Ajker Patrika

তখন তোমার ২১ বছর বোধ হয়...

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৩: ২৬
তখন তোমার ২১ বছর বোধ হয়...

যে বয়সে শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস-জীবনে প্রবেশ করে, সেই বয়সের দারুণ এক ছবি আঁকা আছে এ গানে। ক্যাম্পাস মানে ছক কাটা চেনা জীবন ও গণ্ডির বাইরে অদেখা-অচেনা এক নতুন জগৎ। ফলে এ জীবনে খানিক হোঁচট খাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কথায় বলে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে নাকি রক্ষা করা কঠিন। কাজেই ক্যাম্পাস-জীবনের স্বাধীনতার পাশাপাশি চোরাবালিও রয়েছে। আর সেখানে আছে বিপজ্জনক বন্ধুর প্রভাব। বন্ধুর আচরণ মানুষের নিজের আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে।

নেতিবাচকতার অনুসরণ ও অনুকরণ
দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর আচরণ, যেমন বিভিন্ন মাদকের অপব্যবহার, দল বেঁধে জাঙ্ক ফুড খাওয়া ইত্যাদির ব্যাপক অনুকরণ হয়। ১৯৪০ সালে হৃদ্‌রোগ নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, এক ব্যক্তির স্থূল হয়ে ওঠার আশঙ্কা ৫৮ শতাংশ বেশি হয়, যদি তার বন্ধু মহলে কেউ স্থূল হয়ে ওঠেন। ফলে বিপজ্জনক প্রবণতার অনুসরণ একধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে জীবনে।

তা যে শুধু আচরণগত বিষয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা-ই নয়, শারীরিক বিভিন্ন সমস্যাও তৈরি করে। বর্তমানে অসংক্রামক ব্যাধি, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃৎপিণ্ডের অসুখ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ ইত্যাদি সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এটা ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর কারণ। ফলে নিয়মিত দৈহিক ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ এখন। বন্ধুরা কি বসে বসে আড্ডাই দিচ্ছে, নাকি এই দৈহিক পরিশ্রমকে স্বাগত জানাচ্ছে—সেই ভাবনা এখন খুব জরুরি। দীর্ঘ সময় বসে থাকলে স্থূলতার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং অতিরিক্ত চর্বি শরীরে, বিশেষ করে কোমরের চারপাশে জমে, যা অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরল বাড়ায়। সিটিং ডিজিজ এখন একটি নীরব মহামারি। এগুলো থেকে সচেতন থাকতে হবে। 

বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের মেজাজকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যাম্পাস-জীবনে ধূমপান মহামারি আকার ধারণ করার সেটাও একটা কারণ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব
এ সময় মন খারাপের ঘটনা কিন্তু অদৃশ্যভাবে চলতে থাকে। এই আবেগীয় সংক্রমণটি এখন আর মুখোমুখি সীমাবদ্ধ নেই বন্ধুদের মধ্যে। এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রভাব ফেলে। সাত লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর ওপর সম্প্রতি এক গবেষণা হয়। সেখানে ব্যবহারকারীর নিউজফিড বিশেষভাবে ফিল্টার করা হয়। একটিতে ব্যবহারকারীদের নিউজফিডে ইতিবাচক পোস্ট কমিয়ে দেওয়া হয়, অন্যটিতে নেতিবাচক পোস্ট কমিয়ে দেওয়া হয়। দেখা গেছে, যাঁরা ইতিবাচক পোস্ট পেয়েছেন, তাঁরা নিজেরাও ইতিবাচক পোস্ট দিচ্ছেন। ঠিক নেতিবাচক পোস্ট যাঁরা বেশি দেখেছেন, তাঁরা নেতিবাচক লিখছেন বেশি। ফলে এখন গবেষণায় বলা হচ্ছে, সামনাসামনি দেখা না হলেও মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দ্বারাও আবেগীয়ভাবে সংক্রামিত হচ্ছে।

এ পর্ব মা-বাবার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। ফলে তাঁরা সন্তানদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন না। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া সন্তান এবং মা-বাবার মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। এই দূরত্বের চাহিদা মেটাতে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়াটি আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছেন বন্ধুদের ওপর। বন্ধুরা ইতিবাচক হলে তার প্রভাব ভালো হচ্ছে। নেতিবাচক হলে তার প্রভাব হচ্ছে ভয়াবহ। মা-বাবার সঙ্গে এই দূরত্ব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে উভয় পক্ষকেই।

মানবিক সম্পর্ক ও আত্মহত্যার প্রবণতা
বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন মানুষের মানবিক সম্পর্ক এবং এর জটিলতাকে নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করায়। চলে আসে প্রেম, ব্রেকআপ ইত্যাদি। ইদানীং প্রেমের এই সম্পর্কের ধরন বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। ফলে সমস্যা আরও বাড়ছে। তার ওপর সহজলভ্য ইন্টারনেট বর্তমান কসমোপলিটন কালচারকে স্মার্টনেসের প্রতীক বিবেচনা করে। ফলে গর্ভপাতসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। 

ইদানীং অধিকাংশ পরিবার নিউক্লিয়ার বা একক পরিবার। এসব পরিবারের সন্তানেরা ছোটবেলা থেকেই আলাদা রুম, অন্তত আলাদা বিছানা পেয়ে এসেছে। ফলে আশা করে, সবকিছুই মা-বাবা তাদের মুখের সামনে গুছিয়ে দেবেন। এই সন্তানেরা যখন ঘরের বাইরে কোনো না কোনো ক্যাম্পাসে চলে যাচ্ছেন, তখন সবকিছু আশানুরূপ না হওয়ায় খুব সহজে হতাশা বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁরা জানেন না কীভাবে হতাশা আর বিষণ্নতাকে সামাল দেওয়া যায়। উপরন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্টুডেন্ট কাউন্সেলরও নেই, যিনি আবেগের ব্যাপারটি বুঝতে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবেন। কাজেই এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা খুবই প্রয়োজন। গবেষণা উপাত্তে পাওয়া গেছে, বাংলাদেশে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বিষণ্নতায় ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে নারী অধিকাংশ এবং প্রথম বর্ষের ছাত্ররা বেশি। 

এর সঙ্গে যে জিনিসটি না বললেই নয়, সেটি আত্মহত্যার প্রবণতা। আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন এমন প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, যিনি আত্মহত্যা করছেন, তিনি নিজেও কিন্তু মুহূর্তের চিন্তায় তা করছেন। তাঁর পাশের বন্ধুটিও কিন্তু জানছেন না যে তাঁর মাথায় কী চলছে।

হাত বাড়িয়ে ছুঁই, মন বাড়িয়ে ছুঁই 
এই প্রবণতা আমাদের কমে গেছে। কিন্তু জীবনের শুরুতে মানবিক হতে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। কোনো বন্ধু যদি হঠাৎ করে চুপ হয়ে যায়, মন খারাপের কথা বলে, ফেসবুকে নেতিবাচক স্ট্যাটাস দেন, তবে তাঁকে কাউন্সেলিংয়ে যেতে বলা বা নিয়ে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। এই চিন্তাগুলো শিক্ষার্থীদের মাথায় ঢোকানো এখন খুবই প্রয়োজন। একটা মানুষ কখনোই আত্মহত্যা করতে চায় না। যখন সে আর কিছুতেই বর্তমানের যন্ত্রণাকে নিতে পারে না, তখন নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এই সময়টুকু যদি পাশের বন্ধুটি তার হাত ধরে, মানুষটিকে কিন্তু ফিরে পাওয়া সম্ভব।

ক্যাম্পাস এক দারুণ জায়গা, জীবনের দারুণ সময়। এ সময় ও জায়গাটিকে উপভোগ করতে হবে বুঝে-শুনে, সতর্কতার সঙ্গে। নেতিবাচক অনুকরণ নয়; বরং সৃষ্টিশীলতার পুরোটা ঢেলে সাজাতে হবে এ সময়। তাতেই উপভোগ্য হয়ে উঠবে সবকিছু।

লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সেলর সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

নিজের প্রস্রাব পান করে ‘আশিকি’ অভিনেত্রী অনু আগারওয়াল বললেন, ‘আহা অমৃত’

মে. জে. ফজলুরের সেভেন সিস্টার্স দখলের মন্তব্য সমর্থন করে না সরকার: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে স্টারলিংকের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের বিস্তারিত চায় ভারত

গায়ে কেরোসিন ঢেলে কলেজছাত্রীর আত্মহনন, পলাতক ইমাম গ্রেপ্তার

সরকারি মাধ্যমিকের সহকারী শিক্ষকেরা পাচ্ছেন গেজেটেড মর্যাদা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত