Ajker Patrika

শিবিরের ভূমিধস বিজয় যে কারণে

মাসুদ কামাল
সাধারণ মানুষের মনোজগতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন।  ছবি: আজকের পত্রিকা
সাধারণ মানুষের মনোজগতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন। ছবি: আজকের পত্রিকা

গত কয়েক দিনে তিনজন জামায়াত নেতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এই একটা রাজনৈতিক দল, যাদের নেতাদের মধ্যে পরিমিতিবোধ অসাধারণ। প্রায়ই তাঁরা জানেন, কোথায় থামতে হয়। হাসতে হলে ঠোঁট দুটো কতটুকু প্রসারিত করতে হবে, দাঁত কটা প্রকাশিত হতে পারবে—সে হিসাবও সম্ভবত দল তাদের শিখিয়ে দেয়। মাঝেমধ্যে তাঁদের এমন আচরণ কৃত্রিম মনে হলেও সব মিলিয়ে বিষয়টা আমি পছন্দই করি। দলের বা রাজনীতির কোনো সাফল্যে দারুণ কিছু হইচই বা উচ্ছ্বাস তাঁরা সাধারণত প্রকাশ করেন না। এই যে ডাকসু নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় ঘটল, অন্য কোনো সংগঠন হলে বিজয় মিছিলের তোড়ে হয়তো পুরো ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি। এত পরিমিতিবোধের পরও সম্প্রতি দেখা হওয়া জামায়াত নেতাদের চেহারায় কেমন একটা সাফল্যের আভা আমি দেখতে পেয়েছি। কথাবার্তায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও অন্তর্গত আনন্দের কিছুটা ছাপ চোখেমুখে প্রকাশ পাবেই। এবার সেটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি।

সন্দেহ নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের কারণেই তাঁদের এই মনোভাব। কেবল ওনাদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মনোজগতেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে আমার মনে হয়। কদিন আগেও যাঁরা জামায়াতে ইসলামীকে জাতীয় নির্বাচনে ৩০টি আসনও দিতে রাজি ছিলেন না, তাঁদের কেউ কেউ এরই মধ্যে সেই সংখ্যা ৬০টিতে উন্নীত করে ফেলেছেন। দিন কয়েক পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হবে। যত দূর শুনেছি, সেখানেও একই ধরনের ফল হবে। তখন হয়তো এই প্রবল সমালোচকেরা এই সংখ্যা আরও একটু বাড়িয়ে ৮০ অথবা ১০০-তে নিয়ে যাবেন!

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে অথবা জাতীয় নির্বাচনে কতটুকু কী ভূমিকা রাখবে বা রাখতে পারে, সেটা নিয়ে কিছু বলার আগে বরং ডাকসু বা জাকসুতে কেন শিবির এত ভোট পেল—সেটা নিয়ে একটু বলি। সেই আশির দশকের শেষ দিক থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির একটা ‘নির্যাতিত’ সংগঠন। নির্যাতিত এ অর্থে যে তারা বৈধ সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারত না। এই একটা বিষয়ে অন্য সব ছাত্রসংগঠন একমত ছিল, তারা শিবিরকে ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে দেবে না। আর শেষের ১৬ বছরে, হাসিনার শাসনামলে, বিষয়টা আরও অনেক বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল। ছাত্রলীগ এ সময়ে এতটাই বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল যে ছাত্রদলকেই ক্যাম্পাসে ঢুকতে দিত না, আর ছাত্রশিবির তো আরও বেশি অচ্ছুত।

তাহলে এমন একটা সংগঠন, যারা গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাবিতে দৃশ্যমান ছিল না, তারা কীভাবে মাত্র এক বছরের মধ্যে ছাত্র সংসদে এমন বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলো? এ প্রশ্নের জবাবে আমি কেবল তিনটা কারণের কথা বলব। এক. বিএনপির আত্মম্ভরী মনোভাব ও তার প্রকাশ, দেশজুড়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাতে আওয়ামী লীগের লোকদের নিগৃহীত হওয়া এবং সর্বোপরি ছাত্রশিবিরের ওয়েলফেয়ার পলিটিকস। বিষয়গুলো একটু ডিটেইলে বলি।

এটা প্রায় সবাই এখন জানেন যে ডাকসু অথবা জাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের ভোটগুলো সব শিবিরের প্রার্থীরা পেয়েছেন। কিন্তু কেন? ছাত্রদল কেন পেল না? আসলে ছাত্রলীগে যাঁরা ভোট দেন, তাঁরা আসলে বংশানুক্রমেই দেন। দেখা যাবে এই ছাত্র বা ছাত্রী আসলে আওয়ামী পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা, দাদারা আওয়ামী লীগ করতেন। এখনো করেন। বড় ভাই হয়তো করেন যুবলীগ। কিন্তু নানা অত্যাচারে কিংবা মামলা-মোকদ্দমার কারণে তিনি এখন এলাকাতেই থাকতে পারছেন না, দৌড়ের ওপর আছেন। আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মামলায় জেলে আছেন। একেকটা মামলায় দেড়-দুই শ লোককে আসামি করা হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনে উপজেলা পর্যায়ে কোনো একটা ঘটনায় কেউ নিহত হয়েছে, কিংবা আহত হয়েছে, সেটা নিয়ে মামলা। শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, আসাদুজ্জামান খান কামাল, ওবায়দুল কাদের—এঁদের প্রথম দিকে রেখে হয়তো আরও দেড়-দুই শ মানুষের নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সবাই হত্যা বা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। এখন থাকো দৌড়ের ওপর। এই যে হাজার হাজার মামলা, এগুলোর বাদী কে? ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে বাদী হচ্ছে বিএনপির লোকেরা। ঢাবির যে শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা এভাবে বিএনপির কারণে হয় জেলে আছেন অথবা পালিয়ে আছেন, সেই বিএনপির ছাত্রসংগঠনকে তাঁরা এখানে ভোট দেবেন? এমন চিন্তার অবকাশ কি আছে?

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিএনপির প্রধানতম দাবি ছিল—দ্রুত নির্বাচনের। ভাবখানা এমন যে নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় চলে যাবে। এমন চিন্তার বিষয়টা তারা গোপনও রাখেনি। কথাবার্তা, আচার-আচরণে সেটা প্রকাশ করেছে। তাদের এমন আচরণ একেবারে যে অমূলক, তা-ও বলা যাবে না। যে যত কথাই বলুক, বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের প্রধান দুটি দল হচ্ছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। নির্বাহী আদেশে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধনও স্থগিত করেছে। ফলে আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বললেই চলে। এমন বাস্তবতায় ভোটের মাঠে অনেকটা ওয়াকওভার পাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে বিএনপি। এই যে বিএনপির নিশ্চিত ক্ষমতায় যাওয়ার মতো অবস্থা, এটাও কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। কারণ, অতীতে তারা দেখেছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করে। কুখ্যাত গণরুম, জোরজবরদস্তি করে দলীয় মিছিলে নিয়ে যাওয়া—এসব কি ছাত্রলীগ করতে পারত, যদি তারা সরকারি দলের না হতো? অর্থাৎ টর্চারটা আসে আসলে সরকারি দলের কাছ থেকে। শিক্ষার্থীরা হয়তো ভেবেছে, ফেব্রুয়ারির পর থেকেই ছাত্রদলই হতে যাচ্ছে সরকারি দল, তাই তারা যদি ডাকসুতেও থাকে তাহলে হয়তো আবার সেই গণরুম কালচার ফিরে আসতে পারে।

প্রার্থী নির্বাচন বা রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটা পার্থক্য শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করে থাকতে পারে। একটা কথা বলা হয়ে থাকে, বিগত বছরগুলোতে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে থাকতে পারত না। বিপরীত দিকে ছাত্রশিবিরের সদস্যরা ছাত্রলীগের মুখোশ পরে ঠিকই হলে পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকত। এই হলে থাকার সুবিধা তারা নিয়েছে। নিজেদের আচার-আচরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন শিবিরের সদস্যরা। হাসিনা সরকারের পতনের পর তাঁরা প্রকাশ্যেই নানা ওয়েলফেয়ার কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়েছেন। হলে হলে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বসিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে থেকেই কোচিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করেছেন। পরিবহনের সমস্যা নিরসনেও নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। অথচ আগে সাধারণ স্টুডেন্টদের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ উল্টা। তাঁরা দেখেছেন—ছাত্রসংগঠন মানেই দুর্বিনীত আচরণের কিছু যুবক-যুবতী। যাদের কাজই হচ্ছে অন্যদের পেরেশানির মধ্যে রাখা। তাই নতুন এ বাস্তবতা তাঁদের মুগ্ধ করেছে। কোনো ছাত্রসংগঠনের কাছ থেকে এ রকম আচরণ অনেকের কাছের নতুন লেগেছে, ভালোও লেগেছে। আমার ধারণা, এ বিষয়টিও এবার ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এমন ফলাফল কি জাতীয় নির্বাচনে বিশাল কোনো পরিবর্তন এনে দেবে? আগামী নির্বাচনে কি এর দারুণ কিছু প্রভাব পড়বে? এ প্রশ্নের নানা রকম বিশ্লেষণ হতে পারে। আমার মনে হয়, বিশাল কোনো প্রভাব ফেলবে না। সেসব নিয়ে পরে আরেকদিন কথা বলা যাবে। কিন্তু এ কথাটি কিন্তু মানতেই হবে, জামায়াতে ইসলামী নিজেরা এই বিশাল বিজয়কে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বাড়াতে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। তার নমুনা এরই মধ্যে কিছু দেখাও যাচ্ছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত