Ajker Patrika

৫০ বছরে অর্ধেক হয়েছে জন্ম-মৃত্যুহার, ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি শ্লথ

কলকাতা প্রতিনিধি  
আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভারতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি গত পাঁচ দশকে এক নতুন ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ সরকারি তথ্য বলছে, ৫০ বছরে দেশটিতে জন্ম ও মৃত্যুহার দুই-ই প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে আসা শুধু স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি নয়, বরং পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক পরিবর্তন, নগরায়ণ এবং শিক্ষা বিস্তারেরও প্রতিফলন।

নমুনা নিবন্ধনব্যবস্থা বা স্যাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের (এসআরএস) ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, জন্মহার অর্থাৎ প্রতি হাজার জনে জীবিত নবজাতকের সংখ্যা গত অর্ধশতকে সর্বভারতীয় স্তরে ৩৬ দশমিক ৯ থেকে নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৪-এ। অর্থাৎ, জন্মহার অর্ধেক হয়ে গেছে।

শুধু গত ১০ বছরের হিসাব নিলে দেখা যায়, ২০১৩ সালে এই জন্মহার ছিল ২১ দশমিক ৪, যা ২০২৩ সালে এসে ১৮ দশমিক ৪-এ দাঁড়িয়েছে। শহর-গ্রামভেদেও বড় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। গ্রামীণ অঞ্চলে একসময় জন্মহার ছিল অনেক বেশি—১৯৭১ সালে প্রতি হাজারে ৪১ দশমিক ১ জন শিশুর জন্ম হতো। এখন সেই হার নেমে এসেছে ২০ দশমিক ৩-এ। অন্যদিকে নগরাঞ্চলে একই সময়ে জন্মহার ১৭ দশমিক ৩ থেকে নেমেছে ১৪ দশমিক ৯-এ।

আঞ্চলিক বৈষম্যও বড় স্পষ্ট। সর্বশেষ তথ্য বলছে, জন্মহারে শীর্ষে রয়েছে বিহার, যেখানে ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে জন্মহার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮।

বিপরীতে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে জন্মহার সর্বনিম্ন ১০ দশমিক ১। উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে জন্মহার এখনো গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। আবার কেরালা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশে জন্মহার তুলনামূলক কম। demographers মনে করছেন, ভারতের দক্ষিণ ও উত্তর রাজ্যগুলোর মধ্যে এই বৈষম্য আগামী দিনে দেশের সামাজিক কাঠামো ও শ্রমবাজারে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

শুধু জন্মহার নয়, মৃত্যুহারও গত পাঁচ দশকে অর্ধেক হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে মৃত্যুহার ছিল ১৪ দশমিক ৯, এখন সেটি নেমে এসেছে ৬ দশমিক ৪-এ। অর্থাৎ, প্রতি হাজারে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে, মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে, স্বাস্থ্যসেবার বিস্তার ঘটেছে। ২০১৩ সালে মৃত্যুহার ছিল ৭ দশমিক শূন্য, এখন ৬ দশমিক ৪। গ্রামীণ এলাকায় মৃত্যুহার ৬ দশমিক ৮, আর শহরে ৫ দশমিক ৭। তবে রাজ্যভেদে ছবিটা আলাদা—ছত্তিশগড়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার ৮ দশমিক ৩ আর চণ্ডীগড়ে সর্বনিম্ন ৪ দশমিক শূন্য।

আরেকটি বড় পরিবর্তন ঘটেছে শিশুর মৃত্যুহারে। ২০১৩ সালে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ৪০। ২০২৩ সালে সেটি নেমে এসেছে ২৫-এ। অর্থাৎ এক দশকে শিশু মৃত্যু প্রায় ৩৭ শতাংশ কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ, টিকাদান কর্মসূচি, মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও শিক্ষা বিস্তারের ফলে শিশু মৃত্যুর হার দ্রুত কমছে। তবে এখনো বহু দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলে এই হার উদ্বেগজনক।

জনসংখ্যা বিজ্ঞানের বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারতের জন্মহার দ্রুত হ্রাস পাওয়া মানে পরিবার ছোট হচ্ছে। সমাজে সন্তানের সংখ্যা সীমিত রাখার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার বিস্তার, নারীদের কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণ এবং পরিবার পরিকল্পনা সহজলভ্য হওয়ার কারণে এই পরিবর্তন হয়েছে। অন্যদিকে মৃত্যুহার হ্রাস মানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে, ওষুধের সহজলভ্যতা বেড়েছে, গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র সম্প্রসারিত হয়েছে।

জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ বলছে, আগামী দুই দশকে ভারতের জন্মহার আরও কমবে এবং দেশটি ‘রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ফার্টিলিটি’র কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ, প্রত্যেক নারী গড়ে ২ দশমিক ১টি সন্তানের জন্ম দিলে জনসংখ্যা স্থিতিশীল হয়। ভারতের অনেক রাজ্য ইতিমধ্যে এই স্তরে পৌঁছে গেছে। তবে বিহার, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্য এখনো অনেকটা দূরে। এই বৈষম্যের কারণে দেশটির ভবিষ্যৎ জনসংখ্যাগত গতি নির্ধারিত হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের দুটি দিক রয়েছে। একদিকে কম জন্মহার মানে ভবিষ্যতে শ্রমশক্তির সংকট তৈরি হতে পারে, বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে যাবে, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চাপ বাড়বে। অন্যদিকে এটি অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক হতে পারে। কারণ কম জন্মহার মানে নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমে যাবে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাত বাড়বে, যা অর্থনীতিতে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ তৈরি করতে পারে।

অর্ধশতকে জন্ম ও মৃত্যুহারের এই নাটকীয় পরিবর্তন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত