Ajker Patrika

‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’

মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
আপডেট : ০২ মে ২০২২, ০০: ২৪
‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’

আজ মহান মে দিবস। সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের দীপ্ত সংগ্রামের দিন। মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কর্মঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায্য মজুরির প্রশ্ন। আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণি ১৮৮৬ সালে ইতিহাস বদলে দেওয়া আন্দোলন শুরু করেছিল। বীরত্বপূর্ণ সে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেও শ্রমিকেরা এখনো বিভিন্ন কারখানায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছেন না। আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে নানাভাবে তাঁদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মাস শেষে শ্রমিকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তাতে তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নিশ্চিত করতে পারেন না। 

প্রতিটি উৎসবের আগে তাই এখনো বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হয়। এটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি বছর এমন ঘটনা বলে দেয়—এ দেশের শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ এই শ্রমিক শ্রেণির কারণে রাষ্ট্র বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। এ দেশের শ্রমিকেরা রপ্তানিতে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ করেও পাচ্ছে সর্বনিম্ন মজুরি। যদিও সরকার ও মালিকপক্ষ থেকে বলা হয়, শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতির মূল হাতিয়ার। শ্রমিকের শ্রমে ও ঘামে বাড়ছে জাতীয় উৎপাদন। কিন্তু সে অনুপাতে তাদের মজুরি বাড়ছে না। এ যেন ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’। 

ঈদ আসন্ন। ঈদের আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন প্যারাডাইস ক্যাবলস কারখানার শ্রমিকেরা। এ কারখানার শ্রমিক মো. রাসেল হোসেন বলছেন, ‘আমাদের ১১ মাস ১৫ দিনের বকেয়া বেতন বাকি। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে আমাদের মালিকপক্ষের কথা হয়েছে। মালিকের বক্তব্য হলো আমাদের এ কারখানা থেকে শতভাগ উৎপাদন হয় না। তাই বেসিকের ৬০ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। আর ধীরে ধীরে বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।’ 

এই হিসাব মানতে রাজি নন রাসেল। তাঁর দৃষ্টিতে এটা শ্রমিক ঠকানোর অজুহাত মাত্র। বললেন, ‘আসলে আমরা শ্রমিকেরা সব সময় অবহেলিত। প্যারাডাইস কেবলসের শ্রমিকেরা যে এ দেশে একমাত্র শোষিত শ্রমিক, তা কিন্তু নয়। আমরা তো দেখি দেশের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। এসব কলকারখানার শ্রমিকেরা মালিক দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত। আমরা যখন আমাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামি, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়।’ 

কারখানায় কাজ করতে গেলে শ্রমিকদের যেমন বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, তেমনি কারখানার মালিকদের জন্যও রয়েছে নিয়মকানুন। মালিকপক্ষ যেন নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের নির্যাতন করতে না পারেন, সে বিষয়টিও আইনে আছে উল্লেখ করে রাসেল বলেন, ‘আমাদের মালিকেরা চার ভাই। তাদের নিজেদের সম্পত্তি ভাগাভাগির জন্য কোন্দল চলছে। আর এর প্রভাব পড়ছে আমাদের মতো শ্রমিকদের ওপর। তাদের কোন্দলের কারণে আমরা শ্রমিকেরা মাস শেষে বেতন পাচ্ছি না। বেতন না পেলে শ্রমিকদের অসহনীয়ভাবে জীবন চালাতে হয়। আমার ১৪ মাসের এক মেয়ে আছে। টাকার অভাবে তার চিকিৎসার খরচ দিতে পারছি না। আবার নিজেও ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পারছি না। এ কষ্ট শুধু আমার নয়। এ দেশের হাজার হাজার শ্রমিক এ রকম দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।’ 

এবার একটু পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক। শিল্প পুলিশের এপ্রিল মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ-সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিজিএমইএ ১৬১৫টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৩৫টি কারখানায়। বকেয়া রয়েছে ১৫৮০টি কারখানায়। বিকেএমইএ ৬৮৫টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৩১ টিতে; বকেয়া রয়েছে ৬৫৪টি কারখানা। বিটিএমএ ৩৩৮টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৯ টিতে, বকেয়া রয়েছে ৩২৯ টির। বেপজা ৩৪৮টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ১০ টির, বকেয়া রয়েছে ৩৩৮ টির। পাটকলের ৮৩টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৫৮ টির, বকেয়া রয়েছে ২৫ টির। অন্যান্য কারখানা মিলে মোট ৯১৭৬টি কারখানার মধ্যে মোট ১০২৫টি কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। বকেয়া রয়েছে ৮১৫১ টির বেতন-ভাতা। 

শ্রমিকদের পাওনা মজুরি পরিশোধের প্রসঙ্গে বিকেএমই-এর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ‘আমরা সব কল-কারখানায় বকেয়া বেতন, বোনাস পরিশোধ করতে পারিনি। ব্যাংক খোলা আছে। আশা করছি ঈদের আগে শতভাগ কারখানার বকেয়া বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করতে পারব। তবে কয়েকটা কারখানায় কিছু সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কারখানার বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে মালিক পলাতক রয়েছে। আমরা মনে করি, কল-কারখানার যত সমস্যায়ই থাকুক না কেন, শ্রমিকদের বেতন, বোনাস দিয়ে দিতে হবে। আমরা এ বিষয়ে বিকল্প কোনো কথা শুনব না। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে।’ 

মো. হাতেম বলেন, ‘যেসব কারখানা নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে না, সেসব কারখানা আমরা নজরদারিতে রেখেছি। এ ধরনের কারখানার মালিকদের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এসব কারখানার ক্ষেত্রে অনেক সময় কারখানার মেশিন বিক্রি করে হলেও শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করার কথা বলে থাকি।’ 

সময়ের সঙ্গে মে দিবস রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেও শ্রমিকেরা এখনো বিভিন্ন কারখানায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছেন না। ছবি: হাসান রাজাকিন্তু পরিসংখ্যান তো সে কথা বলছে না। অনেক সময়ই দেখা যায়, বেতন-ভাতা বকেয়া রেখে দিনের পর দিন সরকার ও মালিক পক্ষ আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ তেমন একটা দেখা যায় না। এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্প এ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প খাত। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। আবার এ খাতের রপ্তানির পরিমাণও অনেক বেশি। করোনাকালে এ শ্রমিকেরাই দেশের অর্থনীতি টিকেয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শ্রমিকদের মজুরি কম। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করলে মালিক পক্ষ চাকরিচ্যুতির ভয় দেখায়।’ 

ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার তালিকায় শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকেরাই নন। এ তালিকায় আছেন চা বাগানের শ্রমিকেরা। চা শিল্প এ দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। চা শ্রমিকের জীবন ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতো। এখানকার শ্রমিকেরাও কাজ শেষে প্রাপ্য মজুরি পান না। এ বিষয়ে কথা হয় হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের লস্করপুর চা বাগানের চা শ্রমিক বীরেন কালিন্দীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে আমি একজন শ্রমিক। আমার কর্ম দ্বারা আমার বাবা-মা, সন্তানকে খাওয়াতে হয়। সেই হিসাবে আমাদেরর চা শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা হওয়া উচিত। অথচ আমরা মজুরি পাই ১২০ টাকা। প্রতিদিন ২৩ কেজি চা পাতা তুলি। আবার প্রতিদিন যদি ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে না পারি, তাহলে আবার টাকা কেটে রাখা হয়। নারী চা শ্রমিকদের জন্য আবার বাগানে শৌচাগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানকার নারী শ্রমিকেরা অনেক বেশি শোষিত। শোষণের কারণে আমাদের সন্তানেরা লেখাপড়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।’ 

বছর বছর একইভাবে শ্রমিক শোষণের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শ্রমিক অধিকার আদায়ের দীর্ঘ লড়াই নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন। মে দিবসের আলোকে দেশে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘মে দিবসের মূল তাৎপর্য ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবির অন্তরালে এমন একটা মজুরি, যা তার জীবন-জীবিকা নির্বাহে সহায় হবে এবং তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দেবে। এখন মে দিবসের ১৩৬ বছর পর যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৮ ঘণ্টা কাজের মজুরি কাঠামোর দিকে দেখি, তাহলে দেখব ৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়—এমন কোনো মজুরি কাঠামো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে যে গার্মেন্টস খাত থেকে, সে খাতের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এই খাতে আইন করে মালিকদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ আইন বলে মালিকেরা এই খাতের শ্রমিকদের এমনকি ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নিতে পারছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে মজুরি পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।’ 

শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত এবং কতগুলো কারখানায় এটি নিশ্চিত হয়েছে জানতে চাইলে রাজেকুজ্জামান বলেন, ‘শ্রমিকদের কতটুকু মজুরি হলে সেটা ন্যায্য হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই বিষয়ে আমরা অন্তত বলতে চাই, সরকারের মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, পে স্কেলে সর্বনিম্ন মজুরি কত হবে এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি কত হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের জন্য পে স্কেলে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল বেসিক ৮ হাজার ২৫০ টাকা। আর মজুরি কমিশনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল ৮ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৫ সালের ৮ হাজার ২৫০ টাকা বেসিক হলে সেটা বর্তমান সময়ের বাজার দর অনুযায়ী ২০২২ সালে ২০ হাজার টাকার ওপরে হয়। এখন কথা হলো সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন এ মজুরি বাংলাদেশের কোনো খাতে কি দেওয়া হয়? সরকার যে মজুরি নির্ধারণ করেছিল, তাও বৈষম্যমূলক ছিল। কিন্তু সে বৈষম্যমূলক মজুরিও যে বেসরকারি মালিকেরা দিচ্ছেন না, সে ব্যাপারে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এই পলিসিই চলছে সবদিকে।’ 

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আমরা দেখছি সরকার নির্ধারিত মজুরি কমিশনের মজুরিও ৪৩টি খাতের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ড কার্যকর করেনি। ৪৩টা সেক্টর মজুরি নির্ধারণ করার কথা শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর পরপর। এর মধ্যে প্রায় ২৯টা মতো সেক্টরে ২০১৩ সালের পর থেকে মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। সরকারের নীতি অনুযায়ী যদি প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়, তাহলে ২০১৩ সাল থেকে সরল হিসাব করলেও গত ৮ বছরে অন্তত ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যার মানে হলো ২০১৩ সালে শ্রমিক ১০০ টাকায় যে জিনিস কিনতেন, তা এখন কিনছেন ১৪৮ টাকায়। করোনাকালে একদিকে শ্রমিক তার কাজ হারিয়েছে, অন্যদিকে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সবকিছুর দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে শ্রমিকের জীবনের সব ক্ষেত্রে। আমাদের শ্রমিকদের আয়ের প্রায় ৬২ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যপণ্য ক্রয়ের পেছনে। ফলে মজুরি কমলে তার পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দেবে, যা শুধু তার নয়, তার পরবর্তী প্রজন্মের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও প্রভাব ফেলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর: ৭ বছরেও জোড়া লাগেনি সেতু

বিশ্বজিত রায়, সুনামগঞ্জ
সাত বছরেও জোড়া লাগেনি তাহিরপুরের শাহ আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতুর দুই পাড়। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। আজকের পত্রিকা
সাত বছরেও জোড়া লাগেনি তাহিরপুরের শাহ আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতুর দুই পাড়। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। আজকের পত্রিকা

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় জাদুকাটা ও পাটলাই নদের ওপর ১২৯ কোটি টাকা প্রাক্কলনের দুটি সেতুর নির্মাণকাজ সাত বছরেও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দুই সেতুর বিল বাবদ ৮০ ভাগের বেশি টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। আড়াই বছর মেয়াদ নির্ধারণ করা হলেও কয়েক দফায় সময় বাড়িয়ে ফেলে রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জাদুকাটা নদীর ওপর আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতু এবং পাটলাই নদের ওপর ডাম্পেরবাজার-বালিয়াঘাট নতুন বাজার সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা হয়।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতু নির্মাণকাজ ফেলে রাখায় তমা কনস্ট্রাকশনের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। যদিও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা মাস ছয়েকের মধ্যে সেতু দুটির কাজ শেষ করবে।

এমন অবস্থায় বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতু দুটির কাজ কবে শেষ হবে এবং চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে উপজেলার বাসিন্দারা।

জানা গেছে, কৃষি, মৎস্য, পর্যটন ও খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী উপজেলা তাহিরপুর। এ ছাড়া উপজেলাটির ডাম্পেরবাজার এলাকার তিনটি শুল্ক স্টেশন দিয়ে কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি করা হয়। এসব কারণে জাদুকাটা ও পাটলাই নদের ওপর দীর্ঘ দিন ধরে সেতু নির্মাণের দাবি ওঠে।

সুনামগঞ্জ এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, শাহ আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। জেলার দীর্ঘতম ৭৫০ মিটারের মৈত্রী সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৮৫ কোটি ৯৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৭৮ টাকা। এর মধ্যে ৬৭ কোটি ৬১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা বিল উত্তোলন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

একই মাসে পাটলাই নদের ওপর ডাম্পেরবাজার-বালিয়াঘাট নতুন বাজার সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৪৫০ মিটার সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৪৩ কোটি ৭৬ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৯ টাকা। সেতু দুটি বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ৩০ মাস। সেই হিসাবে ২০২১ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না করেই ৩৫ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৮৯৯ টাকা তুলে নিয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন। মৈত্রী সেতুর ৭৮ ভাগ কাজের বিপরীতে বিল তুলে নিয়েছে ৭০ ভাগ। ডাম্পেরবাজার সেতুর ৮৫ ভাগ কাজে বিল দেওয়া হয়েছে ৮০ ভাগ।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, মৈত্রী সেতুটি মাঝখানের অংশের কাজ শেষ হয়নি। এ ছাড়া ডাম্পেরবাজার-বালিয়াঘাট নতুন বাজার সেতুর সংযোগ সড়কের কাজও বন্ধ রয়েছে। সেখানে চারাগাঁও-বড়ছড়া শ্রমিক সর্দার কল্যাণ সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন ও স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. বজলুল আমিনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, মূল সেতুর কাজ হলেও সংযোগ না হওয়ায় সেতুটি কাজে আসছে না।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাহিরপুরের সীমান্ত এলাকা মেঘালয় খাসিয়া পাহাড়ের নিকটবর্তী টাঙ্গুয়ার হাওর, টেকেরঘাট শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি), শিমুলবাগান, বড়গোপ টিলা, বারেকটিলা, লাকমাছড়া, সীমান্ত হাট, জাদুকাটা, অদ্বৈত জন্মধাম, শাহ আরেফিন (রহ.) মাজারকেন্দ্রিক পর্যটন, কৃষিপণ্য বিপণন এবং বাগলি, বড়ছড়া, চারাগাঁও—তিন শুল্ক স্টেশনের যাতায়াত সুবিধার্থে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এ ছাড়া জেলা সদর থেকে বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর সীমান্ত

এলাকা হয়ে মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত সহজ হবে।

তমা কনস্ট্রাকশনের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিয়া মো. নাছির মোবাইল ফোনে বলেন, ‘ডাম্পেরবাজার সেতুর সামান্য কাজ বাকি আছে। মৈত্রী সেতুর কাজ আগামী মাস ছয়েকের মধ্যে শেষ করা হবে। বিগত বন্যায় মৈত্রী সেতুর একাধিক পিলার ভেঙে অনেক নির্মাণসামগ্রী তলিয়ে গেছে। আমাদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারপরও আমরা কাজ দ্রুত করার চেষ্টা করছি।’

এলজিইডির সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মৈত্রী সেতুর কাজ দীর্ঘদিন ফেলে রাখায় সম্প্রতি ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে ডাম্পেরবাজার সেতুর কাজও শেষ হচ্ছে না। এ জন্য আমরা অসমাপ্ত কাজের প্রাক্কলন তৈরি করে প্রকল্প অফিসে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক প্রাক্কলনটি ফেরত পাঠিয়েছেন। ফের তা সংশোধন করে পাঠানো হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী: টার্মিনাল নেই, নাকাল মানুষ

  • ৫৩ বছরেও নির্মাণ করা হয়নি নির্দিষ্ট বাস টার্মিনাল বা যাত্রীছাউনি।
  • যেখানে-সেখানে যাত্রী ও মালপত্র ওঠানো-নামানোয় বাড়ছে যানজট।
  • গত ১০ মাসে ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর)
বাস টার্মিনাল না থাকায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর শহরের উর্বশী সিনেমা হলের সামনে সড়কে যাত্রী ওঠানো-নামানোয় যানজট। ছবি: আজকের পত্রিকা
বাস টার্মিনাল না থাকায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর শহরের উর্বশী সিনেমা হলের সামনে সড়কে যাত্রী ওঠানো-নামানোয় যানজট। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তরের জেলা দিনাজপুরের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা শহর ফুলবাড়ী। দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর গড়ে ওঠা জনবহুল এই শহর দিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে শত শত বাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখানকার মানুষ এখনো একটি নির্দিষ্ট বাস টার্মিনাল বা যাত্রীছাউনি থেকে বঞ্চিত। ফলে প্রতিদিনই শহরের রাস্তায় লেগে আছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। এতে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। গত ১০ মাসে ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল উপজেলা ফুলবাড়ী। জেলা সদর থেকে ফুলবাড়ী হয়ে ঢাকাগামী আঞ্চলিক মহাসড়কটি ফুলবাড়ী উপজেলা শহর দিয়ে গেছে।

উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন ছুটে চলে শত শত যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক ও পণ্যবাহী যানবাহন। তবে ফুলবাড়ী হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলেও আজও উপজেলার পৌর শহরে নির্মাণ হয়নি কোনো বাস টার্মিনাল। ফলে শহরের যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং মালবাহী ট্রাকগুলো থেকে পণ্য আনলোড করা হয় সড়কের ওপরই। এতে মহাসড়কের উভয় পাশে যানজট সৃষ্টি হয় প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়ায় সড়ক পারাপারে পথচারীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। বিশেষ করে ফুলবাড়ী নিমতলা মোড় ও নৈশকোচ কাউন্টারের সামনে এবং বটতলি মোড়ে সড়কের ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায় পৌর শহর দিয়ে যাওয়া দিনাজপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের ফুলবাড়ী শহরের অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে।

ফুলবাড়ী থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২৩ জন। আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘যানজটের কারণে প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাতে হয়। শহরের যেখানে-সেখানে সড়কের ওপর গাড়ি থামায়। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। কষ্টটা আমাদেরই পোহাতে হয়। একটা টার্মিনাল হলে এই ভোগান্তি অনেকটা কমে যেত।’

শিক্ষক মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, নির্দিষ্ট বাস টার্মিনাল না থাকায় পৌর শহরের ঢাকা মোড় (শাপলা চত্বর) থেকে উর্বশী সিনেমা হল পর্যন্ত দূরপাল্লার বাস কাউন্টারগুলো জায়গা সংকটে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় রয়েছে। ওইসব কাউন্টারে বাস সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। ফলে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পায়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।

দিনাজপুর মটর পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ফুলবাড়ী স্টান্ড শাখার সভাপতি মহসীন আলী সরকার বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব এক একর জায়গা রয়েছে। কিন্তু আর্থিক সংগতি না থাকার কারণে আমাদের পক্ষে বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওই জায়গায় সরকার যদি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করে দেয়, তবে যানজটসহ সড়ক দুর্ঘটনা ও শহরের যত্রতত্র দূরপাল্লার যানবাহন দাঁড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইসাহাক আলী বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু জটিলতা আছে অনেক। কারণ, দূরপাল্লার কোচগুলোর দাঁড়ানোর কোনো নির্ধারিত স্থান নেই। তারা পৌর শহরের ঢাকা মোড় এলাকায় যেতে চায় এবং কাউন্টার করে দিতে বলে। কিন্তু কাউন্টার করা ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার। এটা কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে, যদি কখনো কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে তাহলে এটা করা সম্ভব হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

একই আসনে মুখোমুখি বিএনপি ও জামায়াত দুই ভাই

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
আজিজুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক
আজিজুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-৪ আসনে (চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুর) বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে আপন দুই ভাইকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক এবং বিএনপির আজিজুর রহমান।

তাঁরা জেলার রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তাঁদের বাবার নাম মনছুর আহমেদ। তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

গত সোমবার বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় কুড়িগ্রাম-৪ আসনে জেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য আজিজুর রহমানের নাম রয়েছে। এদিকে কয়েক মাস আগে জামায়াত থেকে ওই আসনে তাঁর ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাককে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আপন দুই ভাই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হলেও দুজনই জয়ের ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও এটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না বলে দাবি তাঁদের। এদিকে বিষয়টি এখন ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

অনলাইন ট্রেডিং সাইট

অনলাইনে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব ৪ শতাধিক পরিবার

  • সবার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নে।
  • ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের দাবি।
  • গত সোমবার সকালে সাইটটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
  • পুলিশি ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ ভুক্তভোগী মুখ খুলতে রাজি হননি।
মেহেরাব্বিন সানভী, চুয়াডাঙ্গা
আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭: ২৭
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ক্লিনো ইমেক্স (Cleano IMEX) নামক একটি অনলাইন ট্রেডিং সাইটে বিনিয়োগ করে সব খুইয়েছে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর ইউনিয়নের চার শতাধিক পরিবার। দ্বিগুণ মুনাফার লোভে ধারদেনা, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ করেছিল পরিবারগুলো। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্লিনো ইমেক্সে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছে তারা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই প্রতারণার শুরু সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে। প্রায় চার মাস আগে মালয়েশিয়াপ্রবাসী আশিক (২২) নামের এক যুবক গ্রামের দুই তরুণ—নিরব হোসেন ও আকাশ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আশিক তাঁদের জানান, ‘ক্লিনো ইমেক্স’ সাইটে টাকা রাখলে প্রতিদিন শতকরার ভিত্তিতে লাভ পাওয়া যায়। ১০০ টাকায় দৈনিক ৪ টাকা লাভ। এমন লোভনীয় প্রস্তাবে প্রাথমিকভাবে নিরব ও আকাশ কাজ শুরু করেন এবং কিছু টাকা লাভও তোলেন। এরপর তাঁরা গ্রামের আরও পাঁচজনকে নিয়ে মোট সাতটি দল তৈরি করে এই ‘লাভজনক’ স্কিম দ্রুত ছড়িয়ে দিতে থাকেন।

এই চক্রের প্রলোভনে পড়ে সদর উপজেলার বোয়ালিয়া, শ্রীকোল, নেহালপুর, হিজলগাড়ি, বলদিয়া বড়শলুয়াসহ আশপাশের গ্রামের বহু মানুষ নিরব ও আকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা জমা দিতে থাকেন। হোয়াটসঅ্যাপ-ভিত্তিক পৃথক গ্রুপ তৈরি করে এই দুই হোতা বিনিয়োগকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন।

জানা যায়, শুধু নিরবের গ্রুপেই সদস্যসংখ্যা ছিল ২১৮ জন। নিজেদের বিনিয়োগ এবং অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া কমিশন মিলিয়ে নিরব ও আকাশ প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতেন, যা দেখে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ আরও বেশি আকৃষ্ট হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালিয়া গ্রামের এক কৃষক জানান, প্রথমে বিশ্বাস না হলেও গ্রামের অনেকের লাভ দেখে তিনি হালের গরু বিক্রি করে এবং নিজের জমানো টাকাসহ মোট ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ওই সাইটে দিয়েছিলেন। এখন সাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সব হারিয়েছেন।

একই গ্রামের কালাম নামের একজন বলেন, ‘টাকা দ্বিগুণ হওয়ার আশায় উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম পাখি ভ্যানটি বিক্রি করে সেই টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন আমি পথের ফকির।’ ইজিবাইক চালক মিজানুর ছোট ভাইয়ের কথায় ১৮ হাজার টাকা জমা করে এখন বাকরুদ্ধ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু নেহালপুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামেরই দুই শতাধিক ব্যক্তি ‘ক্লিনো ইমেক্স’ সাইটে ৬ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছিলেন। এ ছাড়া শ্রীকোল, নেহালপুর, কুন্দিপুর, হিজলগাড়ি, বলদিয়া ও বড়শলুয়ার অন্তত দুই শ পরিবার বিভিন্ন পরিমাণে বিনিয়োগ করেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষজন—কেউ হালের গরু, গাভি, স্ত্রীর গয়না বিক্রি করে, কেউ এনজিও বা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে, আবার কেউ-বা জমি বন্ধক রেখে এই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।

গত সোমবার সকালে যখন সাইটটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তখন গ্রামজুড়ে নেমে আসে হাহাকার। মান-সম্মানের ভয় এবং পুলিশি ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ ভুক্তভোগী প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) জামাল আল নাসের বলেন, ‘নিশ্চয়তা না থাকা সত্ত্বেও অনেকে অসচেতনভাবে এই অনলাইন সাইটে টাকা বিনিয়োগ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও থামানো যাচ্ছে না। নেহালপুর ইউনিয়নের ঘটনাটি শুনেছি। এ বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য থানা-পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো কেউ অভিযোগ করেননি। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত