Ajker Patrika

রবিউল আউয়ালের শেষ জুমা: জীবনের পথনির্দেশ

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইসলামের প্রতিটি মাসেরই রয়েছে নিজস্ব মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য। তবে মুসলিম উম্মাহর জীবনে রবিউল আউয়াল মাসটি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি কেবল একটি সাধারণ মাস নয়, বরং এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভাগমনকে, যিনি মানবজাতিকে সত্য, ন্যায়, দয়া, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার মতো অমূল্য মানবিক শিক্ষা প্রদর্শন করেছেন। নবীজির জীবন ও আদর্শ আমাদের জন্য সারা জীবনের পথনির্দেশ।

রবিউল আউয়াল মাসের শেষ জুমা আমাদের মনে করিয়ে দেয় নবীজির আদর্শ অনুসরণের গুরুত্ব। যদিও শরিয়তে এই দিনের জন্য কোনো বিশেষ আমল নির্দিষ্ট নেই, তবু এটি আত্মপর্যালোচনা, তওবা এবং নবীর সুন্নাহ অনুসরণের প্রতিজ্ঞা করার এক অনন্য সুযোগ। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা বছরের বাকি সময়গুলোতে নবীজির শিক্ষা কতটা বাস্তবায়ন করেছি। এই শেষ জুমার শিক্ষা হলো, ইমান ও আমল, ন্যায় ও সত্যবাদিতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা যেন শুধু ধর্মীয় কার্যকলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমাদের নৈতিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।

শেষ জুমার শিক্ষা ও তাৎপর্য

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকালকে আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সুরা আহজাব: ২১)

এই আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, রাসুল (সা.)-এর জীবন আমাদের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এটি শুধু রবিউল আউয়াল বা বিশেষ কোনো দিনের জন্য নয়, বরং আমাদের সারা জীবনের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। নবীজির জীবন থেকে আমরা শিখি কীভাবে ন্যায়ের পথে চলতে হয়, সত্যের সঙ্গে অটল থাকতে হয় এবং মানবিক মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখতে হয়।

সারা বছরের দায়িত্ব

১. ইমান ও আমল দৃঢ় রাখা: ইসলামের ভিত্তি হলো পাঁচটি স্তম্ভ: কালিমা, নামাজ, জাকাত, রমজানের রোজা ও হজ। এই স্তম্ভগুলো আমাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল করে তোলে। ইমান ও আমল দৃঢ় থাকলে আমরা নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বের প্রতি সচেতন থাকি। নামাজ, রোজা ও হজ আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতা নিয়ে আসে, যা নৈতিক মূল্যবোধকে মজবুত করে।

২. সুন্নাহ অনুসরণ: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাহকে ভালোবাসে, সে আমাকে ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসে, সে জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।’ (জামে তিরমিজি: ২৬৭৮)। সুন্নাহ অনুসরণ শুধু ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা চর্চার নির্দেশনা দেয়।

৩. সত্যবাদিতা ও ন্যায়ের চর্চা: রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সত্যবাদী হও, কারণ সত্যবাদিতা মানুষকে নেকির দিকে নিয়ে যায় এবং নেকি মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যায়।’ (সহিহ্ মুসলিম: ২৬০৭)। সত্যবাদিতা সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তিগত জীবনে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। একজন সত্যবাদী ব্যক্তি কেবল নিজের জন্য নয়, বরং সমাজের জন্যও আলোর দিশারি হিসেবে কাজ করে।

৪. মানবসেবা ও সহমর্মিতা: মানবসেবা কেবল দান-সদকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের প্রতিদিনের আচরণ, সহানুভূতি ও সততার মধ্যেও প্রকাশ পায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে মানুষের উপকারে আসে।’ (আল-মুজামুল আউসাত, তাবারানি: ৫৭৮৭)। এই শিক্ষা মুসলিম সমাজকে শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল করে এবং ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করে।

৫. ভ্রাতৃত্ব ও সহনশীলতা: আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা একে অপরের ভাই।’ (সুরা হুজুরাত: ১০)। ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহনশীলতা ব্যক্তি ও সমাজকে শক্তিশালী করে। পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ঈর্ষা পরিহার করে আল্লাহর বান্দা হিসেবে একে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব।

৬. দাওয়াত ও সত্য প্রচার: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রভুর পথে আহ্বান করো প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।’ (সুরা নাহল: ১২৫)।

রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।’ (সহিহ্ বুখারি: ৩৪৬১)। দাওয়াত আমাদের দায়িত্বশীল ও সচেতন মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলে। এটি কেবল প্রচার নয়, বরং সঠিক পথে চলার আহ্বান এবং নৈতিক শিক্ষার বিস্তার।

আত্মপর্যালোচনা ও পরিবর্তন

রবিউল আউয়ালের শেষ জুমা আমাদের আত্মবিশ্লেষণের এক অনন্য সুযোগ। এই দিনে আমাদের উচিত নিজেদের আত্মার হিসাব নেওয়া এবং নতুন বছরে নবীজির সুন্নাহ অনুযায়ী জীবনযাপনের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়া। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের আত্মার হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।’ (জামে তিরমিজি: ২৪৫৯)

রবিউল আউয়ালের শেষ জুমা আমাদের জন্য আত্মবিশ্লেষণ এবং নতুন প্রতিজ্ঞার এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। নবীজির জীবন আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা এবং মানবসেবার চর্চা ব্যক্তি ও সমাজে শান্তি ও কল্যাণ আনতে পারে। আসুন, এই শেষ জুমার দিনে আমরা নিজেদের আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক উন্নতিতে মনোনিবেশ করি এবং সারা বছর নবীজির আদর্শ অনুসরণের দৃঢ় সংকল্প করি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তৌকীর-বিপাশা বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন যে কারণে

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত