Ajker Patrika

যেতে যেতে একলা পথে

সেলিম জাহান
যেতে যেতে একলা পথে

একটু আনমনেই হাঁটছিলাম জনবিরল পথে। সুন্দর একটি বিকেল-রোদ মরে এসেছে। শেষ বিকেলের নরম আলোর আভা। পথের পাশে একটা দু’টো হলুদ ড্যাফোডিল ফুটেছে। দূরে একটি গাছ সাদা ফুলে ফুলে শ্বেতশুভ্র হয়ে গেছে।
তন্ময় হয়ে চারপাশ দেখছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো এবং তারপরেই হেসে দিতে হলো। দেখেছ মানুষের মন! অবচেতন ভাবেই সে চলে আসে তার পরিচিত জায়গায়। ফার্স্ট অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ফর্টি ফিফথ স্ট্রীটের মোড়ে চলে এসেছি, জানি না। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জাতিসংঘ ভবন।

চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম। কেউ কোথাও নেই-নিস্তব্ধ সুনসান চারদিক। মাঝেমধ্যে দু’একটা গাড়ি হুসহাস করে চলে যাচ্ছে। অথচ এ জায়গাটা গম গম করত মানুষের ভীড়ে-দ্রুত ছুটে চলা জাতিসংঘের কর্মকর্তারা কাজের উদ্দেশ্যে, চোখা কূটনীতিকেরা সভার জন্যে। আর সবার উপরে ছিল শত শত মানুষ যারা প্রতিদিন জাতিসংঘ দেখতে আসতেন।
মনে পড়ে গেল, এক সময়ে দিনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে এখানে কোনো কোনো দিন সারারাত নানান বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কত সুনন্দ মানুষকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছি, কত বন্ধুত্ব হয়েছে কতজনের সঙ্গে, কত মানুষ ঋদ্ধ করেছে আমার জীবন। কাজে কেটে গেছে কত দীর্ঘ সময়, তার মধ্যে হাসি-ঠাট্টায় উচ্চকিত হয়েছে চারপাশ।

মাথা উঁচু করে জাতিসংঘ-ভবনের ওপরের দিকে তাকালাম-৩৮ তলা খুঁজে পেতে চেষ্টা করলাম। বহু সময় কেটেছে মহাসচিবের সান্নিধ্যে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অনন্য সুযোগ হয়েছে দু’জন মহাসচিবের সঙ্গে-প্রয়াত মহাসচিব কোফি এ্যানান আর বান কি মুনের সঙ্গে। নানান উচ্চ পর্যায়ের পর্ষদের সদস্য ছিলাম, নানান জরুরি সময়ে মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হয়েছে।
একবার মহাসচিবের কক্ষে এক বৈঠকের সময় কাগজের ধারালো দিকে লেগে আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল বান কি মুনের। হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল- দপ্তর কর্মীরা দৌঁড়ুলেন ব্যান্ড-এইডের জন্যে। আমি তাঁর পাশেই বসেছিলাম। আমার মানিব্যাগ খুলে একটা ব্যান্ড-এইড বার করে তাঁর আঙ্গুলে লাগিয়ে দিলাম। অবাক মানলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে সেটা আমার মানিব্যাগে এল। আমি হেসে বললাম, আমার কন্যারা যখন ছোট, তখন তারা প্রায়শই হাত-পা কাটতো। তাদের জন্যে আমি মানিব্যাগে ব্যান্ড-এইড রাখতাম। অভ্যেসটা এখনও রয়ে গেছে। হেসে ফেলেছিলেন তিনি। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, ‘আপনি খুবই ভালো বাবা’। তাঁর শৈশব-কৈশোরে কোরিয়া যুদ্ধের পরে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের দেয়া পাঠ্যপুস্তকের সাহায্যে পড়াশেনার গল্প শুনিয়েছিলেন বান কি মুন এক পড়ন্ত বিকেলে।

অনেক ব্যক্তিগত গল্প হতো দু’জনের সঙ্গেই। কোফি এ্যানান ঘানায় তাঁর বড় হয়ে ওঠার গল্প করতেন, শরণার্থী সংস্হায় তাঁর যৌবনের কাজের গল্প করতেন। মহাসচিব হওয়ার আগে রুজভেল্ট দ্বীপে থাকতেন তিনি। দপ্তরে যাওয়ার পথে দেখা হতো প্রায়ই। একদি তাঁর পুত্র কোজোর কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী নানা এ্যানানের আঁকা ছবি দেখার জন্যে একবার আমন্ত্রিত হয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে।

কোফি এ্যানান এবং বান কি মুন দু’জনেই চমৎকার মানুষ ছিলেন। বেনুর স্বাস্হ্যের কথা জিজ্ঞেস করতেন, আমার কন্যাদের খোঁজ খবর নিতেন। বাংলাদেশের হাল-হকিকত জানতে চাইতেন।
এত সব যখন ভাবছি ফার্স্ট এভিনিউ আর ফর্টি ফিফথ স্চ্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে, তখন চমক ভাঙল এক ছুটে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের উচ্চকিত শব্দে। চোখ গেল জাতিসংঘ ভবনের প্রাচীরের প্রচারপত্রে - দারিদ্র্য নিরসন, পরিবেশ বজায়ক্ষমতা বিষয়ে। মনে হলো, এ সবই পেছনে পড়ে আছে, বড় হয়ে উঠেছে কোভিডাক্রান্ত বিশ্ব। মনে হলো, কবে এ থেকে মুক্তি, কবে। একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিরে, পা বাড়ালাম

সামনে, পেছনে পড়ে থাকলো জাতিসংঘ ভবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিক্ষোভ থেকে সহিংসতায় উত্তাল ভাঙ্গা, মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতনকাঠামো ৬ মাসের আগেই চূড়ান্ত করার আশ্বাস

কবরস্থানে রেখে যাওয়া নবজাতক হঠাৎ নড়ে উঠল, হাসপাতালে ভর্তি

১২ জেলায় বন্যার শঙ্কা, বৃষ্টি থাকবে কত দিন—জানাল আবহাওয়া অফিস

ছাত্রীকে ওড়না ছাড়া দেখতে চান অধ্যক্ষ, স্ক্রিনশট দিয়ে ব্যানার কলেজ গেটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত