Ajker Patrika

করোনার প্রভাবে জলঢাকায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ

মো: মাহবুবর রহমান মনি
করোনার প্রভাবে জলঢাকায় বেড়েছে বাল্যবিবাহ

জলঢাকা (নীলফামারী): করোনাকালে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে জলঢাকায়। উন্নয়নকর্মীরা বলছেন, এই হার এখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। মূলত দারিদ্র্য এবং করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাই এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এ নিয়ে তেমন একটা তথ্য নেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যদিও তারা দাবি করছে, বাল্যবিয়ে বন্ধে তৎপর রয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্য বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে তাঁদের সংখ্যাই বেশি।

জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়ন এ গিয়ে দেখা মিলল ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর। সংসারের কাজে ব্যস্ত। সাংবাদিক দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় ওই কিশোরী। মাস খানিক আগে তার বিয়ে হয়েছে। স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালো বাবা নেই, অভাবের সংসার। এ ছাড়া স্কুলও অনেক দিন বন্ধ। তাই ধার দেনা করে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে জানাল, স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াব। কিন্তু তা আর হলো না । ওই কিশোরীর বাড়ি থেকে বের হতেই দেখা মিলল ১৭ / ১৮ বছরের এক তরুণীর। কোলে আড়াই বছরের শিশু। ওই তরুণীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রাজি হলো। জানাল ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে দেওয়া হয়। শ্বশুর বাড়িতে এসে সব কাজের দায়িত্ব তার উপড়ে পরে। সংসারের অনেক কিছুই সে তখন বুঝত না । পদে পদে বিড়ম্বনা এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজনের লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। এ ছাড়াও শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগতে থাকে।

জলঢাকা উপজেলার চাঁদমনি অনাথ আশ্রমে দীর্ঘ দিন ধরে অসহায়, অভাবে থাকা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু, কিশোরীরা বিনা পয়সায় থেকে লেখাপড়া করেন। বর্তমানে ৩৫ জনের মতো কিশোরী রয়েছেন। আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল জানান, করোনার প্রাদুর্ভাবে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল তখন অভিভাবকেরা তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে শুরু করল। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম অধিকাংশরাই তাদের মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন। যাদের বেশির ভাগরই বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছর।

তিনি জানান, দারিদ্র্যই মূলত বাল্য বিয়ের কারণ, আর এ সময় যৌতুকের চাহিদা কম। এ ছাড়া করোনাকালীন স্কুল বন্ধ থাকা এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং এর অভাবেই বাল্যবিয়ে বেড়েছে। কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকদের সঙ্গে। জানান, স্কুল বন্ধ, করোনার কারণে আয় রোজগার বন্ধ। মেয়েকে বাড়িতে বেশি দিন রাখতে চান না​। মেয়েকে সংসারী করতে এমন সিদ্ধান্ত তাঁদের। অধিকাংশ অভিভাবকদেরই মতামত একই পাওয়া গেল।

উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএস এর তথ্যমতে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত জলঢাকায় বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ৬৮ জন। আর করোনাকালীন সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই হার বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে স্কুল বন্ধ থাকায় এই তথ্য হাল নাগাদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এর উপপরিচালক আনিসুর রহমান এর সঙ্গে। তাঁর কাছে এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি স্বীকার করেছেন করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় সহিংসতা ও বাল্য বিয়ে বেড়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ. এইচ. এম রেজওয়ানুল কবীর বলেন, শারীরিক অপরিপক্বতার কারণে গর্ভধারনসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন বাল্যবিয়ের শিকার এসব কিশোরী। এমনকি মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে। তিনি বলেন, এই সময়টাতেই মূলত কিশোরীদের শারীরিক গঠন পরিপক্ব হয়। এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান বলেন, বাল্য বিয়ে বন্ধে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমরা যখনই খোঁজ পাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে রোধে গণ সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচির কথাও তুলে ধরেন তিনি।

উদয় অঙ্কুর সেবা সংস্থা এর নির্বাহী পরিচালক আলাউদ্দিন আলী বলেন, করোনা কালে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে আর নীলফামারী জেলায় দারিদ্র্যের হার এমনিতেই বেশি। স্কুল বন্ধ থাকায় যেসব পরিবারের আয় কম তারা অল্প বয়সী মেয়েকেই বিয়ে দিচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ আর এই বন্ধ থাকার কারণে করোনা রোধে যে সংগঠনগুলি কাজ করে তাদের সঙ্গে শিক্ষক শিক্ষার্থীর দূরত্বের কারণে এর প্রভাবটি বেড়েছে, এবং সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরগুলোর এই কারণে সঠিক নজরদারি নিতে ব্যাহত হচ্ছে। তবে এখনো সচেতন হলে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব বলে জানান এই উন্নয়ন কর্মকর্তা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত