Ajker Patrika

কঠোর লকডাউনের আতঙ্ক

প্রশান্ত মৃধা
কঠোর লকডাউনের আতঙ্ক

সন্ধের খানিকটা পরে চারখাই বাজারে নেমেছি। এসেছি বিয়ানীবাজার থেকে, যাব সিলেটে। এখানে নেমেই মনে হলো, চারদিকে একটা ঝিমধরা ভাব। অথচ রাত ৯টার সময়ও এ জায়গা, অন্তত মাছবাজারের সামনে ও ভেতরে বেশ জমজমাটই থাকে। খুব স্বাভাবিক। যে বরাক উপত্যকা থেকে সুরমা আর কুশিয়ারা এই দুই নদী, তা এই চারখাইয়ে একটা হাতের বাঁ দিকে, অন্যটা একটু সামনে একেবারে সরাসরি। যাঁরা নদী চেনেন তাঁরা দেখলেও বুঝতে পারবেন, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর জলের ও নদীর পাড়ের গঠনে বেশ ফারাক। এমনি তো আর কথায় বলে না, এক নদীর জলে দুবার স্নান করা যায় না। এ তো এক জায়গায় উৎপত্তির পরে একেবারে ভিন্ন দুটো নদী, এর পানি কি পাড়, গঠন কি স্রোত—সবকিছুতেই পার্থক্য।

এই মধ্যবর্তী জায়গায় বসা পুরোনো চারখাই বাজারে নামলে, সন্ধের পরে মাছওয়ালাদের মুখেও সে কথা শোনা যায়। একজন বলবেন এই গাঙোর [নদীর] মাছ। একটা বড় আড় বা আইড় মাছ। স্থানীয় ভাষায় ঘাঘট অথবা বুতিয়া। দুটোই আড়। দুই প্রজাতির। সাধারণ চোখে নামের তফাতকে মনে হবে স্রেফ আঞ্চলিকতা। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। ঘাঘট একটু লম্বামুখো আড়, বুতিয়া সে তুলনায় বেঁটে। মাছগুলো তখনো খাবি খাচ্ছে। এতে মাছওয়ালা ইচ্ছেমতো দাম হাঁকতে পারেন। ক্রেতারা ফিরবেন সুতারকান্দি স্থলবন্দর থেকে, জকিগঞ্জের বিয়ানীবাজার থেকে অফিসফেরতারা। ফলে মোটামুটি জুতসই দাম হাঁকাই যায়।

পাশেই পরের জনের ডালায় বড়সড় বোয়াল। স্থানীয় উচ্চারণে গোয়াল। সিলেটে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মাছ। গোয়ালটা কুশিয়ারার। যেমন সুরমার রুই অতি বিখ্যাত।

নদীতে প্রচুর পাথরকুচি, তাই সুরমার রুইয়ের গায়ের রং একেবারে লালচে। কিন্তু যখন সেই রুই এই দুই নদীর মাঝখানের হাওরে পাওয়া যায়, তখনই গায়ের রং একটু কালচে হয়, লালচে ভাবটা আর থাকে না। সবই জলের গুণাগুণ। কাতলার ক্ষেত্রেও তাই। স্থানীয় ভাষায় কাতলা হলো বাউশ। কালবাউশের নাম কালিয়ারা। সব মাছেরই নদী-হাওরভেদে দামে তফাত আছে। আর নদীতে পানি বাড়লে, হাওর তলালে এগুলো কমই ধরা পড়ে। শুধু শুধু তো আর বলা হয় না গভীর জলের মাছ। এখন নদীতে পানি বেড়ে গেছে। ধানখেতগুলো উত্তর দিগন্তের পাহাড় থেকে নামা পানির কারণে পুরোপুরি হাওর, অর্থাৎ সায়র বা সাগরে রূপান্তরিত না হলেও, মোটামুটি একটা ভর-ভরন্ত চেহারা পেয়েছে।

এটা চারখাই বাজার বলে কথা। সবজির বাজার মোটামুটি জমজমাট। সামনে ও রাস্তার ওপাশে ফলের দোকানগুলোও মৌসুমি ফলে মোটামুটি ভরাই। কিন্তু মাছের বাজারের এই দশা কেন? ওসব বড় মাছ একেবারেই নেই। হাওরে কি নদীতে পানি বাড়লে একেবারে তাজা টাটকা ছোট মাছ পাওয়া যায়। এই পথে যাতায়াতের সময় দেখা যায়, রাস্তার পাশে অথবা কালভার্টের মুখে ভেইল বা ভেসাল জালে ছোট মাছ ধরা হচ্ছে দিনরাত্রি। ছোট মাছ এখানে মাত্র দু-তিন ডালা। একেবারে সামনের দিকে নিয়ে বসেছেন দুজন। বাকিদের কাছে চাষের মাছ।

এনার্জি বাল্ব একটু কমই জ্বলছে। আগে যেখানে প্রতিজনের ডালার ওপরে একটি-দুটি জ্বলত, সে ব্যবস্থা নেই। আলো আছে, আলোকোজ্জ্বল নয় কোনোভাবেই। এক সারির একেবারে ভেতর পর্যন্ত গিয়ে, দ্বিতীয় সারিতে ঢুকলাম। দুই পাশের মাছ দেখতে দেখতে মাঝখান পর্যন্ত এসেছি। এমন সময় একজন মাছওয়ালা অত্যন্ত কাতরভাবে ডাকলেন, ‘ও ভাইসাব, একখান কতা শুনি যাওগি। একটা নিতা [নেবে], কম দামে দিতাম। দাম কই [বলে] যাওগি, দাম কই যাও।’ সামনে কেজি সাইজের রুই, সবই চাষের। দাম কী বলব, তাকিয়েছি শুধু তাঁর মাছের দিকে। অন্য দিন থাকে গায়ে গায়ে ক্রেতার ভিড়। তখন একদর বলে প্রায় যোদ্ধার বেশে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিক্রেতার এখন এই আকুতি! হয়তো বাধ্য হয়ে চাষের মাছ নিয়ে বসেছেন। ছোট মাছ ধরলে কিনবে কে? পচবে সব। ওই আকুতি বলছে, এখন কঠোর লকডাউন। বেরিয়ে আসার সময়ও ডাকটা কানের কাছে ঘুরছিল!

লেখক: সাহিত্যিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত