ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এখন ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলোর দিকে হাত বাড়াতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি প্রশ্ন, ন্যাটো আসলেই কতটা আন্তরিক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এ ক্ষেত্রে। সেই প্রশ্নকেই যেন নতুন করে শাণিত করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে তিনি শুধু একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই লঙ্ঘন করেননি; বরং পুরো ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি, ঐক্য এবং সংকল্পকে এক কঠিন পরীক্ষায় ছুড়ে দিয়েছেন।
এটি নিছক সামরিক অনুপ্রবেশ নয়—বরং এক গভীর কৌশল, যা পশ্চিমা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শিকড়ে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে রচিত। পুতিন জানেন, ন্যাটোর শক্তি শুধু অস্ত্রের আধুনিকতায় নয়, বরং তার ঐক্য ও পারস্পরিক আস্থায় নিহিত। আর ঠিক সেই জায়গাটিই আজ পরীক্ষার মুখে। ন্যাটো কি সত্যিই প্রতিটি সদস্যের জন্য জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামবে, নাকি অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও রাজনৈতিক দ্বিধা তাকে দুর্বল করে তুলবে?
এই প্রশ্ন শুধু বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নয়, বরং গোটা ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কারণ, ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল হয়, তা বিশ্বকে জানিয়ে দেবে—আর্টিকেল ফাইভের পারস্পরিক প্রতিরক্ষার অঙ্গীকার বাস্তবে শুধুই কাগুজে প্রতিশ্রুতি। তখন ছোট রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে, আর মস্কোর প্রভাব একের পর এক সীমান্ত অতিক্রম করে বিস্তার লাভ করবে। আর যদি ন্যাটো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে তা শুধু পুতিনকেই নয়, ভবিষ্যতের সব সম্ভাব্য আগ্রাসনকেও কঠোর বার্তা দেবে।
এস্তোনিয়ার আকাশে রুশ যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশকে বিচ্ছিন্ন সামরিক ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি এক ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল, যার প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে আগামী দিনের ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য।
ন্যাটো দীর্ঘদিন ধরে ঘোষণা দিয়ে আসছে—‘জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায় আমরা অটল।’ এই ঘোষণা শুধু কূটনৈতিক শব্দচয়ন নয়, বরং পশ্চিমা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার মূল ভিত্তি। এর সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীক দাঁড়িয়ে আছে এস্তোনিয়ার তাপা সামরিক ঘাঁটিতে—যা একসময় সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দাপটের সাক্ষ্য বহন করত, আর আজ তা ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রতিরক্ষার অন্যতম অগ্রবর্তী প্রাচীর। সেখানে ব্রিটিশ, ফরাসি ও এস্তোনিয়ান সেনারা একই পতাকার নিচে, একীভূত কমান্ড-কাঠামোয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; আক্রমণের মুখে তারা যেন এক শরীর, এক সংকল্প।
কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান সব সময়ই প্রশ্ন জাগায়। ন্যাটো কি শুধু ঘোষণায় দৃঢ়, নাকি প্রয়োজনে রক্ত ও আগুন দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে প্রস্তুত? পশ্চিমা কৌশলবিদেরা আশঙ্কা করছেন—রাশিয়া সরাসরি বৃহৎ আক্রমণে যাবে না; বরং ধীরে ধীরে, ছোট ছোট অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যাচাই করবে। এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন কিংবা পোল্যান্ডে রুশ ড্রোনের হঠাৎ অনুপ্রবেশ—এসব ঘটনা আসলে সেই পরীক্ষার খেলার অংশমাত্র।
রাশিয়ার কৌশল আসলে এক দীর্ঘমেয়াদি দাবার খেলা, যেখানে প্রতিটি চালের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—ন্যাটোর ঐক্যের ভেতর ফাটল ধরানো। ন্যাটোর সনদে অন্তর্ভুক্ত আর্টিকেল ফাইভ সেই অটল প্রতিশ্রুতির প্রতীক—‘একজনের ওপর আক্রমণ মানেই সবার ওপর আক্রমণ।’ এই প্রতিশ্রুতি ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর ইউরোপে শান্তির ভারসাম্য বজায় রেখেছে। কিন্তু পুতিন চাইছেন সেই অঙ্গীকারকে শুধু কাগুজে ঘোষণা হিসেবে প্রমাণ করতে।
পুতিনের কৌশল সরাসরি সর্বাত্মক সংঘাতে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়; বরং ছোট ছোট আক্রমণ, সীমান্ত অনুপ্রবেশ বা আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো সূক্ষ্ম উসকানির মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। এভাবে তিনি দেখাতে চান—জোটের প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়, ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাবে সেই প্রতিশ্রুতির ওপর, আর ভয়ের আবরণে তারা হয়ে উঠবে একাকী ও অসহায়।
ন্যাটোর প্রতিরক্ষাবলয়ের প্রাণকেন্দ্র নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশই আসে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে। আধুনিকতম যুদ্ধবিমান, উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্রশস্ত্র, স্যাটেলাইট নজরদারি—সব মিলিয়ে মার্কিন অবদান ছাড়া ন্যাটোর প্রতিরক্ষা যেন দেহহীন আত্মা। বিশেষত বাল্টিক অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি শুধু সামরিক শক্তিই নয়, বরং জোটের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দৃশ্যমান প্রমাণ।
তবু সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা এখানেই। ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে ইউরোপজুড়ে গভীর সংশয় বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, নাকি কূটনৈতিক আলোচনার আড়ালে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নেবে—এ প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। ইউরোপীয় নেতারা একদিকে মার্কিন শক্তির ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের নীতিগত অস্থিরতায় শঙ্কিত।
ইউরোপের বুকে, বাল্টিকের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো—এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া—শুধু মানচিত্রের দিক থেকে নয়, শক্তি হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে পুতিনের কৌশলগত খেলায় ন্যাটোর ঐক্য পরীক্ষা হচ্ছে। তবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও কানাডার মতো প্রধান শক্তিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করেছে—যেকোনো আক্রমণের মুখে তারা পিছিয়ে থাকবে না। পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের মতো সামরিকভাবে দৃঢ় দেশগুলোও জানে, বাল্টিকের পতন তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য কতটা ভয়ংকর হুমকি।
যুক্তরাষ্ট্র যতই দ্বিধাগ্রস্ত হোক না কেন, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা এই আঞ্চলিক সংকটকে বিশ্বমঞ্চে রূপান্তরিত করছে। ন্যাটো-রাশিয়া সম্পর্কের এই জটিলতা শুধু সামরিক ভারসাম্য নির্ধারণ করছে না, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শত্রুতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।
অস্থিতিশীলতা এবং বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগাতে চাইছেন পুতিন।
ব্যাপক অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের এই জটিল পরিস্থিতি ন্যাটো-রাশিয়া সম্পর্ককে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু আঞ্চলিক ভারসাম্য নয়, বিশ্বব্যাপী শক্তির ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করছে। পুতিনের খেলা তাই শুধুই কৌশল নয়; এটি একধরনের উচ্চ দাবির ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া, যার ফলাফল কেবল রাশিয়া নয়, পুরো ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ব ইতিমধ্যেই দেখেছে—২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে পুতিন কতটা বেপরোয়া হতে পারেন। এবার বাল্টিকের দিকে তাঁর দৃষ্টিপাত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি অশুভ সংকেত। ন্যাটো যদি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়, ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামো ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু ঐক্য শক্ত হলে, পুতিনের ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলই রাশিয়ার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এভাবেই বাল্টিকের ছোট রাষ্ট্রগুলো কেবল মানচিত্রের একাংশ নয়; তারা আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও শক্তির ভারসাম্যের পরীক্ষণশালার মতো। ন্যাটো-রাশিয়ার এই জটিল সম্পর্ক শুধু সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের সূক্ষ্ম খেলা। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, ভবিষ্যতের ইউরোপের নিরাপত্তা ও শক্তির নতুন সমীকরণ নির্ধারণ করছে। পুতিনের জুয়া তাই কেবল কৌশলগত নয়—এটি বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর একধরনের উচ্চ দাবির পরীক্ষা।
লেখক: আইনজীবী ও গবেষক
রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এখন ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলোর দিকে হাত বাড়াতে চাইছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে একটি প্রশ্ন, ন্যাটো আসলেই কতটা আন্তরিক ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এ ক্ষেত্রে। সেই প্রশ্নকেই যেন নতুন করে শাণিত করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি এস্তোনিয়ার আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে তিনি শুধু একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বই লঙ্ঘন করেননি; বরং পুরো ন্যাটোর প্রতিশ্রুতি, ঐক্য এবং সংকল্পকে এক কঠিন পরীক্ষায় ছুড়ে দিয়েছেন।
এটি নিছক সামরিক অনুপ্রবেশ নয়—বরং এক গভীর কৌশল, যা পশ্চিমা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শিকড়ে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে রচিত। পুতিন জানেন, ন্যাটোর শক্তি শুধু অস্ত্রের আধুনিকতায় নয়, বরং তার ঐক্য ও পারস্পরিক আস্থায় নিহিত। আর ঠিক সেই জায়গাটিই আজ পরীক্ষার মুখে। ন্যাটো কি সত্যিই প্রতিটি সদস্যের জন্য জীবন-মরণ লড়াইয়ে নামবে, নাকি অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও রাজনৈতিক দ্বিধা তাকে দুর্বল করে তুলবে?
এই প্রশ্ন শুধু বাল্টিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নয়, বরং গোটা ইউরোপীয় ভূ-রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কারণ, ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল হয়, তা বিশ্বকে জানিয়ে দেবে—আর্টিকেল ফাইভের পারস্পরিক প্রতিরক্ষার অঙ্গীকার বাস্তবে শুধুই কাগুজে প্রতিশ্রুতি। তখন ছোট রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে, আর মস্কোর প্রভাব একের পর এক সীমান্ত অতিক্রম করে বিস্তার লাভ করবে। আর যদি ন্যাটো ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তবে তা শুধু পুতিনকেই নয়, ভবিষ্যতের সব সম্ভাব্য আগ্রাসনকেও কঠোর বার্তা দেবে।
এস্তোনিয়ার আকাশে রুশ যুদ্ধবিমানের অনুপ্রবেশকে বিচ্ছিন্ন সামরিক ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এটি এক ভূ-রাজনৈতিক দাবার চাল, যার প্রতিটি পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে আগামী দিনের ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য।
ন্যাটো দীর্ঘদিন ধরে ঘোষণা দিয়ে আসছে—‘জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষায় আমরা অটল।’ এই ঘোষণা শুধু কূটনৈতিক শব্দচয়ন নয়, বরং পশ্চিমা প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষার মূল ভিত্তি। এর সবচেয়ে স্পষ্ট প্রতীক দাঁড়িয়ে আছে এস্তোনিয়ার তাপা সামরিক ঘাঁটিতে—যা একসময় সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দাপটের সাক্ষ্য বহন করত, আর আজ তা ব্রিটিশ নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর প্রতিরক্ষার অন্যতম অগ্রবর্তী প্রাচীর। সেখানে ব্রিটিশ, ফরাসি ও এস্তোনিয়ান সেনারা একই পতাকার নিচে, একীভূত কমান্ড-কাঠামোয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; আক্রমণের মুখে তারা যেন এক শরীর, এক সংকল্প।
কিন্তু প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান সব সময়ই প্রশ্ন জাগায়। ন্যাটো কি শুধু ঘোষণায় দৃঢ়, নাকি প্রয়োজনে রক্ত ও আগুন দিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে প্রস্তুত? পশ্চিমা কৌশলবিদেরা আশঙ্কা করছেন—রাশিয়া সরাসরি বৃহৎ আক্রমণে যাবে না; বরং ধীরে ধীরে, ছোট ছোট অনুপ্রবেশের মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া যাচাই করবে। এস্তোনিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন কিংবা পোল্যান্ডে রুশ ড্রোনের হঠাৎ অনুপ্রবেশ—এসব ঘটনা আসলে সেই পরীক্ষার খেলার অংশমাত্র।
রাশিয়ার কৌশল আসলে এক দীর্ঘমেয়াদি দাবার খেলা, যেখানে প্রতিটি চালের উদ্দেশ্য স্পষ্ট—ন্যাটোর ঐক্যের ভেতর ফাটল ধরানো। ন্যাটোর সনদে অন্তর্ভুক্ত আর্টিকেল ফাইভ সেই অটল প্রতিশ্রুতির প্রতীক—‘একজনের ওপর আক্রমণ মানেই সবার ওপর আক্রমণ।’ এই প্রতিশ্রুতি ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর ইউরোপে শান্তির ভারসাম্য বজায় রেখেছে। কিন্তু পুতিন চাইছেন সেই অঙ্গীকারকে শুধু কাগুজে ঘোষণা হিসেবে প্রমাণ করতে।
পুতিনের কৌশল সরাসরি সর্বাত্মক সংঘাতে ঝাঁপিয়ে পড়া নয়; বরং ছোট ছোট আক্রমণ, সীমান্ত অনুপ্রবেশ বা আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো সূক্ষ্ম উসকানির মাধ্যমে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করা। এভাবে তিনি দেখাতে চান—জোটের প্রতিক্রিয়া যদি দুর্বল বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়, ইউরোপের ছোট রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাবে সেই প্রতিশ্রুতির ওপর, আর ভয়ের আবরণে তারা হয়ে উঠবে একাকী ও অসহায়।
ন্যাটোর প্রতিরক্ষাবলয়ের প্রাণকেন্দ্র নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৪০ শতাংশই আসে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে। আধুনিকতম যুদ্ধবিমান, উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্রশস্ত্র, স্যাটেলাইট নজরদারি—সব মিলিয়ে মার্কিন অবদান ছাড়া ন্যাটোর প্রতিরক্ষা যেন দেহহীন আত্মা। বিশেষত বাল্টিক অঞ্চলে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি শুধু সামরিক শক্তিই নয়, বরং জোটের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দৃশ্যমান প্রমাণ।
তবু সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তা এখানেই। ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান নিয়ে ইউরোপজুড়ে গভীর সংশয় বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, নাকি কূটনৈতিক আলোচনার আড়ালে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নেবে—এ প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। ইউরোপীয় নেতারা একদিকে মার্কিন শক্তির ওপর নির্ভরশীল, অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের নীতিগত অস্থিরতায় শঙ্কিত।
ইউরোপের বুকে, বাল্টিকের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো—এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া—শুধু মানচিত্রের দিক থেকে নয়, শক্তি হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে পুতিনের কৌশলগত খেলায় ন্যাটোর ঐক্য পরীক্ষা হচ্ছে। তবে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও কানাডার মতো প্রধান শক্তিগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করেছে—যেকোনো আক্রমণের মুখে তারা পিছিয়ে থাকবে না। পোল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের মতো সামরিকভাবে দৃঢ় দেশগুলোও জানে, বাল্টিকের পতন তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য কতটা ভয়ংকর হুমকি।
যুক্তরাষ্ট্র যতই দ্বিধাগ্রস্ত হোক না কেন, ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সম্পৃক্ততা এই আঞ্চলিক সংকটকে বিশ্বমঞ্চে রূপান্তরিত করছে। ন্যাটো-রাশিয়া সম্পর্কের এই জটিলতা শুধু সামরিক ভারসাম্য নির্ধারণ করছে না, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শত্রুতা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নতুন সমীকরণ তৈরি করছে।
অস্থিতিশীলতা এবং বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের অনিশ্চয়তাকে কাজে লাগাতে চাইছেন পুতিন।
ব্যাপক অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের এই জটিল পরিস্থিতি ন্যাটো-রাশিয়া সম্পর্ককে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভঙ্গুর ও অনিশ্চিত করে তুলেছে। প্রতিটি পদক্ষেপ শুধু আঞ্চলিক ভারসাম্য নয়, বিশ্বব্যাপী শক্তির ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করছে। পুতিনের খেলা তাই শুধুই কৌশল নয়; এটি একধরনের উচ্চ দাবির ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া, যার ফলাফল কেবল রাশিয়া নয়, পুরো ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্ব ইতিমধ্যেই দেখেছে—২০২২ সালে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়ে পুতিন কতটা বেপরোয়া হতে পারেন। এবার বাল্টিকের দিকে তাঁর দৃষ্টিপাত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি অশুভ সংকেত। ন্যাটো যদি ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হয়, ইউরোপের নিরাপত্তাকাঠামো ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু ঐক্য শক্ত হলে, পুতিনের ঝুঁকিপূর্ণ কৌশলই রাশিয়ার জন্য বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এভাবেই বাল্টিকের ছোট রাষ্ট্রগুলো কেবল মানচিত্রের একাংশ নয়; তারা আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও শক্তির ভারসাম্যের পরীক্ষণশালার মতো। ন্যাটো-রাশিয়ার এই জটিল সম্পর্ক শুধু সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের সূক্ষ্ম খেলা। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, ভবিষ্যতের ইউরোপের নিরাপত্তা ও শক্তির নতুন সমীকরণ নির্ধারণ করছে। পুতিনের জুয়া তাই কেবল কৌশলগত নয়—এটি বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর একধরনের উচ্চ দাবির পরীক্ষা।
লেখক: আইনজীবী ও গবেষক
তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ, সরকার পতনের ঘটনা এখনো সবার মনে আছে। কেন সে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেটাও অজানা নয় কারও। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দেশ ছেড়ে পলায়ন, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে তাঁর বিছানায় শুয়ে বিক্ষোভকারীদের ছবি তোলা...
৪ ঘণ্টা আগেসাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তৃতার ভাষাও পাল্লা দিয়ে কঠোর হয়ে উঠছে। এই কঠোর ও আক্রমণাত্মক বাগাড়ম্বর কেবল বিতর্ক বা মতাদর্শগত লড়াইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে বাস্তব সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
৪ ঘণ্টা আগেমানিকগঞ্জের এক স্বর্ণকারের মাথায় সোনালি বুদ্ধির ঝলক দেখা গেল! স্বর্ণের কারিগর শুভ দাস শুধু গয়নাই গড়ান না, সোনার দোকানের এই মালিক ‘নাটক’ রচনাতেও নাম লেখালেন ‘বুদ্ধি’ করে। নিজ দোকানে গচ্ছিত সোনা কবজা করে নিতে তিনি সাজালেন ডাকাতির এক মহাকাব্য।
৪ ঘণ্টা আগে১৯০৫ থেকে ১৯৪৭—এই সময়কালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রধান ধারাটি ছিল জাতীয়তাবাদী; তবে জাতীয়তাবাদের ভেতর ভয়ংকরভাবে প্রবেশ ঘটেছিল সাম্প্রদায়িকতার, ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম বিভক্ত হয়ে গেছে, এবং যে মুক্তি স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, সেটি অর্জিত হয়নি। মুক্তির অর্থ ছিল ধর্ম, শ্রেণি ও বর্ণনির্বিশেষে
১ দিন আগে