Ajker Patrika

বিমা দাবি বাড়ছে, আস্থা কমছে

মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৫, ০১: ৫৯
বিমা দাবি বাড়ছে, আস্থা কমছে
প্রতীকী ছবি

ভরসার বিমা এখনো বহু গ্রাহকের কাছে অবিশ্বাসের নাম। এর যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে। দেশের ৪৬টি নন-লাইফ কোম্পানি মিলে গ্রাহকের দাবির ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আটকে রেখেছে। ডিসেম্বরের শেষে যেটি ছিল ২ হাজার ৬৩৫ কোটি, মার্চের শেষে সেখানে আরও ৫১৫ কোটি টাকা যোগ হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে অনিষ্পন্ন দাবির পাহাড় আরও উঁচু হয়েছে।

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ অনিরীক্ষিত হিসাব বলছে, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাধারণ বিমায় মোট দাবি দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সেখানে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ২৯৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। গড় হিসাব টেনে দেখা যায়, প্রতি ১০০ টাকা দাবির সাড়ে আট টাকার কম পরিশোধ করা হয়েছে, বাকি প্রায় ৯১ টাকা গ্রাহকের হাতে পৌঁছায়নি। এই সংখ্যা খাতটির বর্তমান আস্থাহীনতার নীরব সাক্ষী।

মাঠের অভিযোগও সেই ছবি আঁকে। গ্রাহকেরা কাগজপত্রের ঝক্কি, সার্ভে রিপোর্টের জটিলতা, পুনর্বিমার অজুহাত, নানা দরজায় ধাক্কা দিয়ে শেষে ক্লান্ত হন; কিন্তু দাবি মেটে না। প্রতিবেদন অনুসারে, গ্রাহকদের বিমার টাকা পরিশোধ না করার শীর্ষে রয়েছে সিকদার ইনস্যুরেন্স। কোম্পানিটির বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ২৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা, এর মধ্যে পরিশোধ করেছে মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার। অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ বিমার টাকা দেয়নি কোম্পানিটি। বিমা দাবি পরিশোধ না করার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সেনা কল্যাণ ইনস্যুরেন্স, ৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার বিপরীতে দিয়েছে মাত্র ৭ লাখ ৫০ হাজার। পরিশোধের হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে থাকা নর্দান ইসলামী ইনস্যুরেন্স ৬৪ কোটি ৫২ লাখ টাকার মধ্যে দিয়েছে ৬ কোটি ৮৭ লাখ এবং পরিশোধের হার ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। অপর দিকে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স ও ঢাকা ইনস্যুরেন্স যথাক্রমে ১ দশমিক ৪৪ ও ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ দাবি পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ দুটি কোম্পানির প্রায় ৯৯ শতাংশ দাবি বকেয়া রয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, অধিকাংশ কোম্পানি গ্রাহকদের দাবি নগণ্য হারে পরিশোধ করেছে। পিপল ইনস্যুরেন্স দিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, ইস্টার্ন ৩ দশমিক ১৬, দেশ জেনারেল ৩ দশমিক ৪৪, এসবিসি ৩ দশমিক ৭৯, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ৪ দশমিক ০১ এবং এশিয়া প্যাসিফিক ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। তুলনামূলক কিছুটা বেশি পরিশোধ করেছে পূরবী জেনারেল ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ, সাউথ এশিয়া ৭ দশমিক ৮০ এবং প্যারামাউন্ট ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রয়েছে ফনিক্স ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, গ্রিন ডেলটা ৯ দশমিক ৪৭ ও মার্কেন্টাইল ইসলামী ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

আইডিআরএর চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম আজকের পত্রিকা'কে বলেন, দাবি নিষ্পত্তি না হওয়া এই খাতের প্রধান সমস্যা। মূলত এই কারণে পরিস্থিতি একটি ক্রান্তিকাল পেরোচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, ‘সমস্যা শনাক্ত হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ বাস্তবতা হচ্ছে, বিমার বাজারে যে আস্থার ক্ষয় তৈরি হয়েছে, সেটি শুধু আশ্বাসে পূরণ হয় না; এখানে দ্রুত ও দৃশ্যমান ফল দেখতে চায় সবাই।

অন্যদিকে বিপরীত প্রান্তে জনতা ইনস্যুরেন্স দাবি নিষ্পত্তিতে সেরা, তারপর ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইনস্যুরেন্স। এসব প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করছে, ইচ্ছা ও প্রক্রিয়া থাকলে অর্থ ছাড় সম্ভব। অর্থাৎ সেক্টরের জট শুধু টাকার ঘাটতি নয়; বরং শাসনব্যবস্থা, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতার ঘাটতিও সমান দায়ী।

তবে এ নিয়ে কোম্পানিগুলোর ব্যাখ্যা বরাবর পুরোনো। জানতে চাইলে সিকদার ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রফিক বলেন, ‘৫ আগস্টের কয়েকটি দুর্ঘটনার দাবি সাধারণ বিমা করপোরেশনে পড়ে রয়েছে। এসবিসি থেকে অর্থ পেলে দেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, এই বক্তব্য বাজারের কাঠামোগত দুর্বলতাকে তুলে ধরে। তাঁদের প্রশ্ন, রি-ইনস্যুরেন্স বা পুনর্বিমার ধারায় সমন্বয়ে ব্যর্থ হলে প্রাইমারি গ্রাহক কেন আটকে থাকবেন? তাঁরা মনে করেন, এই দায় এড়ানো যায় না।

খাতটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ফোরামের জয়েন্ট সেক্রেটারি এস এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘দাবি পরিশোধে আইডিআরএ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। আবার এখানে গ্রাহকের প্রস্তুতি দরকার। দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে নির্ভুল কাগজপত্র জমা, প্রতিটি যোগাযোগ নথিভুক্ত রাখা, ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে আইডিআরএতে অভিযোগ, প্রয়োজনে বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটিতে আবেদন, তাতে সমাধান না এলে দ্রুত আদালতের শরণাপন্ন হওয়া; এই ধাপগুলো শৃঙ্খলা হিসেবে পালন করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত