Ajker Patrika

আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের হিন্দুরাষ্ট্র তত্ত্ব নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে বিতর্ক

কলকাতা প্রতিনিধি  
আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ৩৪
আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। ছবি: সংগৃহীত
আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। ছবি: সংগৃহীত

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর শতবর্ষ উপলক্ষে সংঘ প্রধান মোহন ভাগবতের সাম্প্রতিক বক্তব্য ঘিরে ভারতজুড়ে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, হিন্দু রাষ্ট্র মানে কোনো বাদ দেওয়া নয়, বরং সকলের জন্য ন্যায় নিশ্চিত করা। ভাগবতের এই ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক মনে হলেও বিশ্লেষকদের মতে, এর ভেতরে রয়েছে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকেত। কারণ, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ও সংবিধান প্রণয়নের মুহূর্তে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ধারণা একাধিকবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এবার আরএসএস প্রধান আবারও এই বিতর্কিত তত্ত্ব সামনে আনলেন।

ভাগবত তাঁর ভাষণে বলেন, ‘হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই, এটি সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক।’

একই সঙ্গে তিনি বর্ণপ্রথার বিরোধিতার কথাও জানান। কিন্তু সমালোচকদের বক্তব্য, ভারতের ইতিহাসে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা সব সময়ই বর্ণভিত্তিক বিভাজনের সঙ্গে যুক্ত। তাই একদিকে বর্ণবাদের বিরোধিতা আর অন্যদিকে হিন্দু রাষ্ট্রের সমর্থন, এই দ্বৈত অবস্থান বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ভাগবত আরও বলেন, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা ছিল কেবল রাজনৈতিক মুক্তি; প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের দিন। এই মন্তব্য বিতর্ক আরও উসকে দেয়। ইতিহাসবিদদের মতে, এই মন্তব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনার বিকৃতি। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল বা ড. আম্বেদকর—সবাই ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি করেছিলেন। বিশেষত আম্বেদকর স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, ‘হিন্দু রাজ এক ভয়াবহ বিপর্যয়, সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে।’

রাজনীতির অঙ্গনে এই বক্তব্যের আরও বেশি প্রভাব পড়ছে। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, ভাগবতের বক্তব্যে তারা স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, আগামী নির্বাচনের আগে হিন্দু রাষ্ট্র ও রাম মন্দিরের প্রসঙ্গ সামনে আনা হলে হিন্দুত্ববাদী ভোটারদের একত্রিত করা সহজ হয়।

অবশ্য কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করছে। তাদের দাবি, আরএসএস ও বিজেপি দেশের প্রকৃত সমস্যা—অর্থনীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য থেকে মন সরাতে ইচ্ছে করেই ধর্মীয় ইস্যু উসকে দিচ্ছে।

প্রশ্ন উঠছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়ে। ১৯৯১ সালের প্লেসেস অব ও্যরশিপ অ্যাক্ট স্পষ্ট বলছে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে ধর্মীয় স্থাপনার চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ ভাগবত তাঁর বক্তব্যে জ্ঞানবাপী মসজিদ ও মথুরার ঈদগাহ প্রসঙ্গে সদস্যদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। এতে আইন ভাঙার ইঙ্গিত স্পষ্ট, যা আদালত ও প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদও সোমনাথ মন্দির উদ্বোধনে অংশ নিয়ে সতর্ক করেছিলেন, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নীতি ব্যর্থ হবে। সর্দার প্যাটেল ১৯৪৮ সালে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, হিন্দু রাষ্ট্র নিয়ে গুরুতর আলোচনা হতে পারে না।

আজ যখন ভাগবত হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, তখন সেই ইতিহাস আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরএসএসের এই বক্তব্য শুধু একটি মতাদর্শ নয়, এটি ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। বহুমতের দেশে একমাত্রিক হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা মানে হলো সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করা, যা সামাজিক শান্তি নষ্ট করবে।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাম মন্দির উদ্বোধনের দিনে বলা ‘রাম মানেই রাষ্ট্র, দেব মানেই দেশ’—এই মন্তব্যও একই ধরনের প্রশ্নের জন্ম দেয়। সংবিধানের শপথ নেওয়া একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া নজিরবিহীন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ভাগবতের বক্তব্য আরএসএস ও বিজেপির মধ্যে সুপরিকল্পিত সমন্বয়। মোদির উন্নয়নমুখী রাজনীতির সঙ্গে ভাগবতের মতাদর্শিক চাপ মিলে একধরনের দ্বিমুখী কৌশল তৈরি করছে। একদিকে উন্নয়নের বুলি, অন্যদিকে হিন্দুত্বের আবেগ—এটিই বিজেপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হাতিয়ার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল বাসায় নিয়ে গায়েব করেন উপদেষ্টা— আসিফ মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়রের অভিযোগ

চীনা যুদ্ধবিমান থেকে এলএস-৬ বোমা ফেলে কেন নিজ দেশে ‘হত্যাযজ্ঞ’ চালাল পাকিস্তান

ফিলিস্তিনকে আজই রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে আরও ৬ দেশ, বিরোধিতা ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের

ধর্ষণের শিকার শিশুর স্বজনকে মারতে উদ্যত হওয়া সেই চিকিৎসক বরখাস্ত

ভবদহের দুঃখ ঘোচাতে আসছে সেনাবাহিনী, খনন করবে ৫ নদ-নদীর ৮১.৫ কিমি

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত