Ajker Patrika

এখন মৃত্যুর ভয় পাচ্ছি, হৃদয় খুলে দোয়া কর

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫: ২৯
এখন মৃত্যুর ভয় পাচ্ছি, হৃদয় খুলে দোয়া কর

ল্‌ভভের একটি বাংকারে বসে নীলিমার শেষ মেসেজটি ছিল, ‘বাংকারে খুব শীত’। এরপর থেকে ওকে ভাইবারে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা বন্ধুরা উৎকণ্ঠায় আছি। নীলিমাও সেটা জানে। তাই সুযোগ পেলেই কখনো ভাইবার গ্রুপে, কখনো ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

গত বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ছেলে নিকুঞ্জকে নিয়ে ট্রেনে করে খারকভ থেকে কিয়েভ পর্যন্ত পৌঁছেছিল নীলিমা। ওদের গন্তব্য ল্‌ভভ হয়ে পোল্যান্ড। গতকাল শুক্রবার সকালে ভাইবার গ্রুপে নীলিমা লিখেছিল, ‘শুভ সকাল। আর দুই ঘণ্টা পর আমরা ল্‌ভভে পৌঁছাব।’

নীলিমার স্বামী আজমল খারকভ থেকে রওনা হয়েছে অনেক পরে। নিজের গাড়ি নিয়ে। পাঁচ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়ির তেল নিতে পেরেছে।

‘আজমল কতদূর এল?’ জানতে চাইল বন্ধু সুশীল।

‘যোগাযোগ নাই। মনে হয় ফোনে চার্জ নাই। তারচেয়ে বড় বিষয়, ৬০ বছর পর্যন্ত কোনো ইউক্রেনীয় পুরুষকে দেশের বাইরে যেতে দেবে না।’

আজমলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না ও। তাই লিখেছে, ‘আজমল মনে হয় পথে কোথাও ঘুমাচ্ছে অথবা ফোনে চার্জ নেই।’

এই এক সমস্যা। চার্জ না থাকলে ওরা কী করে দেখা করবে? ল্‌ভভ বড় শহর, প্রাচীন শহর। মন ভালো করে দেওয়া শহর। কিন্তু এখন তা অচেনা সবার কাছে। কীভাবে দেখা হবে ফোনে চার্জ না থাকলে? এই দুশ্চিন্তা যে নীলিমাকেও গ্রাস করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল। ও লিখেছে, ‘তোমরা দোয়া করতে থাক। আজমলের জন্য চিন্তা হচ্ছে। প্রেশারের রোগী ও, ওষুধ আছে কি না, জানি না।’

নিউইয়র্ক থেকে বন্ধু সুষ্মি নীলিমাকে লিখেছে, ‘তোমাদের এখন কী অবস্থা? আমরা কি কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি? কোথায় আছো এখন?’

দুই ঘণ্টা পর নীলিমা লিখেছে, ‘অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা এখন মৃত্যুর ভয় পাচ্ছি। হৃদয় খুলে দোয়া কর।’

খারকভ, কিয়েভে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। রুশ সেনারা ঢুকে পড়েছে বিভিন্ন শহরে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ভাষণ দিয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন তিনি। কিয়েভ ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে জানিয়েছেন। পৃথিবীর আর কারও কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে একটু হতাশ তিনি।

রুশ আক্রমণের কারণে জনস্রোত চলেছে পোল্যান্ড সীমান্ত অভিমুখে। কেউ গাড়িতে, কেউ ট্রেনে, কেউ লরিতে করে পৌঁছাতে চাইছে পোল্যান্ড সীমানায়। সীমানায় বিশাল লাইন।

নীলিমার ফোনে চার্জ ছিল না। একটু চার্জ দিয়েছে কোথাও, তারপর লিখেছে, ‘আজমলের জন্য দোয়া কর। ওর খুব সমস্যা। ওকে ছাড়া আমি কী করে থাকব? আমি শুধুমাত্র ওর সঙ্গে থাকব বলে ইউক্রেনিয়ান বেছে নিয়েছিলাম। আর কখনো যদি ওর সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলে কী হবে? এখানে বলা হচ্ছে, খুব দ্রুত আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি চলে যেতে হবে।’

এরপর ভাইবার গ্রুপে আর কথা হয়নি। হঠাৎ বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে আমার ব্যক্তিগত ভাইবারে দেখলাম—ওদের ছবি পাঠিয়েছে নীলিমা। লিখেছে, ‘ভয়ে আছি। কিয়েভ দখলের পর ওরা (রাশানরা) সম্ভবত আগামীকাল (শনিবার) ল্‌ভভ দখল করতে আসবে। এই মুহূর্তে আমরা বাংকারে আছি।’

সঙ্গতকারণেই এই প্রশ্ন আসে মনে, ‘তোমরা তার আগে পোল্যান্ডে পৌঁছাতে পারবে না?’

নীলিমা লিখেছে, ‘আমরা একটা মাইক্রোবাস কিংবা ট্যাক্সি ভাড়া করতে চাইছি। আমার পরিবার ও আলম যাব তাতে। কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।’

ল্‌ভভ তখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় যেতে চাইছে না কোনো ভাড়া করা গাড়ি।

নীলিমা যেন নিজের মনে মনেই বলে, ‘একটু পরই রাত আসবে। আমি জানি না, বর্ডার এলাকা আমাদের জন্য কতটা নিরাপদ। বর্ডার এলাকায় ১৫ কিলোমিটারের উদ্বাস্তুর সারি।’

‘আজমল পৌঁছাতে পেরেছে?’

‘না। এখান থেকে অনেক দূরে ও এখন। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ও কখন পৌঁছাবে, তার কোনো নিশানা পাচ্ছি না। বাংকারে খুব শীত।’

এরপর নীলিমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। বুক কেঁপে ওঠে। আবার মনে হয়, কোনো একসময় নিশ্চয়ই নীলিমা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। একটা যুদ্ধে কত পরিবারকে ভয়, আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছে, তার একটি উদাহরণ বন্ধু নীলিমা।

তবে কিয়েভ ছাড়েনি আমাদের দুই বন্ধু টিপু আর মুন্নী। তাদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হলো, কেমন আছেন? টিপু ভাই লিখেছেন, ‘ভালো নেই। আমরা কিয়েভে।’ তাঁর স্ত্রী মুন্নী লিখল, ‘ভালো নাই। আর সবার যা হবে, আমাদেরও তাই হবে। দুশ্চিন্তা করিস না। তোরা ভালো থাকিস।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত