Ajker Patrika

যুদ্ধের আঁধার ছেড়ে পালাচ্ছেন নীলিমারা

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮: ১২
যুদ্ধের আঁধার ছেড়ে পালাচ্ছেন নীলিমারা

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট যখন গতকাল বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বললেন, ডটেনস্ক আর লুহানস্ক প্রজাতন্ত্রের অনুরোধে তিনি ইউক্রেনে সেনা পাঠাচ্ছেন, তখনই মনে হলো, কেমন আছে নীলিমা, কেমন আছে আজমল? কেমন আছে ওদের ছেলে নিকুঞ্জ?

আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশোনা করেছি, তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা শেষে থেকে গেছে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয়। অমল আছে রাশিয়ায়, নীলিমা আর আজমল খারকভে। নীলিমা আর আমি একই ফ্লাইটে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলাম। সে ১৯৮৬ সালের কথা। দুজন দুই ভিন্ন শহরে পড়াশোনা করেছি, কিন্তু বাঙালি শিক্ষার্থীদের সম্মেলনে দেখা হয়ে যেত কিয়েভে কিংবা ওদেসায়। মস্কো কিংবা ডটেনস্কে। নীলিমা বিয়ে করেছে আজমলকে। ওরা ইউক্রেনের খারকভ শহরে থাকে। আজমলের সেখানে ব্যবসা। নিজ পরিশ্রমে গাড়ি-বাড়ি করেছে। নীলিমা চিকিৎসক।

উত্তর পাব কি পাব না, সেটা না জেনেই মেসেঞ্জারে নীলিমাকে লিখলাম, ‘কেমন আছ তোমরা?’

অনেকক্ষণ উত্তর নেই। আমাদের ঢাকার সময় বেলা তিনটার দিকে নীলিমার উত্তর, ‘চারদিকে গোলাগুলি চলছে। আমি ট্রেনে।’

ট্রেনে বলতে প্রথমে ভাবলাম মেট্রো বা সাবওয়েতে বুঝি। একটু পরেই টনক নড়ল, না, নীলিমা যদি ট্রেনের কথা বলে থাকে, তাহলে তা অবশ্যই রেলগাড়ি। পোল্যান্ড তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছে ১৫ দিনের জন্য। নিশ্চয়ই নীলিমারা পোল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে।

এ সময় আরেক বন্ধু অমল ফোন করল মস্কো থেকে, ‘আজমলের সঙ্গে একটু আগে কথা হলো। ও দাঁড়িয়ে আছে ফিলিং স্টেশনে। বিশাল লাইন।’

‘নীলিমা কোথায়?’ জানতে চাই অমলের কাছে।

‘নীলিমা আর নিকুঞ্জ ট্রেনে। ওরা ল্‌ভভের দিকে যাচ্ছে। সেখানে আমাদের আরেক বন্ধু আলম আছে। ওখানেই উঠবে। তারপর চেষ্টা করবে পোল্যান্ড সীমান্ত পার হতে। আজমল ওদের সঙ্গে যোগ দেবে।’

নীলিমা কেন ‘ট্রেনে’ বলেছিল, তা এবার পরিষ্কার হলো।

নীলিমার আরেকটি মেসেজ, ‘গোলাগুলির শব্দ কয়েক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। বাচ্চাকে নিয়ে এখানে থাকা নিরাপদ মনে করিনি।’

জানা গেল, নিজের সবকিছু ছেড়ে এভাবে শহর ছাড়তে চায়নি আজমল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন বুঝতে পারছে, আর থাকা যাবে না।

রাশিয়া–ইউক্রেন–বেলারুশ এই তিন স্লাভ জাতি মিলেমিশেই ছিল একসময়। কিয়েভ রুশ থেকে মস্কোতে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল রুশ সাম্রাজ্য। একই সঙ্গে মোকাবিলা করেছে তাতার-মোঙ্গলদের সন্ত্রাস। তবে ইউক্রেনের পশ্চিম দিকের শহরগুলোয় রুশ-বিদ্বেষ ছিল আগে থেকেই, যার মধ্যে ল্‌ভভ শহরটির নাম সবার আগে মনে পড়ে। অন্যদিকে পূর্ব ইউক্রেনের শহরগুলোয় রুশ প্রভাব ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন হওয়ার কারণে সেখানে রুশদের বসতি গড়ে উঠেছিল। ইউক্রেনের শিল্পকারখানাগুলো সে দিকেই বেশি।

রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া নিয়ে নেওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে অস্থিরতা বেড়েছে। রাশিয়ার নৌ শক্তির মূল ঘাঁটিই তো ছিল এই ক্রিমিয়া। ফলে ক্রিমিয়ার দখল নেওয়া তাদের জন্য দরকার ছিল। এই তো কিছুদিন আগে ইউক্রেনের অংশ লুহানস্ক ও ডনেটস্ক প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়া। তাদের আহ্বানেই নাকি রুশ সৈন্য ঢুকেছে এই এলাকায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন না তিনি, শুধু লুহানস্ক আর ডনেটস্কের মানুষের বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করছেন। কিন্তু তাতে ওই সব এলাকার মানুষেরা নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

রাশিয়া-ইউক্রেনের দ্বন্দ্বের একটি বড় কারণ, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া না-হওয়া। রাশিয়া তার নাকের ডগায় এ রকম একটি ন্যাটোভুক্ত দেশ চায় না। পশ্চিমা বিশ্বও বহু আগে থেকেই রাশিয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সেটা আরও আঁটসাঁট করা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আসলে অসহায় বোধ করছে ইউক্রেনের মানুষ। আমাদের বাঙালি বন্ধুরাও সেখানে নিরাপদ নয়।

সন্ধ্যা ছয়টার (বাংলাদেশ সময়) দিকে নীলিমা লিখেছে, ‘আমাদের ট্রেন কিয়েভের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আজমলের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে আবার ল্‌ভভে। আমরা একসঙ্গে হলে তারপর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’

খারকভ ছাড়ার আগে আজমল লিখেছে, ‘চারদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। খাবার দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে।’

তিন-চার দিন ধরে ভয়ার্ত মানুষ ইউক্রেনের নানা শহর ছাড়ছে, এটা জানা ছিল। কিন্তু এমন করে যে উদ্বাস্তু হওয়া জনস্রোত বয়ে যাবে সীমান্তের দিকে, সেটা কে আগে থেকে ভাবতে পেরেছিল?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত