Ajker Patrika

জাহাজে ভিডিও ক্যামেরা, সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট—যেভাবে বিশ্বজুড়ে দৃষ্টি কাড়ল সুমুদ ফ্লোটিলা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ২২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ফিলিস্তিনের গাজায় খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দিতে যাত্রা করা আন্তর্জাতিক নৌবহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলায় গত বুধবার রাতে ইসরায়েলি সশস্ত্র সেনারা যখন হামলা চালায়, তখন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে বসে দুজন ওয়েব ডেভেলপার তৎপর হয়ে ওঠেন বহরের নৌযানগুলোর গতিবিধি নজরে রাখতে। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ সে সময় অনলাইনে দেখছিলেন এসব নৌকার পরিণতির দিকে।

নৌযানগুলোর ভেতরে থাকা ক্যামেরা থেকে সম্প্রচারিত ঝাপসা ফুটেজ ফ্লোটিলার ওয়েবসাইটে সরাসরি দেখানো হচ্ছিল। ডেভেলপাররা সেই মুহূর্তে নৌযানগুলোর অবস্থান হালনাগাদ করছিলেন এবং প্রতিটি জাহাজ দখলের ছোট ভিডিও পোস্ট করছিলেন। তাঁরা জানান, পোস্টগুলোতে ক্লিক করার সংখ্যা ছিল নজিরবিহীন। বুধবার সাইটটিতে ২৫ লাখ এবং পরদিন বৃহস্পতিবার ৩৫ লাখ ভিজিট রেকর্ড করা হয়েছে।

রেকট্যাঙ্গল নামের একটি ডিজাইন ও সফটওয়্যার কোম্পানির সহপরিচালক লিজি ম্যালকম বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমি এমন সংখ্যা আগে কখনো দেখিনি। অন্তত আমার তৈরি কোনো ওয়েবসাইটে নয়।’

নতুন ফ্লোটিলার প্রচারাভিযান

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা ইসরায়েলি নৌ অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছিল। এই অবরোধের কারণে দুই বছরের ইসরায়েলি হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ফ্লোটিলাটিতে প্রায় ৫০০ সংসদ সদস্য, আইনজীবী, অধিকারকর্মীসহ ৪০টিরও বেশি বেসামরিক জাহাজ ছিল। তাঁদের মধ্যে সুইডেনের অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও ছিলেন।

ফ্লোটিলাটি গাজায় পৌঁছাতে পারেনি। জাহাজগুলোকে আটকে দিয়ে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ১০ দিনের মধ্যেই এটি ইসরায়েলি অবরোধবিরোধী সবচেয়ে আলোচিত প্রতিরোধ উদ্যোগে পরিণত হয়। সেই প্রচারণায় উৎসাহিত হয়ে ১১টি জাহাজের আরেকটি ফ্লোটিলা এরই মধ্যে রওনা দিয়েছে।

একটি সুসংগঠিত সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা, হালনাগাদ করা জাহাজ-ট্র্যাকিং প্রযুক্তি, স্মার্ট ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনের মাধ্যমে এই মিশনটি ব্যাপক মনোযোগ ও সমর্থন লাভ করেছে, যা অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে শক্তি জুগিয়েছে।

ইসরায়েলের দাবি, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই তাদের নৌ অবরোধ বৈধ। তারা ফ্লোটিলাকে ‘উসকানিমূলক’ বলছে।

তবে নৌবহরটির প্রতি বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে ব্যাপক সহানুভূতি তৈরি হয়েছে। গত বুধবারের দখল অভিযানের পর ইউরোপজুড়ে, এমনকি আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও পাকিস্তানেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। কলম্বিয়া থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সমালোচনা করেন নেতারা।

একটি আন্দোলনের জন্ম

গাজায় ২০০৭ সালে হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েল অবরোধ আরোপ করে। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই অবরোধবিরোধী সচেতনতামূলক আন্দোলন নতুন গতি পায়।

সাম্প্রতিক এই প্রচারাভিযানটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

সেন্ট জর্জস, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক ড্যান মেরসিয়ার মতে, জুনের পর থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারা থেকেও ফ্লোটিলা উপকৃত হয়েছে।

তিনি বলেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ইসরায়েলের হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই। সাংস্কৃতিক প্রভাব এখন দৃশ্যমান আর ফ্লোটিলার ভূমিকা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ।

এর আগে ‘মার্চ টু গাজা’ নামে একটি সংগঠন রাফাহ সীমান্তে যাত্রা আয়োজন করলেও মিসরীয় কর্তৃপক্ষ কর্মীদের বহিষ্কার করায়, তা ব্যর্থ হয়। আরও কিছু ছোট নৌবহর অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করা হলেও সেগুলো তেমন আলোচনায় আসেনি।

গত জুনে তিউনিসিয়ায় বিভিন্ন সংগঠন মিলে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় বৃহত্তর যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার।

এ বিষয়ে গ্রিক প্রতিনিধি আন্তোনিস ফারাস বলেন, ‘ভাবনাটা ছিল, আরও বড় কিছু করা দরকার। যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে।’

শুরু থেকেই বিপুল সমর্থন

এভাবেই জন্ম নেয় গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা, যার লক্ষ্য স্পষ্ট—ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙা।

শুরু থেকেই সংগঠনটি বিপুল সমর্থন পায়। গ্রিক প্রতিনিধি আন্তোনিস ফারাস জানান, যখন তাঁরা এই উদ্যোগে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান, ২০ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়ে সে সময়।

ইতালিতে মিউজিক ফর পিস নামের এক দাতব্য সংস্থা ৪০ টন সাহায্যের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অনুদান সংগ্রহ শুরু করে। মাত্র পাঁচ দিনে তারা ৫০০ টনের বেশি অনুদান সংগ্রহ করে ফেলে।

এভাবেই ইউরোপজুড়ে শুরু হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। গ্রিক একটি দল ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে ২৫টি নৌকা জোগাড় করে। অনুদানের আহ্বানে সাড়া আসে ব্যাপক পরিমাণে।

এদিকে ইতালির স্থানীয় সংগঠকেরা শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেই ইউনিয়নগুলো সুমুদ ফ্লোটিলার প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন বন্দর অঞ্চলে ধর্মঘটসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।

ফল মেলে গত বুধবারই। ইসরায়েলি অভিযানের খবর ছড়াতেই ইতালির রাস্তায় নেমে আসে অসংখ্য মানুষ। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৩ অক্টোবর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

আন্দোলনটি দেশভিত্তিক ভাগে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি দেশের নিজস্ব মুখপাত্র ছিলেন।

ইতালীয় প্রতিনিধিদলের মুখপাত্র মারিয়া এলেনা দেলিয়া বলেন, প্রতিটি অঞ্চল নিজের এলাকায় সংগঠন গড়ে তুলেছিল—এই কাঠামোই সাফল্যের মূল।

বিশ্বের কাছে সরাসরি সম্প্রচার

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা নিয়মিতভাবে এক্স, টেলিগ্রাম এবং ইনস্টাগ্রামে হালনাগাদ তথ্য দেয় এবং জাহাজে থাকা মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে জুমের মাধ্যমে প্রেস কনফারেন্স করে।

নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি নকোসি জুয়েলিভেলিলে ম্যান্ডেলাও জাহাজে ছিলেন। থুনবার্গ জাহাজের ডেক থেকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন।

নৌযানগুলো থেকে সরাসরি সম্প্রচার চলছিল; পাশাপাশি যুক্ত করা হয়েছিল উন্নত ট্র্যাকিং ডিভাইস। গ্লাসগোয় বসে ম্যালকম ও তাঁর সহকর্মী ড্যানিয়েল পাওয়ার্স ‘ফরেনসিক আর্কিটেকচার’ নামে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা দলের সঙ্গে মিলে ট্র্যাকিংয়ের ব্যাকআপ হিসেবে গারমিন ডিভাইস ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের ব্যবস্থাও করেন।

বুধবার রাতে লাইভ ক্যামেরায় দেখা যায়—ইসরায়েলি সেনা নৌযানের ক্যাপ্টেনদের ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিচ্ছে আর বন্দুক ও নাইটভিশন গগলস নিয়ে জাহাজে উঠছে।

নিরাপত্তা প্রটোকল অনুযায়ী, অধিকারকর্মীরা তখন লাইফ জ্যাকেট পরে হাত উঁচিয়ে বসে ছিলেন।

ম্যালকম ও পাওয়ার্স গ্লাসগোতে তাঁদের স্টুডিও থেকে রাতভর ছবিগুলো দেখছিলেন এবং জাহাজগুলোর অবস্থান হালনাগাদ করছিলেন।

ম্যালকম বলেন, ‘মানুষের আগ্রহ আমরা দেখেছি। ওরা দেখতে চায়। এতে ইতিবাচক কিছু আছে, যেন সবাই মিলে মানবাধিকারকর্মীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করতে চাইছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২০২৬ সালের রমজানের সম্ভাব্য তারিখ জানালেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা

যৌনকর্মীকে হোটেলে ডেকে ছিনতাই, সিঙ্গাপুরে দুই ভারতীয়কে কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাত

হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে গুলতেকিন খানের পোস্ট, কেন এত আলোচনা

সৌদি আরবে অভূতপূর্ব কমেডি শো, যৌনতা-ট্রান্সজেন্ডার কোনো কিছুই আটকাচ্ছে না

‘ইসরায়েলে আকস্মিক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান’

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত