Ajker Patrika

ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা

মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে প্রতারণা করত শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানি। এভাবে তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহ আলম ও তার চার সহযোগীকে গতকাল শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। 

র‍্যাব বলছে, প্রতারণা চক্রের সদস্যরা সবাই এক সময় বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি করতেন। এরপর একসময় চাকরি ছেড়ে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের নিয়োগ দেওয়া তিন শতাধিক মাঠকর্মীর মাধ্যমে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষের কাছ থেকে দুই শতাধিক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এই টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা নিজেদের নামে জমি ও ব্যাংকে বিনিয়োগ এবং ব্যাংক লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছে। ফলে গ্রাহকেরা টাকা ফেরত চাইলে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে সবাই আত্মগোপনে যায়। বর্তমানে তাদের যে সম্পদ আছে, তা দিয়ে গ্রাহকের টাকা অর্ধেকও পরিশোধ করা যাবে না বলে দাবি র‍্যাবের। 

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আজ রোববার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। 

র‍্যাব কর্মকর্তা বলেন, নরসিংদীর শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানিতে বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে নেওয়া হতো আমানত। আর প্রতিষ্ঠানটিতে আমানত রাখতে হলে আগে দিতে হতো ধর্মীয় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাস করলেই করা হতো সদস্য, নেওয়া হতো আমানত। এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার বিষয়টি টের পেয়ে টাকা ফেরত চাওয়ার পরই আত্মগোপনে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা। অভিযোগ পেয়ে অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—প্রতারক চক্রের অন্যতম হোতা শাহ আলম, দেলোয়ার হোসেন শিকদার, কাজী মানে উল্লাহ, সুমন মোল্লাহ, আব্দুল হান্নান মোল্লাহ। তাদের সকলের বাড়ি নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায়। 

ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক সমবায় সমিতিতে বিনিয়োগে মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের দুই’শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নরসিংদীতে পাঁচ থেকে ছয় হাজার সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে জানিয়ে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, ভুক্তভোগীরা নরসিংদীর পলাশ থানায় একটি মামলা করেন। পাশাপাশি জেলা প্রশাসন ও সমবায় অধিদপ্তরে অভিযোগ দেয়। এরপরই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। 

খন্দকার আল মঈন জানান, নরসিংদী এলাকায় বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় কাজ করতেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা। কাজের সূত্রে পরিচয় কাজে লাগিয়ে শুরু করেন এই প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালে নরসিংদীর সদর থানার চিনিশপুর ইউনিয়নের ঘোড়াদিয়া এলাকায় গড়ে তোলেন শরিয়াভিত্তিক শাহ সুলতান মাল্টিপারপাস কোম্পানি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে এমএলএম কার্যক্রম শুরু করে তারা। সুকৌশলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সুদ মুক্ত ব্যবসার কথা বলে বিভিন্ন পেশার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। সাধারণ মানুষের মাঝে বিশ্বাস অর্জনের জন্য নেওয়া হতো ধর্মের পরীক্ষা। সুদমুক্ত জীবন মুনাফার ফাঁদে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে প্রতিষ্ঠানটি। 

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে শাহ আলম চারটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ২৪ জন কর্মচারী ও ২০ জন পরিচালক নিয়োগ করা হয়। পরিচালকদের সবাই প্রতারক শাহ আলমের সহযোগীদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজন। 

গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারণা চক্রের সদস্যপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকারীদের সংখ্যা বাড়াতে নরসিংদীর বিভিন্ন থানায় জাঁকজমকপূর্ণ শাখা অফিস ও কারখানা প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-শাহ সুলতান এম. সি. এস. কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. , স্বদেশ টেক্সটাইল লিমিটেড, শাহ সুলতান টেক্সটাইল লিমিটেড ও শাহ সুলতান প্রপার্টিজ লিমিটেড। 

র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানের মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য তিন শতাধিক কর্মী রয়েছে। যাদের কোনো প্রকার বেতন দেওয়া হতো না। গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে এককালীন ১০ শতাংশ ও বছরে ছয় শতাংশের প্রলোভন দেওয়া হতো। আর বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক ১২-১৬ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখানো হতো। 

এ ছাড়া তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে ‘ডিপিএস’-এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করত। বেশ কিছু গ্রাহককে বেশি বা উচ্চ মুনাফায় লোনও দেয়। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান না হলেও তারা ব্যাংকের মতই গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ প্রদান কার্যক্রম করেছিল। গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা টাকায় জমি কেনা ও টেক্সটাইল মিলে (কারখানা) বিনিয়োগ এবং নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে সাধারণ গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে প্রতিষ্ঠানটি। 

ইসলামিক কৌশলে প্রতারণার ব্যাপারে কমান্ডার মঈন বলেন, ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা ও ইসলামিক কিছু কৌশল অবলম্বন করে এই প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি। সাধারণ মানুষের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য তারা ধর্মীয় অনুভূতির পরীক্ষা নিতেন। ইসলামিক শরিয়ত মোতাবেক সবকিছু মেনে চলছেন কী না, এই বিবেচনায় গ্রাহকদের সদস্যপদ ও বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেওয়া হতো। এ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট জেলা কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং ওই এলাকায় ২০১০ সালের আগে তারা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা থাকায় মানুষের বিশ্বস্ততার জায়গা অর্জন করে। 

র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রাহকের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পারসেনটেন্স দেওয়া হতো; বেতন দেওয়া হতো না। আর নিজেদের নামে তারা জমি কিনেছে ৷ পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে, আবার সেই ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। গ্রাহকদের টাকা দিয়ে দুটি টেক্সটাইল মিল ও স্বদেশ প্রপার্টিজ নামে একটি কোম্পানি খুলেছিল। 

খন্দকার মঈন বলেন, শাহ সুলতানের চারটি প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচ থেকে ছয় হাজার গ্রাহক রয়েছে। তাদের তথ্যমতে আরও অনেক টাকার প্রতারণা করেছে। তবে এই টাকাগুলো ব্যাংকে রাখেনি। প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের ২০ জন থাকলেও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের তথ্যমতে, করোনাকালীন সময়ে তারা লাভ করতে না পারায় গ্রাহকদের টাকা দিতে পারেনি। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের যে সম্পদ রয়েছে তা বিক্রি করলে ৫০ কোটি টাকার মতো হবে। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত