Ajker Patrika

বন্ধুর দায় নিষেধাজ্ঞায় শেষ

সাইরুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮: ৪১
বন্ধুর দায় নিষেধাজ্ঞায় শেষ

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার তোড়জোড়, হুমকি-ধমকি অনেক দিন ধরেই চলছিল। রুশবিরোধী বিশ্বশক্তিগুলোও ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইউক্রেনকে অভয় দিয়ে পাল্টা হুমকিতে তারা বলছিল, হামলা হলে তার দাঁতভাঙা জবাব দেবে, এই করবে, সেই করবে। হামলা শেষমেশ ঠিকই হলো, সেই রকম ত্রিমুখী-ত্রিমাত্রিক হামলা। কিন্তু ইউক্রেনের সেই বন্ধুরা বলতে গেলে কিছুই করল না। তারা শুধু রুশদের ওপর নিজেদের মতো করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে। ইউক্রেনেরও রুশ আগ্রাসন রুখে দেওয়ার সেই সামর্থ্য নেই। ফলাফল, হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাঁজোয়া যান নিয়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ঢুকে পড়েছেন রুশ সেনারা।

গতকাল হামলার দ্বিতীয় দিনে আরও অসহায় দেখা গেছে ইউক্রেনকে। কিয়েভের সরকারি স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে গতকালও একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে রুশ বাহিনী। বিশাল রুশ সামরিক শক্তির সামনে চুনোপুঁটি ইউক্রেন তাদের নাগরিকদের মোলোটভ ককটেল বা পেট্রলবোমা বানিয়ে শহর রক্ষার আহ্বান জানায়। অনেকটা নিরুপায় হয়েই সরাসরি আলোচনার আহ্বান জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তবে দেশবাসীকে উজ্জীবিত করতে এ সময় রুশ সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিকদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন তিনি।

কিয়েভের অসহায় আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে মস্কো। ক্রেমলিনের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে এ আলোচনা হতে পারে।

এর আগেই অবশ্য চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রাশিয়ার দখলে চলে যায়। আর লড়াইয়ের মাঠে ইউক্রেনের ৫৭ বেসামরিক নাগরিকসহ অন্তত ১৯৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানায় যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্য তথ্য দিয়েছে, রাশিয়ার অন্তত ৪৫০ সেনা নিহত হয়েছেন ইউক্রেনে ঢুকে।

কিয়েভে রুশ সেনা
প্রথম দিনের মতো ইউক্রেনীয়দের দ্বিতীয় দিনটাও শুরু হয় গোলাগুলির শব্দ শুনে। গতকাল প্রকট বিস্ফোরণের শব্দও শুনতে পান তাঁরা। তবে এদিন এসব শব্দ পাওয়া যায় রাজধানী কিয়েভ থেকে খুব কাছেই। এরই মধ্যে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, রুশ সেনারা কিয়েভের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। এ সময় শহর রক্ষায় নাগরিকদের মোলোটভ ককটেল বা পেট্রলবোমা বানিয়ে হামলা রুখে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনী জানায়, রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠের ডাইমার ও ইভানকিভ শহরে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে রাশিয়ার বেশ কিছু সাঁজোয়া যান দেখা গেছে। রুশ সেনাদের কিয়েভে প্রবেশ ঠেকাতে উত্তর পশ্চিমের টেটেরিভ নদীর সীমান্ত এলাকার একটি সেতু ধ্বংস করে দেন ইউক্রেনের সেনারা। কিন্তু ঠেকানো সম্ভব হয়নি।

এদিকে কিয়েভে একটি রুশ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানায় ইউক্রেন। এ ছাড়া শহরের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি করা হয়।

কিয়েভে আবাসিক এলাকায় আছড়ে পড়েছে যুদ্ধবিমান। ধ্বংস হয়েছে বাড়িঘর। তবে যুদ্ধবিমানটি কোন পক্ষের, তা জানা যায়নি। যদিও একটি রুশ বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইউক্রেনহতাহতের পাল্টাপাল্টি দাবি
ইউক্রেনে সামরিক হামলায় রাশিয়ার অন্তত ৪৫০ সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষাসচিব বেন ওয়ালেস। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিরক্ষাসচিব রেডিও-৪-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন দাবি করেন। এর আগে রাশিয়ার আক্রমণের প্রথম দিন ইউক্রেনে নিহত হয়েছেন ১৩৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক মানুষও রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৩১৬ জন। এ পর্যন্ত ১৯৪ ইউক্রেনীয় নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৭ জন বেসামরিক নাগরিক। তবে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করছে, এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।

কিয়েভের কাছে অবস্থিত হোস্টোমেল বিমানঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে রুশ বাহিনী। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, প্রায় ২০০ রাশিয়ান হেলিকপ্টার এ অপারেশনে জড়িত ছিল। এটি আন্তোনভ বিমানবন্দর নামেও পরিচিত। এতে করে ইউক্রেনের বিশেষ ইউনিটের ২০০ সেনা নিহত হয়েছেন। তবে রাশিয়ার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ‘স্ন্যাক’ দ্বীপে দুই দেশের বাহিনীর যুদ্ধে ১২ ইউক্রেনীয় মারা গেছেন।

জেলেনস্কির অসহায় আহ্বান
গতকাল জাতির উদ্দেশে ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি আলোচনার আহ্বান জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, ‘আমি আবার রাশিয়ান প্রেসিডেন্টকে বলতে চাই, ইউক্রেনের পুরো ভূখণ্ডজুড়ে লড়াই চলছে। আসুন, মানুষ হত্যা বন্ধ করতে আলোচনার টেবিলে বসি।’

এর বিপরীতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, মস্কো কিয়েভের সঙ্গে কথা বলার জন্য বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে প্রতিনিধি পাঠাতে প্রস্তুত। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আরআইএ-নোভোস্টি এ তথ্য জানায়। তিনি বলেন, ইউক্রেনের নিরপেক্ষ অবস্থা নিয়ে জেলেনস্কির আলোচনার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের প্রতিনিধিদের ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার জন্য পাঠাতে পারেন।

‘আমরা একা লড়ছি’
সংকটের শুরু থেকেই রুশবিরোধী বিশ্বশক্তিগুলোও ইউক্রেনের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু আগ্রাসন শুরুর পর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তারা। মাঠে একাই লড়তে হচ্ছে ইউক্রেনকে। এমতাবস্থায় গতকাল শুক্রবার সকালে ভিডিও বার্তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানান। এ সময় দ্বিতীয়বারের মতো ইউক্রেনের মিত্রদের সমালোচনা করেন তিনি। জেলেনস্কি বলেন, ‘রাশিয়া গতকাল নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে। কিন্তু আমাদের মাটি থেকে এই বিদেশিদের সরানোর জন্য এটি যথেষ্ট নয়। শুধু সংহতি ও সংকল্পের মাধ্যমে এটি অর্জন করা যেতে পারে।’

ক্ষমতা দখলের আহ্বান পুতিনের
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গতকাল এক টেলিভিশন ভাষণে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি তাদের ‘নিজের হাতে ক্ষমতা নিতে’ আহ্বান জানান। এ সময় তিনি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারকে ‘সন্ত্রাসী’ এবং ‘মাদকাসক্ত এবং নব্য-নাৎসিদের একটি দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পুতিন বলেন, ‘মনে হচ্ছে মাদকাসক্ত এবং নব্য-নাৎসিদের এই দলের চেয়ে আপনাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসা আমাদের পক্ষে সহজ হবে।’

নিষেধাজ্ঞা দিয়েই দায় সারা
ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিকভাবে একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে গতকাল জরুরি বৈঠক শেষ করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা। রাশিয়ার আর্থিক, জ্বালানি ও পরিবহন খাত লক্ষ্য করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন তাঁরা। তা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দ্বৈতভাবে ব্যবহৃত দ্রব্য, রপ্তানি ও রপ্তানিতে অর্থায়ন নীতি এবং ভিসা নীতিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। খসড়াটির চূড়ান্ত লিখিত রূপটি আনুষ্ঠানিকভাবে ইইউর সদস্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অনুমোদন দিলে এবং তা জোটের সাময়িকীতে প্রকাশের পরই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।

এর আগেই একের পর এক রুশ কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এরপর গতকাল অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। রাশিয়ার অলিগার্ক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দিতে যাওয়া দেশগুলোর তালিকায় গতকাল আরও যুক্ত হয় নিউজিল্যান্ড ও জাপান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত