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুই সপ্তাহব্যাপী দেশজুড়ে চলমান বিক্ষোভ প্রমাণ করছে, জনগণের অসন্তোষ ক্ষণস্থায়ী নয়; বরং এটি দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সাংবিধানিক সংকটের ফল।

এ প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—একদিকে কর্তৃত্ববাদী কৌশল অবলম্বন করে সাময়িক স্থিতিশীলতার প্রলোভন, অন্যদিকে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেখানে ইন্দোনেশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রধান শক্তি হিসেবে দেখা হয়, সেখানে প্রাবোওর প্রতিটি সিদ্ধান্ত শুধু দেশীয় রাজনীতিই নয়, আঞ্চলিক কূটনীতি ও বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এ প্রবন্ধে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের পটভূমি, সংকট সমাধানে করণীয়, দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রাম এবং প্রেসিডেন্ট প্রাবোওর সামনে থাকা দুটি সম্ভাব্য পথ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের পটভূমি: দুই সপ্তাহ ধরে রাজধানী জাকার্তা থেকে শুরু করে সুরাবায়া, বান্দুংসহ বিভিন্ন প্রদেশে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এটি নিছক একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন নয়; বরং বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ ও অসন্তোষের সুসংগঠিত বহিঃপ্রকাশ। জনমনে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সাংবিধানিক নিয়ম ভঙ্গ এবং মানবাধিকারের ধারাবাহিক লঙ্ঘন। জনগণের দাবি এখন স্পষ্ট—তারা আর শুধু রাজনৈতিক নাটক দেখতে চায় না; তারা চায় মর্যাদা, মানবাধিকার ও স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

আন্তর্জাতিক পরিসরে এ বিক্ষোভ শুধু অভ্যন্তরীণ সংকট নয়; বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো ইন্দোনেশিয়ার ঘটনাপ্রবাহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, কারণ এখানে গণতন্ত্র দুর্বল হলে গোটা অঞ্চলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রভাব বাড়তে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যারা ইন্দোনেশিয়াকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মডেল হিসেবে প্রচার করে আসছিল, তারাও উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া এই অস্থিরতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে—চীন অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এবং রাশিয়া সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে।

কূটনৈতিকভাবে এটি প্রেসিডেন্ট প্রাবোওর জন্য এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা। তিনি চাইলে কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবে এতে আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে যদি তিনি গণতান্ত্রিক সংলাপ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পথ বেছে নেন, তবে তা অভ্যন্তরীণ শান্তি ও আন্তর্জাতিক পরিসরে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

সংকট সমাধানে করণীয়: ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান সংকটের কারণ কেবল অতীত সরকারের ব্যর্থতা নয়। বহুজাতিক, বহুধর্মীয় ও বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্র হিসেবে এর স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের ওপর। কার্যকর সমাধান পাওয়া যেতে পারে তিনটি ক্ষেত্রে সাহসী পদক্ষেপ নিলে—

প্রথমত, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি ভাঙা। ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ পরিবারনির্ভরভাবে পরিচালিত হয়। এতে রাজনীতি ও ব্যবসার মধ্যে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি টিকে থাকে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে বিচার বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ইন্দোনেশিয়া উদীয়মান অর্থনীতি হলেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। করের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তা স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা জরুরি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার বলেছে, স্বচ্ছ অর্থনীতি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ায় এবং বৈষম্য কমায়।

তৃতীয়ত, সামরিক প্রভাব সীমিত করে নাগরিক ক্ষমতা জোরদার করা। ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে সামরিক বাহিনী সব সময় রাজনীতিতে বড় শক্তি। কিন্তু নাগরিক প্রশাসনে সেনা ও পুলিশের হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা, বিশেষত মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান দেখিয়েছে, সামরিকতন্ত্র শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করে। তাই প্রশাসনে সামরিক ভূমিকার স্পষ্ট সীমারেখা টানা এখন জরুরি।

এ পদক্ষেপগুলো শুধু অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করবে না; বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইন্দোনেশিয়ার ভাবমূর্তিও পুনর্গঠন করবে।

দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রাম: ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় অন্তরায় দুর্নীতি। দুই দশক ধরে ঝুলে থাকা অ্যাসেট রিকভারি বিল কার্যকর হলে এটি দুর্নীতি দমনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারত। ২০০৮ সালে খসড়া এবং ২০১২ সালে সংসদে উত্থাপন করা হলেও আইনটি এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। অথচ এটি বাস্তবায়িত হলে অপরাধমূলক সাজার অপেক্ষা না করেই রাষ্ট্র অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারত।

জাতিসংঘ কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিলটি কার্যকর হলে শুধু দুর্নীতিবিরোধী লড়াই শক্তিশালী হবে না, বরং আন্তর্জাতিক মহলে ইন্দোনেশিয়ার ভাবমূর্তিও উন্নত হবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও বৈশ্বিক আস্থা অর্জনের জন্য এটি অত্যন্ত জরুরি। যদি প্রাবোও সরকার বিলটি পাস করেও কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি শুধু কাগুজে আইন হয়েই থেকে যাবে। তাই এটি ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জবাবদিহির পরীক্ষাকাঠি।

সামনে দুটি পথ: বর্তমান সংকটে প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তোর সামনে ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দুটি পথ খোলা রয়েছে—প্রথম পথ হলো কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন—যেখানে ভিন্নমত দমন, সেনা ও পুলিশের প্রভাব বাড়ানো এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কোণঠাসা করার মাধ্যমে সাময়িক স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব। কিন্তু এতে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়বে এবং দীর্ঘ মেয়াদে দেশ অস্থিতিশীলতার মুখে পড়বে। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে সতর্কবার্তা।

দ্বিতীয় পথ হলো সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্ব প্রদর্শন করা—যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তার মাধ্যমে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা হবে। এতে শুধু অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাই আসবে না; বরং ইন্দোনেশিয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক আদর্শের রোল মডেল হয়ে উঠবে।

অতএব, প্রাবোওর সিদ্ধান্ত শুধু তাঁর ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নয়; বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকেও প্রভাবিত করবে।

প্রেসিডেন্ট প্রাবোও যদি দ্বিতীয় পথ—গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের পথ বেছে নেন, তবে তাঁর নেতৃত্ব শুধু একটি নির্বাচনী বিজয়ের স্মৃতি হয়ে থাকবে না; বরং তা হয়ে উঠবে জনগণের জীবনে ইতিবাচক রূপান্তরের ইতিহাস। রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত মূল্যায়ন কঠোরতা দিয়ে নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দিয়ে হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেসব নেতা জনগণের অন্তরে আস্থা ও আশার প্রদীপ জ্বালাতে পেরেছেন, তাঁরাই সময়ের গণ্ডি অতিক্রম করে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন।

আজ ইন্দোনেশিয়ার সামনে সে সম্ভাবনাই উন্মুক্ত। যদি প্রাবোও তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখেন স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক উন্নয়ন, তবে জনগণ তাঁকে শুধু একজন প্রেসিডেন্ট নয়, একটি নতুন ইন্দোনেশিয়ার স্থপতি হিসেবে স্মরণ করবে। কারণ, রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রকৃত পরিমাপ বন্দুকের গর্জনে নয়, বরং শিশুদের হাসি, কৃষকের মাঠ, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি এবং নাগরিকের মর্যাদা বোধে।

অতএব, প্রাবোওর হাতে এখন ইতিহাস রচনার সুযোগ। তিনি চাইলে ইন্দোনেশিয়াকে অস্থিরতা থেকে টেনে এনে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। আর যদি তিনি সে পথ বেছে নেন, তবে তাঁর নাম শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসেই নয়, বরং ইন্দোনেশীয় জনগণের হৃদয়েও অমর হয়ে থাকবে।

লেখক: আইনজীবী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত