Ajker Patrika

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা

বিমল সরকার
বিমল সরকার
বিমল সরকার

ইদানীং; কেবল ইদানীং কেন, অনেক আগে থেকেই আমার মনে একটি প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়ে ওঠে যে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কিংবা সমাজে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কী, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারি? জানা আছে কিংবা জানা থেকে থাকলে মনে রাখতে পেরেছি এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা অথবা গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট কী? আমার মনে হয়, এমন প্রশ্ন কেবল আমার একার নয়, দেশের সচেতন সব নাগরিকের।

২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ২৭ জানুয়ারি ২০২০ মাত্র ৩৬ দিনে (এক মাস ছয় দিন) তিন দফায় দুটি করে মোট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয় বা স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে একটি-দুটি করে হয়েছে নতুন আরও ছয়টি। অর্থাৎ গত ছয় বছরে (২০১৯-২৪) দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে মোট ১২টি।

আমাদের দেশে অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মতোই ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষারও গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাত দিয়ে। সেই উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পথচলা শুরু। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত ধীরলয়ে অগ্রসর হওয়া। পূর্বাঞ্চলে উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণে প্রথম প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ (প্রতিষ্ঠা: ১৮৪১)। গোটা পূর্ববঙ্গে সবেধন নীলমণি একটিই কলেজ; এমনই প্রেক্ষাপটে রাজধানী শহর কলকাতায় ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় উপমহাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)। অবিভক্ত বাংলায় দ্বিতীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে না ওঠায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে টানা ৬৪ বছর (১৮৫৭-১৯২১) পূর্ববঙ্গবাসীর লক্ষ্য, ধ্যান-জ্ঞান, স্বপ্ন-সাধনা সবকিছুই আবর্তিত হয় মূলত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। জন্ম, শৈশব আর কৈশোর তথা বেড়ে ওঠা যেখানেই হোক—বিশ্ববিদ্যালয়ের পা মাড়ানো মানে নিদেনপক্ষে কলকাতায় যাওয়া। এটাই কঠিন বাস্তবতা। প্রধানত মুসলিম-অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ বলতে গেলে গোটা ব্রিটিশ আমলেই আর্থসামাজিক ও শিক্ষা-দীক্ষার দিক দিয়ে ছিল বঞ্চিত-অবহেলিত ও চরমভাবে উপেক্ষিত একটি জনপদ। ঠিক এমনই প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়ন হলে আর বাইরে যেতে হবে না, ঢাকাতেই এমএ পড়া ও গবেষণা করা। পূর্ববঙ্গের ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ঘটনাটি সামান্য নয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ এক বিপ্লব। বঙ্গভঙ্গ রদের (১৯১১) পর থেকেই চিন্তা-গবেষণার শুরু, অতঃপর বাধাবিপত্তি, বিরোধিতা-সহযোগিতাসহ নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ১০ বছর পর তা বাস্তবায়ন (১৯২১)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পর ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা পায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর একে একে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আমলে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ (১৯৬১), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)। ১৯৭২ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ২০ বছরে (১৯৭১-৯১) তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়: বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮১), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৭) এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১)। মোটামুটি এই হলো উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ ও গবেষণা করার জন্য সুস্থধারার বন্দোবস্ত। পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও উচ্চশিক্ষাকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই হয়েছে।

কী হয়েছে? ইংরেজ আমলে ১৯০ বছরে (১৭৫৭-১৯৪৭) একটি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরে ৫টি (১৯৫৩, ১৯৬১, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৭০) আর স্বাধীনতার পর প্রথম ২০ বছরে (১৯৭১-৯১) তিনটি এবং পরবর্তী ৩২ বছরে (১৯৯২-২০২৪) প্রতিষ্ঠা পায় ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব মিলিয়ে দেশে এখন অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬২ (এগুলোর মধ্যে ৫৬টির কার্যক্রম চলমান রয়েছে)।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি কিংবা নীতি ছিল—‘জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন’। এ ব্যাপারে সরকার অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিল, পুরোপুরি বাস্তবায়নে বেশি পিছিয়ে থাকেনি। সরকারি দলের নেতা, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী-উপদেষ্টা তথা নীতিনির্ধারকদের মুখে বলতে গেলে প্রতিনিয়ত শোনা গেছে এ কার্যক্রমের ফিরিস্তির বর্ণনা তথা আত্মতুষ্টির কথা। ২০২৪ সালে এক অবাঞ্ছিত ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতিতে বিদায় হতে না হলে বোধ করি ২০২৫ সালেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় নেই­, এমন কোনো জেলা থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরিকল্পিতভাবে অল্প সময়ে এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সার্বিক ফলাফল খুব শুভপ্রদ হচ্ছে না। জানি না অদূর ভবিষ্যতে এর মাশুল আমাদের আরও কীভাবে গুনতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত