Ajker Patrika

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কেন চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, কী চান পুতিন 

আপডেট : ০৩ জুন ২০২৪, ১২: ২৭
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কেন চলছে ব্যাপক ধরপাকড়, কী চান পুতিন 

ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। মূলত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে এই ধরপাকড় চলছে। তবে পরিশুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে এ ধরনের ধরপাকড় অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া এবং তার পরপরই ধরপাকড় চালানো স্বাভাবিক বিষয় নয়। 

পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গত সপ্তাহে সরকারে বেশ রদবদল আনেন পুতিন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে বরখাস্ত করে তাঁর স্থলে একজন অর্থনীতিবিদকে নিয়োগ দেন তিনি। এর পরপরই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের কথা বলে একে একে মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধরপাকড়ের এ ঘটনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে ভীতি ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রদবদল ও ধরপাকড় যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনি এর সময়টাও বেশ উল্লেখযোগ্য। ইউক্রেনে দুই বছর তিন মাস ধরে চলা যুদ্ধে রাশিয়া সুবিধাজনক অবস্থানে। সম্প্রতি উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে খারকিভের আশপাশে যে হামলা শুরু করেছে, তাতেও তারা প্রায় সফল। পূর্বের দনবাসেও রুশ বাহিনী জয় পাচ্ছে। 

বিপরীতে সেনা ও অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকটে ধুঁকছে ইউক্রেন। এই সংকটের মূলে আছে ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ অনুমোদনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে কয়েক মাস ধরে আটকে থাকা। রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইউক্রেনের এই সংকট কাজে লেগেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতির পরও কেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধানকে সরিয়ে দিলেন পুতিন? 

বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলেছে সিএনএন। তাঁরা বলছেন, রাশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার অন্যতম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। বিপুল অঙ্কের সামরিক ঠিকাদারি চুক্তির বিষয় প্রকাশ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। প্রকাশ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের সমালোচনা করছে। 

তবে বিশ্লেষকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, ‘ (রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে রদবদল নিয়ে) আমরা যেটা প্রত্যক্ষ করছি, সেটা খুবই জটিল এক খেলা। এই খেলার অনেকগুলো দিক রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এসব ঘটনার মেয়াদকাল এবং পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জয়ের লক্ষ্যে পুতিনের আত্ম-অনুসন্ধান।’ 

ধরপাকড় ও রদবদলের কারণে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ঝাঁকুনির নেপথ্যে রয়েছেন প্রয়াত ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন। তিনি রাশিয়ার ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের প্রধান। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের প্রতি নিজের ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা ও কটাক্ষ করে তাঁদের সমালোচনা করেছিলেন প্রিগোঝিন। তাঁর অভিযোগ, শোইগু ও গেরাসিমভ একই সঙ্গে যেমন অদক্ষ, তেমনি ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্তও। 

এই বিষয়কে কেন্দ্র করে মস্কোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শুরু করেছিলেন প্রিগোঝিন। ব্যর্থ সেই সামরিক বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল শোইগু ও গেরাসিমভকে পদ থেকে সরানো। তবে এটা করতে গিয়ে প্রিগোঝিন পুতিনকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেন। একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন পুতিনের সর্বময় ক্ষমতাকে। প্রতিক্রিয়ায় প্রিগোঝিনকে দেশদ্রোহী হিসেবে বর্ণনা করেন পুতিন। ব্যর্থ বিদ্রোহের পর রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনসহ নিহত হন প্রিগোঝিন। 

সেই থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অস্ত্র কেনা, ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর দুর্বলতা ও দুর্নীতির অভিযোগের মতো বিষয়গুলো লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছিলেন পুতিন। তিনি মূলত ব্যর্থ সেই বিদ্রোহ নিয়ে যে ক্ষুব্ধ, সেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে চাননি। কারণ, এটা করলে রাশিয়ার জনগণের সামনে তাঁর সর্বময় ক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ তৈরি হতো। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছিলেন পুতিন। গত মার্চের সেই নির্বাচনে পুতিন আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এরপর গত ৯ মে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও পুতিন ও শোইগুকে পাশাপাশি হৃদ্যতাপূর্ণ অবস্থায় দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বিজয় দিবসের কয়েক দিন পর শোইগুকে বরখাস্ত করেন। মন্ত্রণালয়ে শুরু হয় ধরপাকড়। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেও শোইগুকে নিজের ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে রেখেছেন পুতিন। বরখাস্ত করার পর শোইগুকে নিরাপত্তা পরিষদের সচিবের দায়িত্বে এনেছেন। 

কার্নিজ রাশিয়া—ইউরেশিয়া সেন্টার নামে একটি থিংকট্যাংকের জ্যেষ্ঠ ফেলো তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রিগোঝিন যা বলেছিলেন, তা ঠিক না বেঠিক ছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। রাশিয়ার রাজনীতিতে ঠিক ও ভুল বলে কিছু নেই। সেখানে যা আছে, তা কেবলই স্বার্থ।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুতিনের স্বার্থ হলো তাঁর ঘরে যেন শৃঙ্খলা থাকে। তবে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেনে বিজয় অর্জন। আর ইউক্রেনে এ যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে, তার কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। 

সের্গেই শোইগুকে সরিয়ে আন্দ্রেই বেলুসভকে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। বেসামরিক ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদ আন্দ্রেই বেলুসভকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে পুতিন এই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চলতি বাজেটে সামরিক খাতের জন্য রেকর্ড সর্বোচ্চ যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তার আওতায় আরও দ্রুত ও সুলভ মূল্যে অস্ত্র কিনতে চান তিনি। 

রাশিয়ার চলতি বছরের বাজেটের ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে সামরিক খাতের জন্য, যা আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে সামরিক খাতের বরাদ্দ সামাজিক খাতকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুতিন যে দেশে যুদ্ধকালীন একটি অর্থনীতি চাইছেন, সামরিক খাতের জন্য এই বরাদ্দ তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। 

অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাভিত্তিক ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের ভিজিটিং ফেলো রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিখাইল কোমিন বলেন, রাশিয়ার অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে যারা সরকারি নীতি ও অর্থনীতিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শোইগু ও তাঁর দলবল। 

গত শুক্রবার রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর উপপ্রধান ও কমিউনিকেশন ডিরেক্টরেটের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাদিম শামারিনের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ, যোগাযোগ সরঞ্জাম সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি ৩ কোটি ৬০ লাখ রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা) ঘুষ নিয়েছেন। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বিপুল অঙ্কের সরকারি ঠিকাদারির কাজ দিয়েছেন তিনি। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে ধরপাকড় চলছে, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যমগুলো। শামারিনকে গ্রেপ্তার করার পর গত মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম রিয়া নভোস্তির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শামারিনের স্ত্রী ২০১৮ সালে ২ কোটি রুবল (২ লাখ ১৮ হাজার ডলার) দিয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছিলেন। অথচ সেই সময় শামারিনের বাৎসরিক আয় ৩৪ হাজার ডলারের বেশি ছিল না। 

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে পাঁচজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী তিমুর ইভানভ। গত এপ্রিলে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধেও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইভানভ ও তাঁর মেয়ে বন্ধুরও বিলাসী জীবনযাপন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

গুঞ্জন উঠেছে এখন পুতিনের ‘টার্গেট’ সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ। রাশিয়া—ইউরোশিয়া সেন্টারের তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলেন, ‘এখন চারপাশে গুঞ্জন ছড়িয়েছে যে গেরাসিমভকেও উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।’ 

সিএনএন থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রুশ হামলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ, ইউক্রেনজুড়ে লোডশেডিং

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা ইউক্রেনার্গো জানিয়েছে, রোববার ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা ইউক্রেনার্গো জানিয়েছে, রোববার ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার ব্যাপক হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ‘শূন্যে’ নেমে এসেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন সংস্থা ইউক্রেনার্গো জানিয়েছে, রোববার ৮ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মস্কো কয়েক মাস ধরে ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা বাড়িয়েছে। শুক্র থেকে শনিবার পর্যন্ত টানা হামলায় শত শত ড্রোন ব্যবহার করা হয়, এতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে বলে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এই হামলাগুলো দেশটির একাধিক শহরে বিদ্যুৎ, তাপ এবং পানি সরবরাহ ব্যাহত করেছে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি সেন্টনেনার্গো জানিয়েছে, এতে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ‘শূন্যে’ নেমে গেছে।

ইউক্রেনার্গো বলেছে, মেরামতের কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও কিয়েভ, দিনিপ্রোপেত্রভস্ক, দোনেৎস্ক, খারকিভ, পোলতাভা, চেরনিহিভ ও সুমি অঞ্চলে নিয়মিত বিদ্যুৎ-বিভ্রাট চলতে পারে বলে স্থানীয় সময় শনিবার রাতে জানিয়েছেন ইউক্রেনের জ্বালানি উপমন্ত্রী সভিতলানা গ্রিনচুক।

তিনি স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল ইউনাইটেড নিউজকে বলেন, ‘শত্রুপক্ষ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে, যেগুলো প্রতিহত করা অত্যন্ত কঠিন। রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এত বেশি সরাসরি জ্বালানি স্থাপনায় আঘাতের ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি।’

ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা জানিয়েছেন, রাশিয়ার ড্রোন হামলার লক্ষ্য ছিল পশ্চিম ইউক্রেনের দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র। এসব উপকেন্দ্র খমেলনিতস্কি ও রিভনে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে; যেগুলো লুতস্ক শহর থেকে যথাক্রমে ১২০ কিলোমিটার ও ৯৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

সিবিহা টেলিগ্রামে লিখেছেন, ‘রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপের পারমাণবিক নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আমরা আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) বোর্ড অব গভর্নরসের জরুরি বৈঠক আহ্বানের দাবি জানাই, যাতে এই অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’

তিনি আরও বলেন, চীন ও ভারত; যারা ঐতিহ্যগতভাবে রুশ তেলের বড় ক্রেতা, তারা যেন মস্কোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই আক্রমণ বন্ধে ভূমিকা রাখে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর এমন হামলা ইউক্রেনকে শীতের আগে তীব্র তাপ সরবরাহ সংকটে ফেলতে পারে। প্রায় চার বছর ধরে চলা রুশ আগ্রাসনে দেশটির বিদ্যুৎ ও তাপ সরবরাহব্যবস্থা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ইউক্রেনের জ্বালানি কোম্পানি নাফতোগাজ জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহান্তের হামলা অক্টোবরের শুরু থেকে নবম বৃহৎ গ্যাস অবকাঠামো আক্রমণ।

কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব হামলায় ইউক্রেনের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের অর্ধেক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউক্রেনের শীর্ষ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ওলেক্সান্দর খারচেঙ্কো বুধবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, যদি কিয়েভের দুটি প্রধান বিদ্যুৎ ও তাপ সরবরাহ কেন্দ্র টানা তিন দিনের বেশি সময় বন্ধ থাকে এবং তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়, তাহলে রাজধানীতে ‘প্রযুক্তিগত বিপর্যয়’ ঘটবে।

এদিকে রুশ হামলার জবাবে ইউক্রেনও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার তেল মজুত কেন্দ্র ও শোধনাগারে হামলা জোরদার করেছে। এর মাধ্যমে মস্কোর জ্বালানি রপ্তানি ব্যাহত করা এবং দেশজুড়ে জ্বালানি ঘাটতি সৃষ্টি করাই কিয়েভের লক্ষ্য।

রোববার স্থানীয় সময় ভোরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা রিয়া জানিয়েছে, দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৪৪টি ইউক্রেনীয় ড্রোন ধ্বংস করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংবিধান সংশোধনী বিল

আরও ক্ষমতাধর হচ্ছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির, দুর্বল হচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৩: ৩১
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির কয়েক মাস আগে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছবি: আইএসপিআর
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির কয়েক মাস আগে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ছবি: আইএসপিআর

পাকিস্তানের সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। নতুন ২৭তম সংবিধান সংশোধনী বিল অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর কাঠামো ও বিচারব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার ফলে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির আরও ক্ষমতাধর হবেন আর সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমবে।

স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার দেশটির পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে এই সংশোধনী বিল উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আজারবাইজান সফরে থাকা অবস্থায় ভার্চুয়ালি মন্ত্রিসভার বৈঠক পরিচালনা করে খসড়াটিতে অনুমোদন দেন। এরপরই বিলটি সিনেটে উপস্থাপন করে পাঠানো হয় আইন ও বিচারবিষয়ক স্থায়ী কমিটিতে।

আইনমন্ত্রী আজম নাজির তারার বিলটি উপস্থাপন করে বলেন, ২৭তম সংশোধনী ২০০৬ সালে পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘চার্টার অব ডেমোক্রেসি’র অংশ, যা ১৮তম সংশোধনীর সময় অসম্পূর্ণ ছিল।

সেনাবাহিনীর কাঠামোয় বড় পরিবর্তন

প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, সংবিধানের ২৪৩ ধারা সংশোধন করে ‘সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রাষ্ট্রপতি’—এই ধারায় পরিবর্তন আনা হবে। বর্তমানে বিদ্যমান ‘চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটি’ পদটি বিলুপ্ত করে নতুন পদ ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ তৈরি করা হবে।

এই নতুন পদ কার্যকর হবে চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর থেকে। সেনাপ্রধান একই সঙ্গে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন। এর ফলে সেনাপ্রধানের হাতে কার্যত পুরো সামরিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে।

বিল অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’-এর সুপারিশে একজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেবেন।

এ ছাড়া সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের দেওয়া সম্মানসূচক উপাধি—ফিল্ড মার্শাল, মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স ও অ্যাডমিরাল অব দ্য ফ্লিট আজীবন বহাল থাকবে। এসব উপাধি বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে কেবল পার্লামেন্টের হাতে।

বিচারব্যবস্থায় নতুন আদালত, কমবে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা

২৭তম সংশোধনীর সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো, একটি নতুন আদালত ‘ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট’ গঠন। এই আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে সুপ্রিম কোর্টের কিছু সাংবিধানিক ক্ষমতা সরাসরি এখানেই স্থানান্তর হবে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, সংবিধানের বিশেষ এখতিয়ার—যেমন সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা নতুন আদালতের হাতে যাবে। এর ফলে সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়বে।

এই নতুন আদালতে দেশের চার প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে আর বিচারপতির সংখ্যা নির্ধারণ করবে পার্লামেন্ট। আদালতের প্রধান বিচারপতির মেয়াদ হবে তিন বছর।

বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা আরও বাড়বে। অর্থাৎ, বিচারব্যবস্থার ওপর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বাড়বে—যা স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকেরা।

রাষ্ট্রপতির আজীবন দায়মুক্তি

প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি আজীবনের জন্য ফৌজদারি মামলার দায়মুক্তি পাবেন। অর্থাৎ, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অভিযোগ আনা যাবে না বা কোনো আদালত তাতে শুনানি করতে পারবেন না।

সংশোধনীর মূল বিষয়গুলো সংক্ষেপে—

  • ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্স’ নামে নতুন পদ সৃষ্টি হবে, কার্যকর ২০২৫ সালের ২৭ নভেম্বর থেকে।
  • সেনাপ্রধান একই সঙ্গে ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ পদে দায়িত্ব পালন করবেন।
  • ফিল্ড মার্শাল, মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স, অ্যাডমিরাল অব দ্য ফ্লিট উপাধি আজীবন বহাল থাকবে।
  • প্রধানমন্ত্রী ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেসের’ সুপারিশে ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডার নিয়োগ দেবেন।
  • ‘ফেডারেল কনস্টিটিউশনাল কোর্ট’ নামে নতুন আদালত গঠন হবে।
  • আদালতে সব প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
  • বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা বাড়বে।
  • সুপ্রিম কোর্টের কিছু এখতিয়ার নতুন আদালতে স্থানান্তর হবে।
  • রাষ্ট্রপতি আজীবনের জন্য ফৌজদারি দায়মুক্তি পাবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর প্রভাব আরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস পদটি বাস্তবায়িত হলে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কার্যত রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে উঠবেন, যাঁর ওপর প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টও নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে।

অন্যদিকে নতুন আদালত গঠনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পাকিস্তানের সাবেক বিচারপতিরা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে ইসরায়েলের জন্য কঠিন শর্ত নিয়ে প্রস্তুত সৌদি আরব

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সৌদি আরব শিগগিরই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। এ নিয়ে আলোচনার জন্য চলতি মাসে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন। তবে আলোচনা সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, হোয়াইট হাউসের আলোচনায় তেমন কোনো ফল না-ও আসতে পারে।

গত মাসে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন, সৌদি আরব ‘শিগগিরই’ ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দেবে। এই চুক্তির আওতায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে।

কিন্তু রিয়াদ ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি তখনই বিবেচনা করা হবে, যখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি স্পষ্ট রূপরেখা ও সময়সূচি নির্ধারিত হবে। রিয়াদের এই অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে কূটনৈতিকভাবে জানানো হয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন উপসাগরীয় দুই কূটনৈতিক সূত্র।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, কোনো ভুল বার্তা বা বিভ্রান্তি এড়াতে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থানগত সামঞ্জস্য নিশ্চিত করা হচ্ছে, বিশেষ করে ১৮ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠেয় বৈঠকের আগে।

সাবেক মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা জোনাথন প্যানিকফ বলেন, মোহাম্মদ বিন সালমান একটি বিশ্বাসযোগ্য ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নকশা’ ছাড়া এখনই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে এগোবেন না। তিনি মনে করেন, সৌদি যুবরাজ বৈঠকে ট্রাম্পকে ‘স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য সমর্থন’ দিতে চাপ দেবেন।

খাশোগি হত্যার পর প্রথম ওয়াশিংটন সফর

২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রে মোহাম্মদ বিন সালমানের এটিই প্রথম সফর। খাশোগি হত্যার ঘটনায় সে সময় আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সালমান। তবে তিনি এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ বারবার অস্বীকার করেছেন।

৫ নভেম্বর ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে বলেন, ‘আমরা অনেক দেশকে আব্রাহাম চুক্তিতে যুক্ত হতে দেখছি। আশা করছি, শিগগিরই সৌদি আরবও যুক্ত হবে।’

তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। এ জন্য রিয়াদ চাইছে, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ যেন নতুন কাঠামোর আওতায় হয়, আগের কোনো চুক্তির সম্প্রসারণ নয়।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই অগ্রাধিকার

ইসলামের জন্মভূমি ও মক্কা-মদিনার তত্ত্বাবধায়ক সৌদি আরবের জন্য ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া শুধু কূটনৈতিক বিষয় নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সংবেদনশীল ইস্যু। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে হাজারো ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর আরব জনমনে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়েছে।

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মানাল রাদওয়ান বলেন, গাজায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।

কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বরাবরই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধী। সৌদি কর্তৃপক্ষ মনে করে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি নেতানিয়াহুকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাজি করাতে না পারেন, তাহলে এই আলোচনায় কোনো লাভ হবে না। তাই ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে ট্রাম্পের যে প্রত্যাশা, সেটা এখনই পূরণ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।

এই পরিস্থিতে রিয়াদ এখন ইসরায়েল প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও বিনিয়োগের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আলোচনায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল ইস্যু যাতে মূল আলোচনাকে ছাপিয়ে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক অবস্থান নিচ্ছে সৌদি নেতৃত্ব।

সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের আশা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের সর্বোচ্চ তেল রপ্তানিকারক দেশটির নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ভূমিকা আরও স্পষ্ট হবে।

তবে এই চুক্তি পূর্বনির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা জোটের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। রয়টার্স জানিয়েছে, এটি কাতারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান নিরাপত্তাব্যবস্থার অনুরূপ একটি চুক্তি হবে—যা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর হবে এবং এর জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।

চুক্তির আওতায় উন্নত সামরিক প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা শিল্পে অংশীদারত্ব ও যৌথ প্রশিক্ষণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রিয়াদ চাইছে, ভবিষ্যতে কোনো মার্কিন প্রশাসন চাইলে এই চুক্তিকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা চুক্তিতে রূপান্তর করতে পারে—এমন ধারাও যুক্ত করা হোক।

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ডেভিড মাকোভস্কি বলেন, এটি সৌদি আরবের কাঙ্ক্ষিত পূর্ণাঙ্গ চুক্তি না হলেও একে তারা একটি ‘পদক্ষেপ হিসেবে’ দেখছে।

গাজা যুদ্ধের পর নতুন প্রেক্ষাপট

উপসাগরীয় গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান আবদুল আজিজ আল-সাঘের বলেন, ‘৭ অক্টোবরের পর সৌদি-মার্কিন আলোচনার প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। রিয়াদের অবস্থান পরিষ্কার—জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত চাহিদা পূরণ হলে তবেই তারা আঞ্চলিক বিষয়, বিশেষ করে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে নতুন অবস্থান নেবে।’

তবে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চললেও যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্কের ভারসাম্য এখন আরও জটিল। একসময় ইরানের সামরিক হুমকি রিয়াদকে ওয়াশিংটনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ফলে হুমকি অনেকটা প্রশমিত হয়েছে।

তা ছাড়া ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী—লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস ও ইয়েমেনের হুতিরাও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে সৌদি আরবের কাছে ন্যাটো ধাঁচের প্রতিরক্ষা জোটের সম্ভাবনা—এখন খুব একটা জরুরি নয়।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সৌদি আরব যেন চীনের সঙ্গে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সম্পর্ক সীমিত রাখে। কিন্তু রিয়াদ তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে চায়। প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে এমন ধারাও থাকছে, যাতে সৌদি আরবের সামরিক শিল্পে চীনা সম্পৃক্ততা সীমিত হয়। নতুন চুক্তির আওতায় উন্নত মার্কিন অস্ত্র বিক্রি দ্রুত অনুমোদনেরও ব্যবস্থা থাকবে, যাতে আগের মতো কংগ্রেসে বিলম্ব বা রাজনৈতিক বাধা না আসে।

সহজ কথায়, গাজা সংঘাতের পটভূমিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও মার্কিন সামরিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ—এই দুটি জটিল সমীকরণের কারণে ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ আপাতত বিলম্ব হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মামদানির মার্কিন নাগরিকত্ব কেড়ে নিতে চায় রিপাবলিকানরা, এটা কি আদৌ সম্ভব

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র জোহরান মামদানি। ছবি: এএফপি
নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র জোহরান মামদানি। ছবি: এএফপি

নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে জোহরান মামদানিকে ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক তীব্র আকার নিয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকান নেতারা এখন তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের দাবি তুলেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দাবি আইনি বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও কার্যত অসম্ভব।

মামদানির বিজয়ের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘নিউইয়র্কের মতো মহান শহর সন্ত্রাসী মতাদর্শে বিশ্বাসী এক কমিউনিস্টের হাতে যাচ্ছে।’ তিনি হুমকিও দিয়েছিলেন, মামদানি জিতলে নিউইয়র্কের ফেডারেল তহবিল বন্ধ করে দেবেন।

এরপর রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগলেস ও র‍্যান্ডি ফাইন দাবি করেন, মামদানি নাকি নাগরিকত্ব পাওয়ার সময় মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন এবং ‘সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা’ গোপন করেছিলেন। ওগলেস বলেন, যদি তিনি প্রাকৃতিকীকরণ (naturalisation) বা নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ায় মিথ্যা বলে থাকেন, তবে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা উচিত এবং তাঁকে উগান্ডায় ফেরত পাঠাতে হবে।

তবে মার্কিন ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট পলিটিফ্যাক্ট বলছে, মামদানি তাঁর নাগরিকত্ব আবেদনপত্রে কোনো তথ্যই গোপন করেননি।

জোহরান মামদানি ১৯৯৮ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে উগান্ডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। মার্কিন আইনে প্রাপ্তবয়স্ক কেউ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে চাইলে তাঁকে অন্তত পাঁচ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস করতে হয়। মামদানি সেই শর্ত পূরণ করেছেন।

মার্কিন নাগরিকত্ব বাতিল বা ‘ডিন্যাচারালাইজেশন’ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল ও বিরল। এটি কেবল আদালতের আদেশে করা যায় এবং সরকারের প্রমাণ করতে হয় যে, ওই ব্যক্তি নাগরিকত্ব পেতে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেছেন বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন’।

অভিবাসী আইনজীবী জেরেমি ম্যাককিনি বলেন, এ ধরনের মামলা প্রমাণ করা খুবই কঠিন। সরকারকে স্পষ্ট, নির্ভুল ও শক্তিশালী প্রমাণ দিতে হয় যে, ওই ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে যোগ্য ছিলেন না। মামদানির ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রমাণ নেই।

রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগলেসের অভিযোগের অন্যতম ভিত্তি ছিল, মামদানি ২০১৭ সালে একটি র‍্যাপ গানে ‘হোলি ল্যান্ড ফাইভ’ নামের পাঁচজন মুসলিম দাতব্যকর্মীর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। পরে যাঁদের হামাসকে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তবে অভিবাসী আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের (স্বেচ্ছাসেবী) কর্মকাণ্ডে মানুষের সমর্থন একটি সুরক্ষিত বাক্‌স্বাধীনতা। এটি ‘প্রত্যক্ষ সন্ত্রাসবাদে সহায়তা’ নয়।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পলিটিফ্যাক্ট রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান অ্যান্ডি ওগলেস ও র‍্যান্ডি ফাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু তাঁরা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

এ ছাড়া মামদানির বিরুদ্ধে মার্কিন নাগরিকত্ব আবেদনপত্রে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার (ডিএসএ) সদস্যপদ উল্লেখ না করার অভিযোগ তোলা হয়েছে। কিন্তু অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিএসএ কোনো কমিউনিস্ট দল নয়, বরং এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন। তাই এর সদস্য হওয়া নাগরিকত্বের পথে বাধা নয়।

অভিবাসী আইনজীবী ম্যাককিনি বলেন, ডিএসএ সদস্যপদ গোপন করা কোনো জালিয়াতি নয়, কারণ এটি নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতাকে প্রভাবিত করে না। তা ছাড়া কোনো গানের কথার কারণে নাগরিকত্ব বাতিলের প্রশ্নই আসে না।

কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক ক্যাসান্দ্রা রবার্টসন বলেন, মামদানির বিরুদ্ধে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও সফল হওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। এটি মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

এদিকে, নিউইয়র্ক ইয়াং রিপাবলিকান ক্লাব মামদানিকে মেয়র পদে বসতে বাধা দিতে এখন ১৪তম সংশোধনী ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, যাঁরা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বা ‘শত্রুদের সহায়তা’ করেছেন, তাঁরা সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।

রিপাবলিকানরা দাবি করছেন, মামদানি ‘হামাসপন্থী’ অবস্থান নিয়েছেন এবং অভিবাসনবিরোধী (আইসিই) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছেন। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা কেবল বিদ্রোহ বা যুদ্ধকালীন শত্রুদের সহায়তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রে নয়।

গত অক্টোবরে এমএসএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা আসলে ইসলামবিদ্বেষ থেকে এসেছে। আজও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসলামোফোবিয়া আছে। এখানে মুসলমানদের থাকার অধিকার আছে, কিন্তু তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না।’

‘ডিন্যাচারালাইজেশন’ বা নাগরিকত্ব বাতিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও বিরল প্রক্রিয়া, যা সাধারণত নাৎসি অপরাধী বা সন্ত্রাসবাদে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছে। পলিটিফ্যাক্টের তথ্যমতে, মামদানির বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ নেই। ফলে রিপাবলিকানদের এই প্রচেষ্টা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হচ্ছে।

আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত