Ajker Patrika

আমাদের চাপাবাজি

মামুনুর রশীদ
আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২১, ১৭: ২৩
আমাদের চাপাবাজি

অনেক দিন আগে টেলিভিশনের জন্য আমি একটি নাটক লিখেছিলাম। নাটকটির নাম ‘ঝগড়ালি’। নাটকটি তখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইউটিউবে আশি লাখ দর্শক নাটকটি দেখেছে। নাটকের বিষয় ছিল, গ্রামবাংলায় ঝগড়া করার জন্য লোক ভাড়া করা হতো। ভাড়াটে লোকেরা ঝগড়া করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করত এবং বিভিন্ন সালিসে তারা জিতে যেত। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যও গ্রামে লোক পাওয়া যেত। ঘটনাগুলো দেখানো হয়েছে বেশ কিছুদিন আগের। কিন্তু সাম্প্রতিককালে একটি ঘটনা শুনে আমি অপরাধবোধে ভুগেছি। এখন যেকোনো সালিসের জন্য গ্রামে চাপাবাজ ভাড়া করা হয়।

যেকোনো সালিসে উভয় পক্ষের চাপাবাজেরা উপস্থিত হয়, তাদের বিশেষ পোশাক থাকে, সাধারণত লুঙ্গি ও গামছা। তারা একে একে বিষয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে অতিরঞ্জিত করে বক্তব্য দিতে থাকে। যারা সালিস করেন, তাঁরা এসব বক্তব্য শুনে বিচার করে থাকেন। সবশেষে রায় দেওয়ার পর যে পক্ষ জিতে যায়, সেই পক্ষের চাপাবাজ কিছু বাড়তি টাকা পেয়ে যায়।

যে গ্রাম থেকে আমি এ ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছি, তাতে জানা গেছে, ওই চাপাবাজেরা যথেষ্ট সচ্ছল এবং প্রতিদিন তাদের তিন থেকে চারটি সালিসে যেতে হয়। এবং গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পেয়ে থাকে। আমি এই ঘটনার পর ভাবতে শুরু করেছি যে আমার ওই নাটকটির প্রভাব পড়ল কি না? এবং কেউ কেউ নাটকটি দেখে এই পেশাকে বেছে নিয়েছে কি না? কিন্তু তখনই মনে পড়ল, স্কুলে আমরা একটি ছোটগল্প পড়েছিলাম। লেখকের নাম মনে নেই, তবে গল্পটি ছিল এ রকম যে, দুজন ইংরেজি জানা লোকের মধ্যে গ্রামে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কয়েক গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে একটা মাঠে। একজন আরেকজনকে ইংরেজি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করবে, যে লোক পারবে না, তাকে পরাজিত বলে ঘোষণা করা হবে। প্রথমে টসের মাধ্যমে এই প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রথম জন দ্বিতীয় জনকে জিজ্ঞাসা করল Horn’s of dilemma-এর অর্থ কী? দ্বিতীয় জন চটপট উত্তর দিয়ে দিল। উভয়সংকট। এমনিভাবে প্রশ্নোত্তর চলতে চলতে একসময় একজন প্রশ্ন করল, ‘আই ডোন্ট নো’ বাক্যের অর্থ কী? তখন অন্যজন বলে উঠল, ‘আমি জানি না’। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে জনতা উল্লাস করে উঠল যে ওই লোক জানে না, কাজেই সে পরাজিত হয়ে গেল। অর্থাৎ সে সঠিক উত্তরটি দিয়েও পরাজিত হয়ে গেল। এখন সমস্যা হচ্ছে, চাপাবাজেরা শুধু তথ্যের ভিত্তিতে বাদানুবাদ করে না, এর মধ্যে হাস্যরসও যোগ করে। মুখে মুখে ছড়া কাটে, মাঝে মাঝে সংগীতেরও অবতারণা করে।

একসময় গ্রামবাংলায় কবিগান হতো, কোনো একটি বিষয়বস্তু নিয়ে দুই কবির মাঝে লড়াই হতো। লড়াই শেষে একজন কবি বিজয়ী হতেন। শত শত দর্শক কবিগান দেখে নির্মল আনন্দ পেত। কিন্তু বর্তমানে চাপাবাজি একেবারে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। মিথ্যাকে সত্য ও সত্যকে মিথ্যা করার প্রবণতা যেন একটি জাতীয় প্রবণতার পর্যায়ে চলে এসেছে। বিজ্ঞাপন ব্যবসায় নানা কৌশলের মারপ্যাঁচে এটি আরও সূক্ষ্ম রূপ পেয়েছে। মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রে দেখা যায়, ভুয়া ডাক্তার সেজে বহুদিন প্র্যাকটিস করার পর সে ধরা পড়ছে। এমনকি তার পদবির মধ্যে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ র‍্যাঙ্কও থাকছে। আমি যে ঘটনাটার উল্লেখ করলাম, তাতে চাপাবাজেরা নিজেদের চাপাবাজ বলেই অভিহিত করছে। কিন্তু অন্যরা অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতার মতো চাপাবাজি করে মানুষের ক্ষতিসাধন করছে। কারও কারও ক্ষেত্রে শিশু বয়স থেকেই বাড়িয়ে বলার একটা প্রবণতা দেখা গেছে। আমাদের পুঁথি সাহিত্যেও তার নজির আছে। যেমন,

লাখে লাখে সৈন্য মরে
কাতারে কাতার,
শুমার করিয়া দেখি চল্লিশ হাজার।
অথবা
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল।

আমাদের পাশের গ্রামে একবার কোনো এক বিত্তবান লোকের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর একটা দাওয়াত হয়েছিল। সেই দাওয়াতে পাঁচ হাজার লোক অংশ নিয়েছিল। দাওয়াত খেয়ে যখন তারা ফিরছিল, তখন তারা বলতে বলতে গেল যে, লাখ লাখ লোক ওখানে উপস্থিত হয়েছিল। এবং তারা সবাই পেট ভরে খাবার খেয়েছে। গ্রামবাংলায় ‘তিলকে তাল করা’রও একটা প্রবাদ আছে। রাজনীতির চাপাবাজি অনেকটা স্বীকৃত। নিজের দল অথবা নিজের প্রার্থীর পক্ষে নানা ধরনের অতিরঞ্জিত বক্তব্য এবং বিপক্ষ লোকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কুৎসা একেবারে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। জনগণ একটা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে এবং কারও কারও জীবনে এ বিভ্রান্তিটি শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যায়। এ সমস্যাটি বাঙালির জীবনের, সুদূর অতীতের? হয়তোবা।

দিল্লির রাজত্বকালে একটি সংবাদ বাংলার কোনো গ্রামে আসা পর্যন্ত তার অনেক ডালপালা ছড়িয়ে যেত। সৃজনশীল বাঙালি নানা ধরনের গুজব রটাতেও অভ্যস্ত। যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ার কারণে বিষয়গুলো আরও বেশি মাত্রা যোগ করে। আবার একসময়ে কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কোনো তথ্য না আসার ফলে ওই গ্রামের মানুষ দুর্ভিক্ষে বা অনাহারে প্রাণও দিয়েছে। অনেক গবেষক এ কথাও বলেছেন যে, গণযোগাযোগব্যবস্থা প্রসারিত হলে দুর্ভিক্ষ হবে না। একসময়ে রংপুরে মঙ্গার কারণে প্রতিবছরই বহু মানুষ মারা যেত। তথ্যের প্রবাহের কারণে এখন তা বহুলাংশে কমে গেছে।

চাপাবাজির মধ্যে বিনোদন থাকে, মানুষ বিনোদন চায়ও। কিন্তু প্রতিবেশীর বাড়িতে হামলা হলো, ঘর-বাড়ি ভাঙচুর হলো, কাউকে আহত করা হলো—এ বিষয়টি নিয়েও যখন চাপাবাজির মাধ্যমে সালিস হয়, তখন কি প্রকৃত সত্যকে আবিষ্কার করা সম্ভব? নাটকের কাজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। জাপানের কোনো শিশুকে আমি অতিরঞ্জন করতে দেখিনি। এবং প্রাপ্তবয়স্ক কোনো লোককে নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতেও দেখিনি। পাশ্চাত্য দেশেও তা-ই। অর্থাৎ পারিবারিক শিক্ষা, স্কুল-কলেজে শিক্ষা এবং সর্বোপরি সামাজিক শিক্ষা পাওয়া একটি মানুষ সত্যের দিকে ধাবিত হওয়ার ফলে রাজনীতিবিদেরাও নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে পারেন না, অতিরঞ্জন করতে পারেন না। আমাদের দেশে এসবের একটা বড় ব্যতিক্রম হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যাঁরা রাজনীতিতে এসেছেন, দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন, তাঁরাও নানা ধরনের হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অসত্যকে প্রচার করেছেন, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারণার সময়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় গুজব সৃষ্টিতে। গুজব তৈরি করা এবং গুজব শোনায় আমাদের প্রবল আনন্দ। শিক্ষাব্যবস্থা, কারিকুলাম ও সিলেবাস নির্মাণে যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা পাঠ্যপুস্তকে এমন সব লেখা বা এমন সব অঙ্ক  (ভেজালের অঙ্ক) শিখিয়ে থাকেন, যাতে ছাত্ররা প্রথমেই সত্য প্রচারে বিমুখ হতে থাকে। যে যত নিজের সম্পর্কে বাড়িয়ে বলতে পারে, সেই ব্যক্তিই সমাজে বেশি জনপ্রিয় হয়। প্রবাদ আছে ‘নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হয়’। অন্য কেউ বাজালে ঢোলটা ফেটে যেতে পারে। এসব আপ্তবাক্য মানুষকে মিথ্যার আশ্রয়ে গড়ে তোলে। আমি এখন একটি নাটক লিখছি, পলাশী যুদ্ধের পরের কাহিনি নিয়ে। সেখানে ঐতিহাসিকদের মধ্যে সত্য ঘটনা নির্ধারণ নিয়ে বিরাট সংকট দেখতে পাচ্ছি। ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে তথ্যের এত হেরফের, সঠিক তথ্যের আভাস আমি পাচ্ছি না। ভারতের অন্য ভাষাভাষীর লোকদের সব সময়ই একটা আপত্তি ছিল যে, বাঙালিরা সব কাজেই ভালো কিন্তু তারা বেশি নিজেদের ঢোল বাজায়। কথাটি সত্য বটে, কিন্তু এই অযথা প্রমোশনের ফলে আসল ভালোটা আমরা জানতে পারি না। নকল ভালোটাই প্রাধান্য পেয়ে যায়। অনাগতকালের কোনো গবেষক যদি আমাদের আজকের সমাজ থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বসে অসংখ্য মিথ্যের মাঝে সত্য আবিষ্কার করতে চান, তবে তাঁর জন্য সেটা হবে খুব কষ্টকর। আজকে চাপাবাজির নিচে সত্য আবিষ্কার হয়তো হবে একেবারেই অসম্ভব।      

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত