Ajker Patrika

আম কি ডায়াবেটিস বাড়ায়—গবেষণায় প্রশ্নবিদ্ধ হলো প্রচলিত ধারণা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ, ভারতসহ পুরো উপমহাদেশেই ‘আম’-এর আবেদন আলাদা। কিন্তু, এ উপমহাদেশে বেশ সাধারণ একটি রোগ—ডায়াবেটিস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ভারতে প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, এবং আরও প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ প্রিডায়াবেটিক অবস্থায় আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

এমন অবস্থায় প্রচণ্ড মিষ্টি এই ফল খাওয়া নিয়ে বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বেই থাকতে হয় এ অঞ্চলের বহু মানুষকে। ডায়াবেটিসের ভয়ে অনেকেই আম খেতে ভয় পান। নতুন এক গবেষণায় তাদের জন্য রয়েছে সুখবর। নতুন ওই পাইলট গবেষণায় দেখা গেছে আম খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা তেমন বাড়ে না। কিছুদিনের মধ্যেই ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন’-এ প্রকাশিত হবে এ গবেষণাপত্র।

বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯৫ জন মানুষের ওপর চালানো হয় ওই গবেষণা। এই ৯৫ জনের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নন—এমন দুই ধরনের মানুষই ছিলেন। তাদের ভারতের জনপ্রিয় তিনটি আম—সফেদা, দশেরি ও ল্যাংড়া খাওয়ানো হয়, এবং রক্তের শর্করার পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। এরপর তাদের সাদা পাউরুটি খাইয়ে আবার রক্তে শর্করার পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আম এবং পাউরুটি উভয়েই রক্তে একই পরিমাণে শর্করা বাড়ায়। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাউরুটির চেয়ে আম বরং কম পরিমাণে শর্করা বাড়ায়। অর্থাৎ, আম খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ দ্রুত বা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে না।

ডায়াবেটিস আছে এমন এবং ডায়াবেটিস নেই এমন উভয় ধরনের অংশগ্রহণকারীর ওপর টানা তিন দিন ধরে গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে, আম খাওয়ার পর তাদের রক্তে শর্করার ওঠানামা উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল। গবেষকেরা বলছেন, রক্তে শর্করার এই কম ওঠানামা শরীরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উপকার বয়ে আনতে পারে।

গবেষণা দুটির প্রধান লেখক ড. সুগন্ধা কেহর বলেন, ‘আম একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল, তবে এটি রক্তে গ্লুকোজ এবং ওজন বাড়াতে পারে—এমন ধারণার জন্য এর বদনাম আছে। এই গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে, সঠিক পরিমাণ ও নিয়ম মেনে খেলে আম রক্তে গ্লুকোজের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী হতে পারে।’

‘জার্নাল অফ ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস’-এ প্রকাশিত আরও একটি আট সপ্তাহব্যাপী এলোমেলো পরীক্ষা এই ফলাফলকে আরও শক্তভাবে সমর্থন করেছে।

উল্লেখ্য, এলোমেলো ট্রায়াল হল একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা বা গবেষণার ধরন, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বা পক্ষপাত ছাড়া যতটা সম্ভব এলোমেলোভাবে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ওষুধ বা খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব পরীক্ষা করতে একটি গ্রুপে দেওয়া হয় নতুন ওষুধ বা খাবার, আর অন্য গ্রুপকেও দেওয়া হয় একইরকম দেখতে খাবার কিন্তু আসলে পরীক্ষার আসল ওষুধ বা খাবার সেটি নয়। একে প্লাসিবোও বলা হয়। এভাবে এলোমেলোভাবে গ্রুপ বণ্টন করা হয় যাতে ফলাফলে পক্ষপাত বা অন্য প্রভাব কমে যায় এবং গবেষণার ফলাফল বৈজ্ঞানিকভাবে শক্তিশালী হয়।

দিল্লির ফোর্টিস সি-ডক হাসপাতালে পরিচালিত গবেষণায় ৩৫ জন টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগী অংশ নেন। তারা তাদের সকালের নাস্তার পাউরুটির বদলে প্রতিদিন ২৫০ গ্রাম (প্রায় এক ছোট্ট আম) আম খেতে শুরু করেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, এই পরিবর্তনের পর তাদের উপবাসকালীন রক্তের শর্করা, গড় রক্তে শর্করার পরিমাপ, ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা, ওজন, কোমরের মাপ এবং ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সূচকগুলোতে ভালো উন্নতি হয়েছে।

এই সূচকগুলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরের সামগ্রিক বিপাকীয় স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষণার প্রধান লেখক অধ্যাপক অনুপ মিশ্র বলেন, ‘আমরা প্রথমবারের মতো দুটি বিস্তারিত গবেষণায় কার্বোহাইড্রেটের (পাউরুটি) বদলে অল্প পরিমাণে আম খাওয়ার উপকারিতা প্রমাণ করেছি। এটি আম খাওয়া নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাকে দূর করবে।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে আপনি ইচ্ছামতো আম খাবেন। মূল বিষয়টি হলো পরিমিত খাওয়া এবং চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা।’

অধ্যাপক মিশ্র জানান, যদি আপনার প্রতিদিনের ক্যালরি গ্রহণের সীমা ১ হাজারের ৬০০ হয়, তাহলে আমের ক্যালরি সেই মোট পরিমাণের অংশ হবে, অতিরিক্ত নয়। প্রায় ২৫০ গ্রাম ওজনের একটি ছোট আমে ১৮০ ক্যালরি থাকে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, পাউরুটির সমপরিমাণ ক্যালরি আম থেকে গ্রহণ করলে একই ধরনের ভালো ফল পাওয়া যায়।

ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ড. বকশিও একই ধরনের পরামর্শ দেন। তিনি তার রোগীদের বলেন, ‘যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে আমি তাদের সীমিত পরিমাণে (প্রায় অর্ধেক অংশ, যা থেকে ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়) দিনে একবার বা দুবার আম খাওয়ার অনুমতি দিই।’ তিনি আরও বলেন, আমের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। আম সব সময় খাবারের মাঝে খাওয়া উচিত, ডেজার্ট হিসেবে নয়। আম প্রোটিন বা ফাইবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন, কিন্তু জুস বা মিল্কশেকের মতো চিনিযুক্ত বা অন্য কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত