Ajker Patrika

তার আর পর নেই

সেলিম জাহান
তার আর পর নেই

তা বছর কুড়ির মতো তো হবেই। এ বাড়িতে উঠে এসেছিলাম ২০০১ সাল নাগাদ। তখন থেকেই তো দেখছি, কোনো যতি ছাড়াই। অতি প্রত্যুষকালে আবছা আবছা অন্ধকারের কুয়াশায় চোখে পড়ে। প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গের পরেও দেখি। অনেক নিঃস্তব্ধ দুপুরেও দেখা মিলেছে, ব্যতয় হয়নি অপরাহ্নেও। যখন ‘সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্হরে’, তখনও ফাঁকি দেয়নি ওটা। গভীর রাতে তেষ্টা পেলে যখন জল গড়াতে গেছি, তখনও যেন শুনেছি, ‘জেগে আছি’। গত ২০ বছরে এক লহমার তরেও দৃশ্যপট বদলায়নি।

আসলে তেমন কিছুই নয়, মাত্র দুটো বাতি—হলদে, বিবর্ণ, বুড়ো মানুষের ঘোলাটে চোখের মতো দুটো বিজলি বাতি। একটি বহু পুরোনো বাড়ির জানালা থেকে যেন তাকিয়ে আছে। দু পাল্লার জানালার দুটো ফাঁক দিয়ে যেন ইশারা করছে আমাকে। মাঝেমধ্যে বাতি দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে, জন্ডিসের পীতাভ চোখ নিয়ে একটি কালো বেড়াল যেন ঘাপটি মেরে বসে আছে।

আমাদের আবাসিক ভবনের ছয় তলার বাড়ি থেকে দেখা যায় সামনের একচিলতে সবুজ মাঠ। সেটা পেরিয়ে নদীপাড়ের পথ। তারপর বয়ে চলেছে পূর্বী নদী, যার ওপারে ম্যানহ্যাটনের আকাশ রেখাজুড়ে সুউচ্চ হর্ম্যরাজি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু বাঁয়ে তাকালেই চোখে পড়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের দিবাগত শৈল্যচিকিৎসার ভবনটি। সেই ভবনের একদম উপর তলার জায়গাটিকে এত দূর থেকেও চিহ্নিত করতে পারি। একটা সময়ে বহু ক্ষণ কেটেছে আমার সেখানে।

ডানে তাকালে বিরাট সুউচ্চ কালো যে ভবনটি দৃষ্টি কাড়ে, অনেক আগেই বুঝে গেছি যে ওটা একটা দাপ্তরিক ভবন। সকাল ৯টা নাগাদ তার সব গবাক্ষ পথে আলো জ্বলে ওঠে, বিকেল ৬টা নাগাদ সেগুলো নিভে যায়। তখন শুধু সাদা আলোর একটা দীর্ঘ রেখা উঠে যায় পুরো ভবনের একটা অংশজুড়ে, বোঝা যায় ওটা তুলুনি যন্ত্রের জায়গা।

এ দুয়ের মাঝখানে পাঁচতলা পুরোনো বাড়িটি গুটিশুটি মেরে সংকুচিত বদনে দাঁড়িয়ে আছে। একসময় হয়তো লাল ইট ছিল বাড়িটির, এখন তা বিবর্ণ। এ বাড়িরই পাঁচতলায় দু পাল্লার জানালা দিয়ে ‘দীঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো’র মতো দেখা যায় দুটো বাতি—একই রকম দেখতে, একই উচ্চতায়, একই গবাক্ষ পথে।

যতবার চোখ গেছে সে দিকে গত ২০ বছরে, এ দৃশ্যের কোনো হেরফের হয়নি। অকম্প নক্ষত্রের মতো বাতি দুটো স্থির ওখানে। কিন্তু ও ঘরের গবাক্ষ পথ কখনও খুলতে দেখিনি, পর্দাহীন ওই জানালা দিয়ে ঘরের অন্য কিচ্ছু দেখা যায় না, দেখিনি কাউকে কোনো দিন ওই জানালায় কিংবা ঘরে। বোঝা যায় না ওখানে কেউ কখনো ছিল কি না, শুধু দুটো বাতি নিয়ে ওই জানালাটি স্থির হয়ে আছে কত দিবস, কত রজনী!

অনেক দিন আমার মনে হয়েছে, হয়তো ওই ঘর একজন চলৎশক্তিরহিত একজন বৃদ্ধের ঘর। দিনের পর দিন বিছানাই যাঁর ঠাঁই। ছাদ আর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দিন, মাস, বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ‘গডোর প্রতীক্ষার’ মতো মৃত্যুর জন্য যিনি প্রতীক্ষায়। কখনো মনে হয়েছে হয়তো ও ঘরে আবাস একজন অতি বৃদ্ধার, দুলুনি কেদারাই যাঁর ঠিকানা। পায়ের ওপর মেলে দেওয়া শতছিন্ন একটি রং চটা একটি কম্বল, বৃদ্ধার মতো সেটিও বিগতা যৌবনা। বৃদ্ধা আর তাঁর কম্বল দুজনাই যৌবনস্মৃতি কাতরতায় তাড়িত।

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে ও ঘরে দীর্ঘ অসুস্থতায় শায়িত একটি কিশোরী। তার আর মনে পড়ে না তার স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা, মাঠে ভোঁ দৌড়ের কথা। সে জানে, আর কোনো দিন কোনো কিশোর তার দিকে চোরাচোখে তাকাবে না, সে চুল ঝাঁকালে তা আর কম্পন তুলবে না কোনো তরুণের বুকে, তাকে নৃত্যের আমন্ত্রণ জানাবে না কোনো লাজুক যুবক। সে আর কোনো দিন ভালো হয়ে উঠবে না।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওই কিশোরীটি হয়তো পাশ ফিরে শোয়, আর তার আর্তিতে ঘরের বাতাস এমন ঘন হয়ে ওঠে যে তা যেন ছুরি দিয়ে কাটা যাবে।

হয়তো মাঝেমধ্যে কেউ ওই ঘরে আসে। বৃদ্ধের মাথায় হাত রাখে, বৃদ্ধার কম্বলটি টেনে দেয়, কিশোরীর পাশে বসে। কে তাঁরা—বৃদ্ধের কন্যা, বৃদ্ধার পুত্র না কিশোরীর মাতা? না কি কোনো কর্মনিয়োজিত সেবিকামাত্র? সারাদিনে হয়তো বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে ওইটুকুই যোগাযোগ ওই ঘরের বাসিন্দাদের। এমনও তো হতে পারে, ওই বৃদ্ধ, বৃদ্ধা বা কিশোরীটির অন্ধকারে বড় ভয়; না, তাঁরা আলো ছেড়ে আঁধারে যেতে চায় না। তাই ও ঘরের বাতি জাজ্বল্যমান অনুক্ষণ।

কখনো কখনো আমার মনে হয়েছে—হয়তো ও ঘর ভূতুড়ে, ও ঘরে ভূতেদের বাস। তারা খায়দায়, দাপিয়ে বেড়ায় ওই ঘর, লণ্ডভণ্ড করে ঘরের জিনিসপত্র। মাঝেমধ্যে এক লহমার তরে বাঁ দিকের বাতিটি যে অদৃশ্য হয়ে যায়, তার কারণ একটা বাচ্চা ভূত হয়তো ওই বাতিটি ধরে ঝুলে পড়ে। কোনো একসময়ে ওই ভূতেরা পায়ে পায়ে জানালার কাছে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরের জগৎটা দেখে, মানুষগুলোর কাণ্ড দেখে হাসে আর ভাবে—তারা কখনো বাইরে আসবে না। কী এমন আছে বাইরে? তারপর রাত গভীর হলে তারা খোলা গলায় গান ধরে আর ভূতের নৃত্য জুড়ে দেয়।

হতে পারে, ও ঘরে কিছুই নেই, কেউ নেই। যারা ছিল, অনেক আগে চলে গেছে। ওই ঘরে অপঘাতে কোনো মৃত্যুর পরে কেউ আর আসেনি। হয়তো যাওয়ার সময়ে বাতি নেভাতে ভুলে গেছে। ঘরের দরজায় ঝুলছে বড় তালা। বহুকাল ওই মরচে ধরা তালা খুলে ওই ঘরে কেউ ঢোকেনি, কেউ বেরও হয়নি। ওই ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গা ছমছম করে। ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতার মতো কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করে, ‘ভেতরে কেউ আছো কি?’ ঘরের সামনে দাঁড়ালে ভেতরে হাওয়ার হু হু শব্দ শোনা যায়। ভালো করে কান পাতলে মনে হয়, ওটা হাওয়া নয়, মৃদু কান্নার শব্দ। ওই ঘর যেন মৃত, ওই ঘরে যেন নিস্তদ্ধতাও নিশ্চুপ হয়ে আছে, ওখানে মৃত্যুরও মৃত্যু ঘটেছে।

তারপর হয়তো কোনো একদিন ওই জানালায় কেউ একজন এসে দাঁড়াবে, হয়তো কোনো রমণী। দু হাতে টেনে খুলে দেবে জানালার পাল্লা দুটো। জানালা গলিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখবে নিচের রাস্তা, মানুষ, জনপদ। বুকভরে নিশ্বাস নেবে। মৃদু হাসির ঝিলিক উঠবে তাঁর ওষ্ঠে—কেন এবং কার জন্যে, কে জানে?

তারপর একসময় সেই রমণী জানালা থেকে সরে যাবে। তারপর ধীর পায়ে গিয়ে হয়তো বাতি দুটো নিভিয়ে দেবে। তারপর যে ঘোলাটে বাতি কখনো নেভেনি, সে বাতিটিও নিভে যাবে। তারপর? তার আর হয়তো কোনো পর থাকবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

কবরস্থানে রেখে যাওয়া নবজাতক হঠাৎ নড়ে উঠল, হাসপাতালে ভর্তি

উপদেষ্টার সভায় শেখ মুজিব-হাসিনার ছবি!

১২ জেলায় বন্যার শঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে কত দিন—জানাল আবহাওয়া অফিস

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চান অধ্যক্ষ, স্ক্রিনশট দিয়ে ব্যানার কলেজ গেটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত