Ajker Patrika

রাজধানীতে চাঁদার অঙ্ক ১০লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা

  • ৬ মাসে ডিএমপির ৫০ থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগে ৪১৯ মামলা।
  • সব চেয়ে বেশি চাঁদাবাজির মামলা মতিঝিল বিভাগে, কম লালবাগে।
  • জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়েও চলছে চাঁদা দাবি।
আমানুর রহমান রনি, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরের বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ী সোহেল রানাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন একটি রাজনৈতিক দলের শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা ও কয়েকজন সন্ত্রাসী। দোকান ও বাসায় গিয়ে তাঁকে কয়েকবার মারধরও করা হয়। মামলা করার পর পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার না করায় ভয়ে তিনি কয়েক দিন দোকানই বন্ধ রাখেন।

চাঁদাবাজদের ভয়ে বেনারসিপল্লির অন্য কয়েক ব্যবসায়ী দোকানে বসছেন না। শুধু মিরপুর নয়, রাজধানীর অন্যান্য এলাকায়ও চাঁদাবাজির ঘটনা কমবেশি আছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানায় গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪১৯টি চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ না করার পরও মামলার এমন সংখ্যাই বলে দেয় রাজধানীতে চাঁদাবাজি বেড়েছে। বেড়েছে চাঁদার অঙ্কও। চাঁদাবাজেরা সর্বনিম্ন ১০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করছে। এই চাঁদাবাজির সঙ্গে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও জড়িত।

চাঁদাবাজদের ভয়ে কয়েক দিন দোকান বন্ধ রাখা বেনারসিপল্লির ব্যবসায়ী সোহেল রানা আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ১০ লাখ টাকা চাঁদার জন্য গত ১০ মে থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত অন্তত ১২ বার তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ১১ জুলাই রাতে তাঁকে দোকানে গিয়ে মারধর করেন পল্লবী থানা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক বশিরুল আলম বশির ও তাঁর সহযোগী সেকান্দারসহ কয়েকজন। তিনি চাঁদা দাবির অভিযোগে ২৮ জুলাই পল্লবী থানায় বশির, সেকান্দারসহ ৬-৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু এরপর আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে হুমকি দেয়। থানা-পুলিশ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। বরং পল্লবী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অহিদুজ্জামান ভূঁইয়া তাঁকে বশির ও সেকান্দারের সঙ্গে ‘মানিয়ে চলতে’ বলেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই অহিদুজ্জামান বলেন, তিনি বশিরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, যাতে সোহেলকে বিরক্ত না করেন।

বর্তমানে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আরিফ রব্বানী বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে, তবে সবাই পলাতক।

জানা গেছে, সোহেলের অভিযোগের ভিত্তিতে সেকান্দারকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করলেও পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে বশিরুল আলমকে মোবাইল নম্বরে কয়েকবার ফোন দিলে একবার একজন ধরে নিজেকে বশিরের বন্ধু পরিচয় দেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। ১৫ আগস্ট পল্লবীতে বশিরের বাসায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

সরেজমিনে ১৫ ও ১৬ আগস্ট বেনারসিপল্লিতে দেখা গেছে, চাঁদাবাজির ভয়ে মালিকেরা শাড়ির দোকানে বসছেন না। কর্মচারীরাও মালিকের বিষয়ে কিছু বলতে চান না। বেনারসি কুটিরে ১৩ আগস্ট রাতে সন্ত্রাসীদের হামলার পর আতঙ্ক বেড়েছে। দোকানমালিকেরা বলেন, বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা চাইছে। কখনো জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে টাকা চায়।

বেনারসিপল্লির দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কাসেম বলেন, ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে আছেন। যাদের কখনো এ মার্কেটে দেখেননি, তারা এসেও ভয় দেখাচ্ছে। হত্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়েও মোটা টাকা দাবি করছে। বশিরুল আলমের বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির শীর্ষ নেতাদেরও জানানো হয়েছে।

ডিএমপির আটটি অপরাধ বিভাগ হলো মিরপুর, মতিঝিল, তেজগাঁও, গুলশান, ওয়ারী, উত্তরা, রমনা ও লালবাগ। সব বিভাগেই চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫০টি থানায় চাঁদাবাজির অভিযোগে করা ৪১৯টি মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৩টি মামলা হয়েছে মতিঝিলে। এরপর তেজগাঁওয়ে ৭২টি। সবচেয়ে কম ৩৩টি লালবাগের থানাগুলোতে। মামলাগুলোতে ১০ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকার চাঁদা দাবির অভিযোগ করা হয়েছে। অনেককে জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় আসামি করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রধানত মোটা অঙ্কের চাঁদা ও হত্যার হুমকির ঘটনায় মামলা করা হয়েছে; ছোট অঙ্কের চাঁদাবাজিতে মামলা হয়নি।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ছয়টি থানায় হওয়া ৭২টি চাঁদাবাজি মামলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মামলাটি হলো রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে। অভিযোগে বলা হয়েছে, জুনে গ্রিন রোডে তাঁর অফিসে ঢুকে চাঁদাবাজেরা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১১টি চেকে ৫ কোটি টাকা লিখিয়ে নেয়। অবশ্য এ ঘটনায় তাঁর ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম তেজগাঁও থানায় মামলা করেন দুই মাস পর।

গুলশানে সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী শাম্মী আহমেদের বাসায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় গ্রেপ্তার রিয়াদের কাছ থেকে কয়েকটি চেকবই উদ্ধারের পর বিষয়টি প্রকাশ পায়। গুলশান থানা-পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রটি আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে চেক নেওয়ার বিষয়টি জানায়।

তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাজমুল জান্নাত শাহ জানান, গুলশানের ঘটনায় গ্রেপ্তার রিয়াদসহ চারজনকে গ্রিন রোডের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘ভয়ে আমি মামলা করিনি। তারা ক্রমাগত হুমকি দিয়েছে, পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছে। হত্যা মামলার আসামি করার হুমকিও দিয়েছে। আমাকে যে অপমান করা হয়েছে, তা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’

জাকির হোসেন নামের এক ব্যক্তির অভিযোগ, কলাবাগান থানার পান্থপথের আসবাবের মার্কেটে তাঁর দোকান ‘পিদিম ট্রেড ফার্নিচার’ ১০ ফেব্রুয়ারি ভাঙচুর করে দখল করা হয়েছে। দোকানের নাম বদলে হয়েছে ‘কামাল ফরেন ফার্নিচার’। তাঁর অভিযোগ, গত বছরের ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজেরা মাসিক ভাড়া ও ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। তবে তিনি থানায় অভিযোগ না দিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

দোকানটি বর্তমানে চালাচ্ছেন খালেদ আব্দুল্লাহ নামের একজন। ১৭ আগস্ট গিয়ে তাঁকে দোকানে পাওয়া যায়নি। দোকানে থাকা কর্মচারী সবুজ বলেন, জায়গাটি ১৭ বছর ধরে অন্যদের দখলে ছিল। আসল মালিক এখন দোকানটির দখলে নিয়েছেন।

চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মোড়ে আইনজীবী দীলিপ কুমার মল্লিককে ৭ মে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে সন্ত্রাসীরা পরদিন তাঁকে একটি ট্যাক্সিক্যাব থেকে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে পরিবারটির আতঙ্ক কাটেনি।

আবাসন খাতেও চাঁদাবাজি হচ্ছে। রমনা বিভাগের হাজারীবাগে সেবা হোল্ডিংস লিমিটেডের নির্মাণাধীন ভবনে গত জানুয়ারিতে সন্ত্রাসীরা ৫০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে হামলা চালায়। পল্লবীর আলব্দিরটেকে এ কে বিল্ডার্সের অফিসে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে পল্লবী থানায় মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। এ কে বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান কাইউম আলী খান বলেন, ‘জামিল’ পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে ৫ কোটি টাকা দাবি করেন।

বুড়িরটেকের রোজ গার্ডেন টাওয়ার প্রকল্পেও চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, শ্যামবাজারে চাঁদাবাজিতে জড়িত হিসেবে এক শ্রমিক নেতার, যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদে একজনের, ওয়ারী ও দয়াগঞ্জে একজনের এবং পুরান ঢাকা ও লালবাগে একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী চাঁদাবাজিতে যুক্ত বলে নাম রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীর নামও রয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার তালেবুর রহমান জানান, প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত