Ajker Patrika

‘আমাগো ঈদটারে আজন্মের জন্য মাটি দিয়া আইলাম’

সাখাওয়াত ফাহাদ ও হামিদুল ইসলাম লিঙ্কন 
‘আমাগো ঈদটারে আজন্মের জন্য মাটি দিয়া আইলাম’

সকালবেলা বাবা জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিল তেরো বছরের রাব্বী। বাসায় ফিরে ফিরনি, সেমাই খেয়েই বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে। ছয় বন্ধু মিলে গিয়েছিল শ্যামপুরের বুড়িগঙ্গা ইকো পার্কে। সেখানে কয়েকটি রাইডে ওঠার পর ছয়জন মিলে রোলার কোস্টারে ওঠে। হঠাৎ চলন্ত রোলার কোস্টার থেকে ছিটকে পড়ে রাব্বী। রোলার কোস্টারের পিলারের সঙ্গে আঘাত লেগে মাথা ফেটে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় রাব্বীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করে। 

ঈদের দিন সন্তানকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল রাব্বীর বাবা-মা। মুন্সিগঞ্জের ইমামগঞ্জে রাব্বীর নানার বাড়িতে নেমেছে শোকের ছায়া। এ ঘটনায় ঈদের খুশি উবে গিয়ে কান্নার রোল পড়েছে উঠানে। আজ বুধবার দুপুরে রাব্বীর নানার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রাব্বীর বাবা-মা বিলাপ করছেন। কান্নাকাটি করতে করতে দুজনেরই গলা ভেঙে গেছে। কথা বলতে পারছেন না। রাব্বীর মা রুমা আক্তার থেমে থেমে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন।

রাব্বীর বাবা জয়নাল আবেদীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সকালেও আমার ছেলেটা আমার সঙ্গে নামাজ পড়তে গেছে। দুপুরে আমরা সবাই বাসায় ছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে বইলা বাসা থেইকা বাইর হইছে। এতদূর যাইব জানলে কি আর বাইর হইতে দিতাম? আমার আর কোনো ঈদ নাই। আমাগো ঈদ আজন্মের জন্য মাটি দিয়ে আইলাম। আমাগো আর কোনো ঈদ নাই। এখন ঈদ আইলেই আমার পোলাডার কথা মনে পড়ব।’

রাব্বীর মা রুমা আক্তার বলেন, ‘আমার বড় ছেলেটা দুবাই থাকে। পড়াশোনা বেশি করে নাই। ইচ্ছা ছিল রাব্বীরে অনেক পড়াশোনা করাব। কিন্তু সেই সাধ আর পূরণ হইলো না। এখন আমি কেমনে বাঁচব আমি জানি না।’ রাব্বী স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত বলে জানান তিনি। 

রাব্বীর খালাতো ভাই মো. শাকিল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাব্বী যে প্যান্ট পরে বের হয়েছিল সেটা একটু ঢিলা ছিল। রাইড চলার সময় ও একটু ওপরের দিকে উঠে প্যান্ট ওঠানোর চেষ্টা করছিল। তখনি হঠাৎ বাঁক নেওয়ায় ও রাইড থেকে পড়ে যায়।’

গেন্ডারিয়ার অক্ষয় দাস লেনে রাব্বীদের বাসার নিচতলার প্রতিবেশী আবদুল হান্নান সেন্টু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাচ্চাটা প্রায়ই নিচে খেলাধুলা করত। আমাদের বাসায়ও আসত। একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। বেশ হাসিখুশি একটা ছেলে।’

এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে জানিয়ে কদমতলী থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা বলেন, ‘তারা ছয়জন গতকাল (মঙ্গলবার) শ্যামপুর ইকোপার্কে গিয়েছিল। সেখানে রোলার কোস্টারে টিকিট কেটে সবাই একসঙ্গে ওঠে। রাইড চলা অবস্থায় রাব্বী দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। বাঁক নেওয়ার সময় সে রাইড থেকে পড়ে যায়। পড়ে মাথায় আঘাত পায়। মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে তার।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দীপঙ্কর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পার্কের রোলার কোস্টারে কোনো কারিগরি জটিলতা আমরা পাইনি। মূলত রাইড চলার সময় দাঁড়ানোর অবস্থা থেকে রাব্বী নিচে পড়ে যায়। এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।’

বুড়িগঙ্গা ইকো পার্কের রোলার কোস্টার রাইডের দায়িত্বে থাকা পার্কের সিনিয়র টেকনিশিয়ান মো. আসলাম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘১টা থেকে দেড়টার দিকে তারা আসছিল। সঙ্গে বড় কেউ ছিল না। রাইড চলার সময় একটু ওপর থেকে নিচের দিকে যখন নামছিল তখন ছেলেটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ পড়ে গিয়ে পিলারের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে মাথা ফেটে যায়।’ গত ছয় বছরে এমন কোনো দুর্ঘটনা এই পার্কে কখনো ঘটেনি বলেও জানান তিনি। 

২০১০ সালে বুড়িগঙ্গার পাড়ের এই জায়গাটি দখলমুক্ত করে বিআইডব্লিউটিএ। ২০১২ সালের শেষ দিকে নিজেদের উদ্যোগে গাছ লাগিয়ে ইকোপার্ক তৈরি করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে পার্কটি নেপচুন এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া হয়। পাইরেট শিপ, রোলার কোস্টার, সুইং চেয়ার, ফ্রিজবিসহ ২৪টি রাইড রয়েছে পার্কটিতে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ রাইডগুলোতে নেই যথেষ্ট আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এমনকি রোলার কোস্টারের মতো রাইডারে কোনো সিট বেল্ট নেই।

বুড়িগঙ্গা ইকো পার্কের ঝুঁকিপূর্ণ রাইডারগুলোতে নেই সিট বেল্টনিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে নেপচুন এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড অ্যামিউজমেন্টের পক্ষে ইকোপার্কের ইনচার্জ সাদ্দাম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের রাইডগুলো প্রায় প্রতিদিনই চেক করা হয়। আমরা তো চাই না আমাদের সুনাম নষ্ট হোক। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে ৪শ মানুষ আসে। আমরাও কখনোই চাই না কোনো দুর্ঘটনা ঘটুক। কিন্তু দুর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে আসে না। দুর্ঘটনা হয়ে যায়। বাচ্চাটির পরিবারের সঙ্গে আমাদের কর্তৃপক্ষ কথা বলবে। এখন তো সম্ভব না, তাই কয়েক দিন পর আমরা যাব।’

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিয়ের যুগ্ম-পরিচালক (প্রশাসন) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ঘটনাটি শুনেছি। আমাদের ইকোপার্কগুলোতে এই প্রথম এমন কোনো ঘটনা ঘটল। বিষয়টি কীভাবে হয়েছে তা আমরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না। তবে যাই হোক এটা বিআইডব্লিউটিয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ভুল না। পার্কটি একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়া আছে। একটা কমিটি করে তাদের শোকজ করা হতে পারে। তবে এর সমস্ত দায়দায়িত্ব লিজ প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত