Ajker Patrika

যুদ্ধবিরতি নিয়ে সন্দিহান, জীবন ও ঘর পুনর্গঠনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফিলিস্তিনিরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০: ২৮
যুদ্ধবিরতির খবর শোনার পর গাজার তরুণদের উচ্ছ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতির খবর শোনার পর গাজার তরুণদের উচ্ছ্বাস। ছবি: সংগৃহীত

গাজা উপত্যকার মানুষ আজ সকালে এক দীর্ঘ প্রতীক্ষিত খবরে জেগে উঠেছে—হামাস ও ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ‘প্রথম ধাপের’ শান্তিচুক্তিতে রাজি হয়েছে। এই চুক্তি হয়তো অবরুদ্ধ এই উপকূলীয় অঞ্চলে চলমান গণহত্যার সমাপ্তি ঘটাবে।

গাজার নুসেইরাত শিবিরে বাস্তুচ্যুত গাজার তরুণী রোবা প্রথমে খবরটি বিশ্বাসই করতে পারেননি। তিনি তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাস করতে পারেননি যে, সত্যিই এটা ঘটছে। রোবা আগেও একাধিকবার যুদ্ধবিরতির অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, যেগুলো খুব দ্রুত ভেঙে গেছে।

সর্বশেষ জানুয়ারিতে একটি যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, কিন্তু মার্চেই ইসরায়েল আবার হামলা শুরু করে। তিনি বলেন, ‘আমি খুব দ্রুত উদ্‌যাপন করতে চাই না। এই গণহত্যার পর কিছুই আগের মতো নেই। বাড়িঘর, অবকাঠামো, স্কুল, শিশুদের জন্য কোনো জায়গা—কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’

ইসরায়েলি হামলায় রোবার ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজার ৯০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবন এখন ভাঙা স্তূপে পরিণত। কাজহীন ও বাস্তুচ্যুত রোবা বলেন, সামনে কী আছে তা নিয়েও নিশ্চিত নন। তিনি বলেন, ‘কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না, সামনে কোনো ভবিষ্যৎও নেই। আমাদের যা অপেক্ষা করছে, তা হয়তো গত দুই বছরের মতোই কঠিন হতে পারে।’

চুক্তিতে বন্দিবিনিময় ও ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে বলেছেন, ‘দৃঢ়, স্থায়ী ও চিরস্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।’ মিশরের অবকাশ যাপন কেন্দ্র শারম আল-শেখে এই চুক্তি ঘোষণা করা হয়। এতে মধ্যস্থতা করেছে তুরস্ক, মিশর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র। সংশ্লিষ্ট সবাই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে দীর্ঘদিনের অবরোধে ক্ষতবিক্ষত গাজার বাসিন্দাদের আশা এখনো ভরপুর ক্লান্তি আর শঙ্কায়।

গাজার স্থপতি মোহাম্মদ সোহাইল এ ঘটনাকে বলেছেন ‘এক স্বস্তির মুহূর্ত’। তিনি মনে করেন, দুই বছরের ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ২ লাখ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর এটা বড় পরিবর্তন। তবে তিনি সতর্কও। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক ব্যর্থ যুদ্ধবিরতি দেখেছি। কিন্তু এবার আমি বিশ্বাস করতে চাই, আমরা ঘর গড়তে পারব—আর জীবনও।’

সোহাইল আশা প্রকাশ করেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে পুনর্গঠনকাজে যুক্ত হতে পারবেন। তিনি বলেন, ‘যদি সত্যিই আরব দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমর্থন দেয়, গাজা দ্রুত আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে।’ সোহাইল বলেন, পুনর্গঠন শুধু অবকাঠামো দিয়ে নয়, মানুষের ভেতর থেকেই শুরু করা উচিত।

সোহাইল আরও বলেন, ‘আমরা অন্তত মানবিক মনোবল আর শহর দুটোই আবার গড়তে পারি।’ তাঁর এই আশাবাদ জাতিসংঘের আহ্বানের সঙ্গেই মেলে। সংস্থাটি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও জরুরি অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য ৭০০ কোটি ডলারের পরিকল্পনা দিয়েছে। তারা বলছে, এটাই শান্তি ও পুনরুদ্ধারের ভিত্তি।

১৯ বছর বয়সী তরুণ ইব্রাহিম যুদ্ধ শুরুর আগে উচ্চমাধ্যমিকে ৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। তিনি জানান, ইসরায়েলি হামলা থামতে পারে শুনে তিনি আনন্দিত। তিনি বলেন, ‘গণহত্যা আমাকে দুই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেয়নি, কিন্তু এটা আমার দৃঢ় মনোবল ভাঙতে পারেনি।’

ইব্রাহিম চান বিদেশে গিয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। এ জন্য তিনি ইংরেজি শেখায় মন দিচ্ছেন, যেন বৃত্তি পান। তিনি চান আন্তর্জাতিক সহায়তা যেন গাজার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করে। তিনি বলেন, ‘আমরা দুই বছরের শিক্ষা হারিয়েছি। কিন্তু এখানকার তরুণেরা দৃঢ়। আমাদের শুধু আবার শুরু করার সুযোগটা দরকার।’

ইউনিসেফের হিসাবে, গত দুই বছরে গাজায় ৬৪ হাজার শিশু নিহত বা আহত হয়েছে। তারা এই যুদ্ধকে বলছে ‘এক নারকীয় অভিজ্ঞতা, যা পুরো এক প্রজন্মকে ধ্বংস করেছে।’

কেন্দ্রীয় গাজায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি ত্রাণকর্মী ইযাদ আমাউই বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, তাঁর ভেতরে এখন ‘আনন্দ-দুঃখ, স্মৃতি—সব মিশে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, আবার করি না।’ বছরের পর বছর যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতির খবর শোনার মানসিক ভার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

আমাউই আশা করেন, চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে। মানুষ আবার ঘরে ফিরতে পারবে, আর জীবনযাত্রা ও আশাকে নতুন করে শুরু করতে পারবে। তবে তার সবচেয়ে বড় ভয়, ইসরায়েল হয়তো বাস্তবায়নে বাধা দেবে। তিনি বলেন, ‘গাজার মানুষের চোখ এখন বিশ্বসম্প্রদায়ের দিকে। তারা কীভাবে গাজাকে পুনর্গঠনে সহায়তা করবে, সেটাই মূল বিষয়। আমাদের এখানে সবকিছু ঠিক করতে হবে, বিশেষ করে মানসিক ক্ষত সারাতে হবে। তবেই আমরা জীবন চালিয়ে যেতে পারব।’

আমাউই চান যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে দ্রুত গাজা শহরে ফিরে যেতে। সেখানে পুনর্বাসনের কাজেও যুক্ত হবেন। তিনি জানান, যুদ্ধবিরতির খবর গাজায় গভীর রাতে এসেছে, তখন অনেকেই ঘুমাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘উদ্‌যাপন হবে বড়। তবে দুঃখ ও দুশ্চিন্তাও বড় হবে।’ সারা বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের আপনাদের দরকার।’

দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকায় পুরো রাত ছিল প্রত্যাশা। এএফপি জানিয়েছে, ঘোষণার আগেই সেখানে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি আর উল্লাসে আকাশ ভরে যায়, চলে গুলি ছুড়ে উদ্‌যাপন। উত্তর গাজা থেকে উৎখাত হওয়া ৫০ বছর বয়সী মোহাম্মদ জামলুত বলেন, ‘আমরা প্রতিটি খবর, প্রতিটি আপডেট চোখে চোখে রাখছি।’ কিন্তু এদিকে মানবিক সহায়তা কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এখনো ভয়াবহ। গণহারে বাস্তুচ্যুতি, ব্যাপক ক্ষুধা আর চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়া এখনো চলমান।

জাতিসংঘ তাৎক্ষণিক ও বাধাহীন ত্রাণসহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মতে, শান্তি টেকসই করতে হলে বৃহৎ পরিসরে পুনর্গঠন অপরিহার্য। এখন রোবা, মোহাম্মদ, ইব্রাহিম, জামলুত আর ইযাদের মতো মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদ ও নতুন শান্তির আশার মাঝে এক ভঙ্গুর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছেন। এবারের শান্তি সত্যিই টিকে থাকবে কি না, সেই অপেক্ষায় তারা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ, শান্তি রক্ষা মিশনের এক-চতুর্থাংশ ছাঁটাই করছে জাতিসংঘ

১২ অক্টোবর থেকে ৫ কোটি শিশুকে বিনা মূল্যে টাইফয়েড টিকা, টাকা চাইলে ব্যবস্থা

৯ গোলের দুঃস্বপ্ন থেকে মশার যন্ত্রণা, বাংলাদেশ-হংকং লড়াইয়ে আরও যা ঘটেছে

গাজায় থেমে গেছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান–কামানের গর্জন, ২ বছর পর শান্তির ঘুমে গাজাবাসী

দান ফেরত নেওয়া ব্যক্তির দৃষ্টান্তে যা বলেছেন নবীজি (সা.)

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত