মামুনুর রশীদ
বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মঘাতী এবং প্রকৃতিগতভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার একদা তাদের খাদ্য হিসেবে হরিণশাবক সব খেয়ে ফেলত। খাদ্যের অভাবে হাহাকার দেখা দিল ব্যাঘ্রকুলে। তারপর তারা জনপদের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। কিছু মনুষ্য-সন্তান পরম আনন্দে ভোগ করার পর নানাভাবে বাঘ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তারপর অনাহারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যু হতে থাকে। হরিণ বাড়তে থাকে কিন্তু বাঘ কমতে থাকে। কমতে কমতে বাঘ প্রাণিকুলে একেবারেই সংখ্যালঘু। বাংলাদেশ প্রকৃতিগত হিসেবে আয়তনে ছোট হলেও বিশাল বনভূমি, পাহাড়, নদী, বন, সমুদ্র সব প্রাচুর্যে একদা ভরপুর ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে দেখা যায়, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকেরা এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে মধুপুর গড়ে। যেখানে ছিল রানী ভবানীর রাজত্ব। ফকির মজনু শাহ্ এবং সন্ন্যাসীরা সমবেত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সুদীর্ঘ ৩০ বছর তারা লড়াই করেছে।
মধুপুরের এই বনে তখন বাঘ, ভালুক, হাতিসহ নানা ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এরা আক্রমণ করেনি। এখানকার আদিবাসীরা এই যুদ্ধে মজনু শাহ্ বাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত সেই বন তখনো কিছুটা সুরক্ষিত ছিল। তা-ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য সহায়ক হয়েছিল। দলে দলে আদিবাসী মান্দিরা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মান্দিরা বন, পাহাড়, নদী এসবকে ধরিত্রী-জননী হিসেবে বিবেচনা করে। তাই তাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে ধরিত্রী আরও শক্তিশালী হবে, বন সুরক্ষিত থাকবে এবং বন্য প্রাণী সগর্বে বনে বিচরণ করবে।
কিন্তু বাস্তবে লক্ষ করা যাচ্ছে, মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত একটি হাতি, একটি বাঘ, একটি ভালুক এখন আর জীবিত নেই। যে বিশাল বনশূকর বাহিনী, বানর, সাপ ছিল, এগুলোও এখন আর দৃশ্যমান হয় না। শুধু তা-ই নয়, শালবন, গজারিবন কোনোমতে টিকে আছে। এই যে গত পঞ্চাশ বছরে শুধু মধুপুর অঞ্চল নয়, ওদিকে গারো পাহাড়বেষ্টিত যে অঞ্চল, সেখানেও একই অবস্থা। একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য খাসিয়া অঞ্চলে যদি যাওয়া যায়, সেখানকার অবস্থা একেবারেই অনুকূল নয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এসব অঞ্চলেও বন ও পাহাড় এ দুটিকে ধ্বংস করার এক উৎসব শুরু হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান কাঠগুলো নানাভাবে লুণ্ঠিত হয়ে ঢাকা শহরে প্রভাবশালীদের অট্টালিকায় শোভা পাচ্ছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। পাহাড় কাটার ফলে সামান্য বৃষ্টি নামলেই পাহাড়ধসে মানুষের অপমৃত্যু হচ্ছে। অসংখ্য নদীর দেশ বাংলাদেশ। একদিকে ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহকে সংকুচিত করেছে, অন্যদিকে নদীর অন্যান্য উৎস থেকে আসা জলরাশিকে কোথাও সংকীর্ণ করে ফেলেছে এবং নানা রকম অবৈজ্ঞানিক বাঁধ নির্মাণ করে অপরিণামদর্শী পরিকল্পনাবিহীনভাবে নদীকে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। অধিকাংশ নদীই তার গতিপথের ধারা হারিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব মালিকানা কার? প্রথমেই কথা আসে রাষ্ট্রের এবং সেই রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের। কিন্তু মাঝখানে আছে একটি বড় শক্তি, সেটি হচ্ছে সরকার এবং তার অঙ্গীভূত কর্মচারী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। দেশে বন রক্ষার জন্য একটা বন বিভাগ রয়েছে। সেই বন বিভাগের বড় কর্মকর্তার বাড়িতে বালিশের মধ্যে কোটি কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া যায়। শোনা যায় বন কর্মকর্তাদের সুন্দরবনে একটা পোস্টিং পেতে হলে কোটি কোটি টাকা দিতে হয়। সেই পোস্টিং যত অল্প দিনের জন্যই হোক না কেন! ফেরার সময় কোটি টাকার বিনিময়ে আরও কোটি টাকা নিয়ে ফেরেন সেই কর্মকর্তা। বন প্রহরী থেকে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পর্যন্ত কোটি কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে চাকরি হারালেও তাঁর জীবনের একটা বন্দোবস্ত ঠিকই হয়ে যায়।
এই বনকে রক্ষার জন্য যে আদিবাসীরা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে কঠোর লড়াই করে আসছেন, তাঁরাই আবার বন আইনের মামলায় ফেরার হয়ে ঘুরছেন। অথচ বন ধ্বংসের জন্য যে দায়ী কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, তাঁরা প্রকাশ্যে গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে নদী ধ্বংসের জন্য আরেকটি কর্তৃত্ব এসেছে, যে কর্তৃত্বের নাম বালুমহাল ব্যবস্থাপনা। অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিপুল অর্থের মালিক হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের কিছুই করার থাকছে না।
সমগ্র গারো পাহাড় সন্নিহিত এলাকাগুলোর অপর পাশেই হচ্ছে গারো ও খাসিয়া রাজ্য মেঘালয়। দেশভাগের অভিশাপে আমরা আসামকে হারিয়েছি।
এদিকে একদা রংপুরের অন্তর্গত বৃহত্তর আসামের একটি বড় অংশকেও হারিয়েছি। যদি মেঘালয় এবং আসামের অঞ্চলগুলো দেখা যায় সেখানে বন, পাহাড়, নদী অক্ষত থাকায় প্রকৃতি একেবারেই অন্য রকম। সেখানে বনে এখনো হাতি আছে এবং প্রায়ই দেখা যায় সেই হাতিগুলো বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে শেরপুর থেকে হালুয়াঘাট পর্যন্ত তাণ্ডব করে চলে যায়। ওই সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত, পানির প্রবাহ এবং জলবায়ু এখনো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আমরা তা পারিনি। ১৯৫২-৫৩ সালে অথবা পুরো পঞ্চাশের দশকজুড়ে আমি নিজে প্রত্যক্ষদর্শী। মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত যে বন এবং বন্য প্রাণীকে দেখেছি, তা সত্তরের দশকেই হঠাৎ করে উবে গেল।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে যে পরিমাণে মান্দিরা বসবাস করত, তাদেরও সত্তর-আশির দশকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বন ফাঁকা হয়ে গেছে এবং পাহাড় কেটে সমতল ভূমি করে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে অধিকাংশ বন, পাহাড় ও নদী। সম্প্রতি নদীর সীমানা উদ্ধারের জন্য একটি অভিযান চলেছে। ঢাকার আশপাশে নদীর সম্পত্তি দেখে রীতিমতো চমকে যেতে হয়। নদীর এত সম্পত্তি, আত্মঘাতী বাঙালিরা কী অনায়াসে দখল করে বহুতলবিশিষ্ট বিভিন্ন অট্টালিকা নির্মাণ করেছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার নদীর জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু দেখা গেল একটা সময় এসে সেটা থেমেও যায়। শুধু থেমে যায় না, নতুন-পুরোনো দখলদারেরা মিলে একটা বন্দোবস্ত করেও ফেলে।
এর মধ্যেই ৩০ বছর আগে বন বিভাগ একটা অভিনব পরিকল্পনা এনেছিল, তা হচ্ছে সামাজিক বনায়ন। ভালো কথা, বনায়ন তো সমাজেরই। নতুন রাস্তার পাশে বনায়ন হবে, অতীতেও হয়েছে। সেই শেরশাহের আমলে যখন যশোর থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড হলো সুদূর দিল্লি পর্যন্ত, সেই রাস্তার পাশেও বৃক্ষরোপণ হয়েছে। কিছু কিছু উন্নয়নের কারণে কিছু বৃক্ষ কেটে ফেলাও হয়েছে। তারপরও শতবর্ষী বৃক্ষগুলো এখনো পাওয়া যায়। এই সামাজিক বনায়নের বুদ্ধিটা পাওয়া গেল বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। বিশ্বব্যাংক আমাদের প্রকৃতিগত বনায়নকে ধ্বংস করে সেই জায়গায় ইউক্যালিপটাসের মতো পানি হরণকারী রাক্ষুসে বৃক্ষটিকে বনায়নের বুদ্ধি দিল। শুধু তা-ই নয়, এটাকে সরকারিভাবে রোপণে বাধ্য করা হলো।
ইউক্যালিপটাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা একাশিয়া, যার বাংলা নাম আকাশমণি। শাল-গজারি কেটে ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়া রোপণ করে বনের স্বাভাবিক জীবনকে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করল। সেই ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে। যেখানে একদা শাল-গজারি-বেতস লতা এবং নানা ধরনের গুল্ম অনায়াসে বেড়ে উঠত, সেখানে ওই সব বৃক্ষ রোপণ করা হলো এবং কলাগাছ উৎপাদনের কুবুদ্ধি দিয়ে দিল আমাদের। কলা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির বাংলাদেশে কোনো অভাব নেই। পশ্চিমের শিক্ষিত কিছু আমলা, কিছু বিজ্ঞানী লোক নানান ধরনের তথ্য দিয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দেয় এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাঁর ক্ষমতার লড়াইয়ে এতই ক্ষতবিক্ষত থাকেন যে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা বা কোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সময় তাঁদের থাকে না।
এভাবেই ধ্বংস হয়ে যায় দেশের অমূল্য সম্পদ। প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে আমাদের প্রকৃতির এত বড় দান এই বাংলাদেশ দিন দিন ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সে খবর শুধু জানে যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন এবং ধরিত্রীকে জননী বিবেচনা করেন। প্রকৃতির পরিবর্তন এত ধীরে হয় যে, তা শিগগির চোখে পড়ে না। কিন্তু এখন জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে সবারই টনক একটু নড়ছে। কিন্তু টনক নড়ে না ওই সব দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক দুষ্কৃতকারীর। যদি বাংলাদেশে সুন্দরবন না থাকত তাহলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল বহু আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। যেভাবে পৃথিবীতে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো হচ্ছে, যাকে সব সময় ঠেকিয়ে দিচ্ছে সুন্দরবন। আমরা কি সুন্দরবনের মর্ম বুঝি। অজস্র নদী-নালায় সুজলা-সুফলা আমাদের দেশের মর্ম কি আমরা বুঝি?
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলাদেশে আসেন এক সেনাপতি, যিনি বাংলাদেশের প্রথম ইতিহাস লেখেন–তাঁর নাম মির্জা নাথান। তিনি লিখেছেন, তিনি এমন কোনো দেশ দেখেননি যেখানে ঘোরতর গ্রীষ্মকালেও ঘাস সবুজ থাকে। তাই তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছিলেন বাহারিস্তানে গায়েবি, অর্থাৎ অজানা চিরবসন্ত ভূমি। এই চিরবসন্ত ভূমিকে রক্ষা করার জন্য আদিবাসী এবং বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা এখনো চেষ্টা করছেন, তাঁদের কণ্ঠ এখনো ক্ষীণ। কিন্তু রাষ্ট্রকে এই ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তনাদই শুনতে হবে। তাহলেই রক্ষা, না হলে অনিবার্য ধ্বংস।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
বাঙালি জাতি হিসেবে আত্মঘাতী এবং প্রকৃতিগতভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার একদা তাদের খাদ্য হিসেবে হরিণশাবক সব খেয়ে ফেলত। খাদ্যের অভাবে হাহাকার দেখা দিল ব্যাঘ্রকুলে। তারপর তারা জনপদের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করল। কিছু মনুষ্য-সন্তান পরম আনন্দে ভোগ করার পর নানাভাবে বাঘ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তারপর অনাহারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যু হতে থাকে। হরিণ বাড়তে থাকে কিন্তু বাঘ কমতে থাকে। কমতে কমতে বাঘ প্রাণিকুলে একেবারেই সংখ্যালঘু। বাংলাদেশ প্রকৃতিগত হিসেবে আয়তনে ছোট হলেও বিশাল বনভূমি, পাহাড়, নদী, বন, সমুদ্র সব প্রাচুর্যে একদা ভরপুর ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে দেখা যায়, পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকেরা এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে মধুপুর গড়ে। যেখানে ছিল রানী ভবানীর রাজত্ব। ফকির মজনু শাহ্ এবং সন্ন্যাসীরা সমবেত হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। সুদীর্ঘ ৩০ বছর তারা লড়াই করেছে।
মধুপুরের এই বনে তখন বাঘ, ভালুক, হাতিসহ নানা ধরনের প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এরা আক্রমণ করেনি। এখানকার আদিবাসীরা এই যুদ্ধে মজনু শাহ্ বাহিনীকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত সেই বন তখনো কিছুটা সুরক্ষিত ছিল। তা-ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য সহায়ক হয়েছিল। দলে দলে আদিবাসী মান্দিরা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। মান্দিরা বন, পাহাড়, নদী এসবকে ধরিত্রী-জননী হিসেবে বিবেচনা করে। তাই তাদের প্রত্যাশা ছিল, দেশ স্বাধীন হলে ধরিত্রী আরও শক্তিশালী হবে, বন সুরক্ষিত থাকবে এবং বন্য প্রাণী সগর্বে বনে বিচরণ করবে।
কিন্তু বাস্তবে লক্ষ করা যাচ্ছে, মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত একটি হাতি, একটি বাঘ, একটি ভালুক এখন আর জীবিত নেই। যে বিশাল বনশূকর বাহিনী, বানর, সাপ ছিল, এগুলোও এখন আর দৃশ্যমান হয় না। শুধু তা-ই নয়, শালবন, গজারিবন কোনোমতে টিকে আছে। এই যে গত পঞ্চাশ বছরে শুধু মধুপুর অঞ্চল নয়, ওদিকে গারো পাহাড়বেষ্টিত যে অঞ্চল, সেখানেও একই অবস্থা। একটু নিশ্বাস নেওয়ার জন্য খাসিয়া অঞ্চলে যদি যাওয়া যায়, সেখানকার অবস্থা একেবারেই অনুকূল নয়। আর পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এসব অঞ্চলেও বন ও পাহাড় এ দুটিকে ধ্বংস করার এক উৎসব শুরু হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল্যবান কাঠগুলো নানাভাবে লুণ্ঠিত হয়ে ঢাকা শহরে প্রভাবশালীদের অট্টালিকায় শোভা পাচ্ছে। সেই সঙ্গে সমুদ্রবেষ্টিত চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। পাহাড় কাটার ফলে সামান্য বৃষ্টি নামলেই পাহাড়ধসে মানুষের অপমৃত্যু হচ্ছে। অসংখ্য নদীর দেশ বাংলাদেশ। একদিকে ভারত বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহকে সংকুচিত করেছে, অন্যদিকে নদীর অন্যান্য উৎস থেকে আসা জলরাশিকে কোথাও সংকীর্ণ করে ফেলেছে এবং নানা রকম অবৈজ্ঞানিক বাঁধ নির্মাণ করে অপরিণামদর্শী পরিকল্পনাবিহীনভাবে নদীকে শুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। অধিকাংশ নদীই তার গতিপথের ধারা হারিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব মালিকানা কার? প্রথমেই কথা আসে রাষ্ট্রের এবং সেই রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের। কিন্তু মাঝখানে আছে একটি বড় শক্তি, সেটি হচ্ছে সরকার এবং তার অঙ্গীভূত কর্মচারী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। দেশে বন রক্ষার জন্য একটা বন বিভাগ রয়েছে। সেই বন বিভাগের বড় কর্মকর্তার বাড়িতে বালিশের মধ্যে কোটি কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া যায়। শোনা যায় বন কর্মকর্তাদের সুন্দরবনে একটা পোস্টিং পেতে হলে কোটি কোটি টাকা দিতে হয়। সেই পোস্টিং যত অল্প দিনের জন্যই হোক না কেন! ফেরার সময় কোটি টাকার বিনিময়ে আরও কোটি টাকা নিয়ে ফেরেন সেই কর্মকর্তা। বন প্রহরী থেকে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা পর্যন্ত কোটি কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে চাকরি হারালেও তাঁর জীবনের একটা বন্দোবস্ত ঠিকই হয়ে যায়।
এই বনকে রক্ষার জন্য যে আদিবাসীরা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে কঠোর লড়াই করে আসছেন, তাঁরাই আবার বন আইনের মামলায় ফেরার হয়ে ঘুরছেন। অথচ বন ধ্বংসের জন্য যে দায়ী কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, তাঁরা প্রকাশ্যে গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে নদী ধ্বংসের জন্য আরেকটি কর্তৃত্ব এসেছে, যে কর্তৃত্বের নাম বালুমহাল ব্যবস্থাপনা। অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বিপুল অর্থের মালিক হচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। সে ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের কিছুই করার থাকছে না।
সমগ্র গারো পাহাড় সন্নিহিত এলাকাগুলোর অপর পাশেই হচ্ছে গারো ও খাসিয়া রাজ্য মেঘালয়। দেশভাগের অভিশাপে আমরা আসামকে হারিয়েছি।
এদিকে একদা রংপুরের অন্তর্গত বৃহত্তর আসামের একটি বড় অংশকেও হারিয়েছি। যদি মেঘালয় এবং আসামের অঞ্চলগুলো দেখা যায় সেখানে বন, পাহাড়, নদী অক্ষত থাকায় প্রকৃতি একেবারেই অন্য রকম। সেখানে বনে এখনো হাতি আছে এবং প্রায়ই দেখা যায় সেই হাতিগুলো বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে শেরপুর থেকে হালুয়াঘাট পর্যন্ত তাণ্ডব করে চলে যায়। ওই সব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত, পানির প্রবাহ এবং জলবায়ু এখনো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। কিন্তু আমরা তা পারিনি। ১৯৫২-৫৩ সালে অথবা পুরো পঞ্চাশের দশকজুড়ে আমি নিজে প্রত্যক্ষদর্শী। মধুপুর থেকে ভাওয়ালগড় পর্যন্ত যে বন এবং বন্য প্রাণীকে দেখেছি, তা সত্তরের দশকেই হঠাৎ করে উবে গেল।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নে যে পরিমাণে মান্দিরা বসবাস করত, তাদেরও সত্তর-আশির দশকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বন ফাঁকা হয়ে গেছে এবং পাহাড় কেটে সমতল ভূমি করে দেওয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে অধিকাংশ বন, পাহাড় ও নদী। সম্প্রতি নদীর সীমানা উদ্ধারের জন্য একটি অভিযান চলেছে। ঢাকার আশপাশে নদীর সম্পত্তি দেখে রীতিমতো চমকে যেতে হয়। নদীর এত সম্পত্তি, আত্মঘাতী বাঙালিরা কী অনায়াসে দখল করে বহুতলবিশিষ্ট বিভিন্ন অট্টালিকা নির্মাণ করেছে। এর আগেও বেশ কয়েকবার নদীর জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু দেখা গেল একটা সময় এসে সেটা থেমেও যায়। শুধু থেমে যায় না, নতুন-পুরোনো দখলদারেরা মিলে একটা বন্দোবস্ত করেও ফেলে।
এর মধ্যেই ৩০ বছর আগে বন বিভাগ একটা অভিনব পরিকল্পনা এনেছিল, তা হচ্ছে সামাজিক বনায়ন। ভালো কথা, বনায়ন তো সমাজেরই। নতুন রাস্তার পাশে বনায়ন হবে, অতীতেও হয়েছে। সেই শেরশাহের আমলে যখন যশোর থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড হলো সুদূর দিল্লি পর্যন্ত, সেই রাস্তার পাশেও বৃক্ষরোপণ হয়েছে। কিছু কিছু উন্নয়নের কারণে কিছু বৃক্ষ কেটে ফেলাও হয়েছে। তারপরও শতবর্ষী বৃক্ষগুলো এখনো পাওয়া যায়। এই সামাজিক বনায়নের বুদ্ধিটা পাওয়া গেল বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। বিশ্বব্যাংক আমাদের প্রকৃতিগত বনায়নকে ধ্বংস করে সেই জায়গায় ইউক্যালিপটাসের মতো পানি হরণকারী রাক্ষুসে বৃক্ষটিকে বনায়নের বুদ্ধি দিল। শুধু তা-ই নয়, এটাকে সরকারিভাবে রোপণে বাধ্য করা হলো।
ইউক্যালিপটাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা একাশিয়া, যার বাংলা নাম আকাশমণি। শাল-গজারি কেটে ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়া রোপণ করে বনের স্বাভাবিক জীবনকে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করল। সেই ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে। যেখানে একদা শাল-গজারি-বেতস লতা এবং নানা ধরনের গুল্ম অনায়াসে বেড়ে উঠত, সেখানে ওই সব বৃক্ষ রোপণ করা হলো এবং কলাগাছ উৎপাদনের কুবুদ্ধি দিয়ে দিল আমাদের। কলা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমির বাংলাদেশে কোনো অভাব নেই। পশ্চিমের শিক্ষিত কিছু আমলা, কিছু বিজ্ঞানী লোক নানান ধরনের তথ্য দিয়ে সরকারকে বুঝিয়ে দেয় এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাঁর ক্ষমতার লড়াইয়ে এতই ক্ষতবিক্ষত থাকেন যে সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনা বা কোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার সময় তাঁদের থাকে না।
এভাবেই ধ্বংস হয়ে যায় দেশের অমূল্য সম্পদ। প্রযুক্তি ও সংস্কৃতিহীন রাজনীতির কবলে পড়ে আমাদের প্রকৃতির এত বড় দান এই বাংলাদেশ দিন দিন ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সে খবর শুধু জানে যাঁরা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন এবং ধরিত্রীকে জননী বিবেচনা করেন। প্রকৃতির পরিবর্তন এত ধীরে হয় যে, তা শিগগির চোখে পড়ে না। কিন্তু এখন জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে সবারই টনক একটু নড়ছে। কিন্তু টনক নড়ে না ওই সব দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক দুষ্কৃতকারীর। যদি বাংলাদেশে সুন্দরবন না থাকত তাহলে দেশের দক্ষিণাঞ্চল বহু আগেই ধ্বংস হয়ে যেত। যেভাবে পৃথিবীতে ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো হচ্ছে, যাকে সব সময় ঠেকিয়ে দিচ্ছে সুন্দরবন। আমরা কি সুন্দরবনের মর্ম বুঝি। অজস্র নদী-নালায় সুজলা-সুফলা আমাদের দেশের মর্ম কি আমরা বুঝি?
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বাংলাদেশে আসেন এক সেনাপতি, যিনি বাংলাদেশের প্রথম ইতিহাস লেখেন–তাঁর নাম মির্জা নাথান। তিনি লিখেছেন, তিনি এমন কোনো দেশ দেখেননি যেখানে ঘোরতর গ্রীষ্মকালেও ঘাস সবুজ থাকে। তাই তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছিলেন বাহারিস্তানে গায়েবি, অর্থাৎ অজানা চিরবসন্ত ভূমি। এই চিরবসন্ত ভূমিকে রক্ষা করার জন্য আদিবাসী এবং বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা এখনো চেষ্টা করছেন, তাঁদের কণ্ঠ এখনো ক্ষীণ। কিন্তু রাষ্ট্রকে এই ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তনাদই শুনতে হবে। তাহলেই রক্ষা, না হলে অনিবার্য ধ্বংস।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। অনেকের কাছে এই ফলাফল অপ্রত্যাশিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা এই নির্বাচনে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের ওপর আস্থা রেখেছেন। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছিল এবং নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় সারা রাত বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৫ ঘণ্টা আগেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমার, শুধু আমার নয় বরং অনেকেরই। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ার সুযোগ পেলাম, তখন প্রথম দিন বড় বোনের কাছ থেকে শাড়ি এনে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম। সেই দিনের শিহরণ, অনুভূতি এখনো শরীর-মনে দোলা দেয়।
৫ ঘণ্টা আগেনির্বাচনের পরে যাঁরা মন্ত্রী হবেন, তাঁদের জন্য ৬০টি গাড়ি কেনার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। প্রস্তাব এসেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে। সমালোচনার মুখে সেই পথ থেকে সরে এসেছে সরকার। বাতিল করা হয়েছে গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত। বহু দুঃসংবাদের মধ্যে এটি একটি সুসংবাদ। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল ধরনের এই কেনাকাটার বিষয়টি
৫ ঘণ্টা আগেজাতীয় প্রেসক্লাবে ৭ সেপ্টেম্বর গণশক্তি আয়োজন করে ‘জুলাই সনদ ও নির্বাচন’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা। সেই সভায় নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যে প্রশ্নটি করেছেন, তা কোটি টাকার সঙ্গে তুলনা করাই যায়। তাঁর সহজ জিজ্ঞাসা—‘ভোটের দিন যাঁর যেখানে শক্তি আছে, তাঁর যদি মনে হয় জিততে পারবেন না...
১ দিন আগে