Ajker Patrika

জেন-জি বিক্ষোভ

ফেসবুক ও ইউটিউবসহ ২৬ প্ল্যাটফর্মে নিষেধাজ্ঞা চাপা ক্ষোভ উসকে দিল নেপালে, সহিংসতায় ঝরল ১৯ প্রাণ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২: ৫৮
২৬টি যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে নেপাল সরকার। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তরুণেরা। গতকাল কাঠমান্ডুর পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে এই তরুণদের ওপর চালানো হয় গুলি। ছবি: এএফপি
২৬টি যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে নেপাল সরকার। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তরুণেরা। গতকাল কাঠমান্ডুর পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে এই তরুণদের ওপর চালানো হয় গুলি। ছবি: এএফপি

নেপালে দুর্নীতিবিরোধী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার বিক্ষোভ থেকে পার্লামেন্ট ভবনে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তরুণদের ওপর গুলি চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। এতে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ১৯ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।

বিক্ষোভ শুরুর পর হতাহতের খবর নিশ্চিত করেছে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হাসপাতাল। কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, ১৯ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া প্রায় ১০০ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

এই গুলির ঘটনার জেরে পদত্যাগ করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক। ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল মন্ত্রিসভায় পদত্যাগপত্র জমা দেন। তিনি বলেন, ‘এত মানুষের প্রাণহানি অচিন্তনীয়। নৈতিকভাবে আমার আর দায়িত্বে থাকা উচিত নয়।’

নেপালের গণমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট এই বিক্ষোভকে ‘জেন-জি’দের বিক্ষোভ হয়েছে আখ্যা দিয়েছে। গণমাধ্যমটি বলছে, সরকারের দুর্নীতির প্রতিবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বিক্ষোভ ডিজিটাল স্পেস থেকে সড়কে নেমে এসেছে। সোমবার সকাল ৯টার দিকে রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষোভকারীরা। তারা প্রথমে কাঠমান্ডুর মাইতিগড় এলাকায় জড়ো হয়। সেখানে স্লোগান দেওয়া শুরু হয়। এই মাইতিগড় ছাড়াও গতকাল বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। পুলিশ এই বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করলে তারা পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে পড়ে এবং ভাঙচুর চালায়।

এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপে দিকে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ব্যবহার এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে।

এদিকে কাঠমান্ডুর হাসপাতালের চিত্র তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকেরা। রাজধানীর সিভিল হাসপাতালের তথ্য কর্মকর্তা রঞ্জন নেপাল বলেন, ‘আমি এমন পরিস্থিতি এই হাসপাতালে এর আগে কখনো দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে অনেক আহতের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ এখানেই কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছে। এতে চিকিৎসকদেরও কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

কারফিউ জারি

বিক্ষোভের কারণে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। প্রথমে এই কারফিউ ছিল বানেস্বর এলাকায়। এই এলাকায় নেপালের পার্লামেন্ট ভবন, কাঠমান্ডু প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর। পুলিশের হামলার পর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে কাঠমান্ডু। পরে কাঠমান্ডুতে প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও কার্যালয় শীতল নিউওয়াজ এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। এ ছাড়া লাইনচাউর (ভাইস-প্রেসিডেন্টের বাসভবন এলাকা), বালুওয়াতার (প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন এলাকা), মহারাজগঞ্জ, সিংঘা দরবারসহ গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য এলাকায়ও কারফিউ জারি করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্পর্শকাতর এলাকাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কারফিউ জারি করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই কারফিউ বজায় থাকবে।

তারকাদের সমর্থন

কারফিউ জারি করার পরও বিক্ষোভ এখনো চলছে। পুলিশ জানিয়েছে, তরুণেরা এখনো রাস্তা ছেড়ে যাননি। এই বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন দেশটির তারকারা। অভিনেতা মদন কৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ এবং হরি বনস আচারিয়া এই আন্দোলনের পক্ষে সরাসরি এবং প্রকাশে বক্তব্য দিয়েছেন। সরকারের অবস্থান এবং দুর্নীতির সমালোচনা করেছেন আচারিয়া। প্রবীণ নেতাদের সরে গিয়ে তরুণদের জায়গা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আরেক অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী প্রকাশ সপুত তাঁর ছোট দুই ভাইকে বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। এই বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার জন্য ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয়ের অর্থ তাঁদের হাতে দিয়েছেন তিনি।

যাঁরা বিক্ষোভের পেছনে

কাঠমান্ডুর প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ‘হামি নেপাল’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে গতকাল মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। এই মিছিলের জন্য আগেই অনুমোদনও নিয়েছিল তারা। এই সংগঠনের প্রধান সুধান গুরুং বলেন, ‘সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারা দেশে আমরা যে বিক্ষোভ করছি, তেমনি একটি বিক্ষোভ ছিল গতকাল।’

তবে এই বিক্ষোভকে জোরালো করার জন্য কাজ করা হচ্ছিল আগে থেকেই। ‘হামি নেপালের’ পক্ষ থেকে বিক্ষোভের জন্য বিভিন্ন তথ্য আগেই দেওয়া হচ্ছিল। এ ছাড়া ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য কী করতে হবে, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে জানিয়ে দিচ্ছিল সংগঠনটি। বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিল। গতকাল কাঠমান্ডু পোস্টে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, অনেকেই স্কুল, কলেজের ড্রেস পরে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। তাদের হাতে বিভিন্ন লিফলেট, পোস্টার ছিল। একটি পোস্টারে লেখা ছিল, দুর্নীতিকে না বলুন এবং একতাবদ্ধ হোন। আরেকটি পোস্টারে লেখা ছিল, ‘জেন-জি এখানে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল’।

নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিক্ষোভ

কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ নিয়ে সমালোচনা বেশ কিছু দিন ধরেই চলছিল। গত বৃহস্পতিবার ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার), মেসেঞ্জার, সিগন্যাল, ইমো, ইউচ্যাট, স্ন্যাপচ্যাটসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নেপাল সরকার। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সরকারের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী পৃথিবী সুব্বা জানান, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের পাস করা নতুন বিধি অনুসারে নিবন্ধন নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

তবে টিকটক, ভাইবার ও আরও তিনটি প্ল্যাটফর্ম নিবন্ধন করায় তারা সরকারের নিষেধাজ্ঞা আওতার বাইরে থাকবে বলে জানান এই মন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

কাঠমান্ডু পোস্টের খবরে বলা হয়, এর আগে ক্ষোভ প্রকাশ হচ্ছিল বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে ‘নেপো কিডস’, ‘নেপো বেবিস’ হ্যাশট্যাগগুলোর ব্যবহার করা হচ্ছিল। মূলত সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তরুণেরা। তবে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দিলে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। গত রোববার সাংবাদিকেরা কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভ থেকে সাংবাদিকেরা বলেন, সরকার এর মাধ্যমে জনসাধারণের কণ্ঠস্বর রোধ করতে চায়। এ ছাড়া গণতন্ত্রের পথ রোধ করে কর্তৃত্ববাদের পথে হাঁটতে চাইছে সরকার। এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানায় আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।

তবে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি এসব সমালোচনা গায়ে মাখেননি। উল্টো তিনি হুমকি দেন, দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করা হলে তা মেনে নেওয়া হবে না।

ক্ষতির কারণে সড়কে মানুষেরা

সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার কারণে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়ে নেপালের পর্যটন খাত। দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই বিদেশি পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই সুযোগ আর পাচ্ছে না পর্যটন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া নেপালের অনেকেই দেশটির বাইরে থাকেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে তাঁরাও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়। রোববার প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির সংসদীয় এলাকায় গুলি চালায় পুলিশ। এরপর গতকাল সোমবার আবারও গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী।

গতকাল বিক্ষোভে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থী জুজান রাজভান্ডরি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি। তবে এটাই বিক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। নেপালে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে।’

এদিকে পুলিশের হামলার নিন্দা জানিয়ে ইকসামা তুমরক বলেন, ‘সরকার বিক্ষোভের বিরুদ্ধে যা করছে তা কর্তৃত্ববাদী আচরণ। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন দেখতে চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত