Ajker Patrika

সরগরম ঘিওরের ঢাক ঢোল পাড়া

ঘিওর, (মানিকগঞ্জ), প্রতিনিধি 
সরগরম ঘিওরের ঢাক ঢোল পাড়া

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া গ্রামের মনিদাশ পাড়াকে সবাই ঢাক ঢোল পাড়া হিসেবেই চেনে। দীর্ঘদিনের করোনকালীন স্থবিরতা কাটিয়ে মুনিদাশ পাড়া জেগে উঠেছে নব উদ্যমে। 

দুর্গা পূজাকে সামনে রেখে ঢাক, ঢোল, ডুগি আর তবলা  তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সবাই। বাড়ির গৃহবধূদের যেন দম ফেলার সময় নেই। তাদের সময় কাটছে ডুগি তবলার বিড়া তৈরি করার কাজে। ঘর গৃহস্থালির কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা যুক্ত হয়ে পড়েন নানান কাজে। দিন রাত বিরামহীনভাবে চলে তাদের এই কাজ। 

এ বিষয়ে মনিদাশ পাড়ার প্রবীণ কমল চন্দ্র দাস (৬৮) বলেন, পূর্ব পুরুষদের এই পেশা ধরে রাখতে তিনি ৪ যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাক ঢোল তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন, মনিদাশ পাড়ায় প্রায় ৩৫টি পরিবারের শতাধিক ব্যক্তি এই ঢাক ঢোল বানানোর কাজে জড়িত। কেউ পৈতৃক পেশা হিসেবে আবার কেউ দিন মজুর হিসেবে এই কাজ করে থাকেন। এতে খরচ বাদে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা রোজগার হয়। 

এ পাড়ার আরেক প্রবীণ ব্যক্তি গোকুল চন্দ্র দাস (৬৫) বলেন, শ্রীকান্ত বাবু নামের এক অভিজ্ঞ বাজনাদার গুরুর কাছ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষদের কয়েকজন এই কাজটি শিখেছিলেন। পরবর্তীতে অনেকেই এই কাজের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। মোটামুটি পাড়ার সবাই এই কাজ করেই সংসার চালান। 

এখানে পাইকারি এবং খুচরা বাদ্য যন্ত্র বিক্রি করা হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বড় বড় বাদ্যযন্ত্রের শোরুমে থেকে এখানে অর্ডার আসে। এমনকি বিদেশ থেকেও বাদ্য যন্ত্রের অর্ডার আসে এখানে। 

সরেজমিনে বালিয়াখোড়ার মনিদাস পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির উঠোনে ঢোল তৈরির পর রঙের প্রলেপ দিচ্ছিলেন মানিক চন্দ্র দাস ও চিত্ত রঞ্জন দাস। পাশেই কাপড় আর সুতা দিয়ে ঢোলের বিড়া বানানোর কাজে ব্যস্ত গৃহবধূ যমুনা রানী দাস। আশপাশের বাড়িগুলো থেকেও আসছে টুং টাং শব্দ। 

মানিক চন্দ্র দাস ও চিত্ত রঞ্জন দাস জানান, আমরা প্রায় ২০ বছর ধরে এই কাজের সঙ্গে জড়িত। বাদ্য যন্ত্র তৈরিতে আমরা আম, নিম, শিমুল কাঠ ব্যবহার করে থাকি। এখানে আমরা ঢাক, ঢোল, ডুগি, তবলা, হাত বাওয়া, নাল ও বাচ্চাদের ঢোল তৈরি করে থাকি। এখানে কাঠ ও আকারভেদে বাদ্য যন্ত্রের দাম বিভিন্ন রকমের। তবে একটি ঢাক ৩ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা, তবলা ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা, হাত বাওয়া ২ শত থেকে ৪ শত টাকা, একেকটি নাল দেড় থেকে তিন হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে। একেকটি যন্ত্র তৈরি করতে প্রায় ৪ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। ক্রেতারা যেভাবে অর্ডার দেয় আমরা সেভাবেই কাজ করে দেই। 

গৃহবধূ যমুনা রানী দাস বলেন, তারা বানান ডুগি-তবলার বিড়া। গৃহস্থালির কাজ শেষে তারা এ কাজে বসে পড়েন। তাদের বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। আর পূজা এলে তো কথাই নেই। ব্যস্ততা বেড়ে যায় বহু গুণ। নাওয়া-খাওয়ার সময়ও পান না তারা। 

সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী আকাশ চন্দ্র দাস বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি এ কাজে তিনি পিতাকে সহায়তা করেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের তৈরি বাদ্যযন্ত্র ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জায়গায় যায়। এ বছর আমরা ঢোলের সবচেয়ে বড় অর্ডার পেয়েছি রামপুরার বাংলাদেশ তাল তরঙ্গ ও চট্টগ্রামের সুর বীণা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। 

স্থানীয় বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ আব্দুল আওয়াল খান বলেন, বংশ পরম্পরায় বালিয়াখোড়া গ্রামের মনি দাস পাড়ার লোকজন বাদ্য যন্ত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তাদের তৈরিকৃত বাদ্যযন্ত্রের চাহিদা দেশজুড়ে। এ ছাড়া এ পাড়ার বাসিন্দারা বাদ্যযন্ত্র তৈরির পাশাপাশি তাদের বাদ্য বাজানোর সুনামও রয়েছে। 

ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, বালিয়াখোড়ার মনি দাস সম্প্রদায়ের লোকজনের এই ঢাক ঢোলেই ঘুরে গেছে তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। তাদের শৈল্পিক হাতের কাজের পরিচিতি পেয়েছে দেশজুড়ে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা এমনকি দেশের বাইরেও ঘিওরের মুনিদাশ পাড়ার অনেক সুনাম আছে। পরিশ্রম বেশি তবে লাভ খুব বেশি না জানালেন ঢাকঢোল পাড়ার বাসিন্দারা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো এই শিল্পটি আরও সমৃদ্ধ হবে এমনটিই প্রত্যাশা তাদের। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত