Ajker Patrika

অপহরণের পর সামলাতে না পেরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রহিমকে

সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
অপহরণের পর সামলাতে না পেরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় শিশু রহিমকে

চট্টগ্রামে শিশু শফিউল ইসলাম রহিমকে (১১) অপহরণের পর তাঁকে সামলাতে না পেরে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পিটিয়ে হত্যা করে আসামিরা। পরে লাশ মাটির নিচে পুঁতে রেখে তার পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, পুলিশ, আসামির স্বীকারোক্তি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। 

এর আগে গত ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন পশ্চিম মোহরার মাজার গেট এলাকার বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় শিশু শফিউল ইসলাম ওরফে রহিম (১২)। ওই দিন রাতে থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন নিহতের বাবা মো. সেলিম। এরপর গত বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে রহিমের বাসার কাছেই একটি নির্মাণাধীন কাঁচাপাকা বাড়ির গর্ত থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত শিশুর নিকটাত্মীয় মো. আজম ও তাঁর সহযোগী মুজিবুর দৌলা হৃদয় নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এদের মধ্যে আসামি আজম নিহত শিশুর পাশাপাশি বাসা। 

চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খাইরুল ইসলাম শুক্রবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই ঘটনায় আসামি আজম খুনের দায় স্বীকার করে গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।’

ওসি আরও বলেন, আসামি আজম আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। মূলত মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার উদ্দেশ্যে শিশুটিকে অপহরণ করেছিল। কিন্তু অপহরণের পর শিশুটির সঙ্গে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে লাশটি মাটিতে পুঁতে রেখে আসামিরা মুক্তিপণের জন্য শিশুটির বাবাকে ফোন করেছিল। শিশুটিকে খুনের পরই মূলত মুক্তিপণ দাবি করেছিল আসামিরা। 

আসামির জবানবন্দির তথ্য বরাত দিয়ে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হৃদয় মাহমুদ লিটন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ১২ বছর বয়সী শিশুটিকে অপহরণ করার জন্য আসামিরা ১০-১৫ দিন ধরে পরিকল্পনা করছিল। ঘটনার দিন পটকা (বাজি) দেওয়ার কথা বলে শিশুটিকে ফুসলিয়ে নির্মাণাধীন একটি একতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। 

শিশুটিকে সেখানে নেওয়ার পর ১১ বছর বয়সী ওই শিশুটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না আসামি আজম ও তার সহযোগী হৃদয়। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এ সময় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে শিশুটিকে কাঠের বাটাম দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ সেখানে পুঁতে ফেলা হয়। এ সময় রাতে শিশুটির বাবাকে ফোন করে আসামিরা মুক্তিপণ দাবি করে। 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আসামি আজমের পাশাপাশি বাসা ছিল শিশু রহিমের। বিভিন্ন সময় পটকা (বাজি) ফোটাত শিশুটি। এটা নিয়ে শিশুটির প্রতিও ক্ষোভ ছিল আসামির। ঘটনার দিন তাঁকে পটকা দেওয়ার কথা বলে শফিউলকে ফুসলিয়ে নির্মাণাধীন ওই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। 

পশ্চিম মোহরায় স্থানীয় মো. জসিম বলেন, কয়েক মাস আগে আজমের স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যায়। এলাকায় সে কোনো কাজকর্ম করত না। ঘুরে বেড়াত। 

ঘটনাস্থলের পৃথক সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার দিন (২৯ এপ্রিল) বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে নিহত শিশুর বাসার ২০০-৩০০ গজ দূরে একটি নির্মাণাধীন কাঁচাপাকা বাড়িতে শফিউলকে নিয়ে যায় আসামি আজম। একই দিন বিকেল ৫টা নাগাদ পৃথক সিসিটিভি ফুটেজে ভিন্ন রাস্তা দিয়ে আসামিদের বেরিয়ে যেতে দেখা গেলেও শফিউল ইসলাম রহিমকে দেখা যায়নি। 

শিশুটির বাবা সেলিম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিকেলে ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর রাত ১২টায় একটা নম্বর থেকে আমার কাছে ফোন আসে। তাঁরা আমাকে বলে ছেলেকে পেতে ৫০ হাজার টাকা একটা নম্বরে পাঠাতে বলে। এই বলে ফোন কেটে দেয়। মুক্তিপণের জন্যই যদি আমার ছেলেকে অপহরণ করত, তাহলে নিজের রক্ত বেঁচে হলেও ছেলেকে ফিরে পেতে টাকা জোগাড় করে দিতাম। এ জন্য রাতভর তাঁদের ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু কোনো ফোন আসেনি। পরে বিষয়টি পুলিশকে জানাই। 

সেলিম আরও বলেন, ‘আসামি আজম আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের ছেলে। ঈদের দিনও সে আমাদের বাসায় এসে আমার সঙ্গে কোলাকুলি করে গেছে। সে কীভাবে আমার ছেলেকে খুন করতে পারল। আমার এলাকায় কারও সঙ্গে শত্রুতা নেই। কেন এমন হলো।’

চান্দগাঁও থানার পশ্চিম মোহরার মাজার গেট এলাকার মূল রাস্তা লাগোয়া টিনের বেড়া দিয়ে অনেক পুরোনো একটি বাড়ি। এখানেই শিশু রহিম বাবা-মা ও ভাইদের সঙ্গে খেলাধুলায় মেতে থাকত। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে মেজো ছিল। এখন রহিমকে হারিয়ে পরিবারটিতে চলছে শোকের মাতম। 

আজ শুক্রবার ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, এলাকার লোকজনের পাশাপাশি দূর-দুরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজনের ভিড় বাড়িতে। নিহতের বাবা ছোট্ট উঠানে কয়েকটি চেয়ারের মধ্যে একটিতে মুখ অন্ধকার করে বসেছিলেন। এ সময় তাঁকে ঘিরে আরও কয়েকজন সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে বাড়ির ভেতরে নিজ কক্ষে প্রতিনিয়ত কেঁদে যাচ্ছেন রহিমের মা। তিনি শোকে পাথর হয়ে আছেন। এ সময় এলাকায় নারী প্রতিবেশীরা একে একে করে তাঁর কক্ষে ঢুকে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। 

সেলিম আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রীর পরানের টুকরো ছিল রহিম। মায়ের সঙ্গে সমসময়ই দুষ্টুমিতে মেতে থাকত। মাকে জড়িয়ে গালে চুমু দিত। এখন সেই পরানের টুকরো হারিয়ে আমার স্ত্রী শোকে পাথর। কারও সঙ্গে কথা বলছে না।’

অন্যদিকে নিহতের বাড়ির রাস্তার ওপাশেই ছিল আসামি আজমের বাড়ি। স্থানীয় ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে আবদুল্লাহ, খোরশেদ আলমসহ আরও কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ জানান, তাঁদের জীবদ্দশায় এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা এলাকাটিতে আগে কখনো দেখেননি। এ সময় তাঁরা আসামির ফাঁসি দাবি করেন। 

যে নির্মাণাধীন বাড়িতে শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মরদেহ মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়, সেখানে এখনো শফিউলের পায়ের স্যান্ডেল জোড়া পড়ে ছিল। শুক্রবারও উৎসুক জনতা অনেকেই সেখানে এসে ঘুরে গেছেন। একতলা করে ভাড়ার উদ্দেশ্যে নির্মিত বাড়িটি অনেকটা সুনসান। বাড়ির পেছনেই ছিল স্থানীয় একটি পুকুর। ধারণা করা হচ্ছে, শিশুটিকে খুনের পর নির্মাণাধীন বাড়ির দেয়াল পেরিয়ে আসামিরা পুকুর পাড় দিয়ে লাশ সেখান থেকে নিয়ে যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাখাইনে মানবিক করিডর: জান্তার আপত্তিতে সরকারে দ্বিধা

মানবিক করিডরে বাংলাদেশের ফায়দা কী

রোগী দেখতে হবে কমপক্ষে ১০ মিনিট, অতিদরিদ্রদের জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা

সন্ধ্যায় বাজারে গিয়ে নিখোঁজ, ভোরে কালভার্টের নিচে মিলল নারীর লাশ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইচ্ছেমতো’ ব্যয়, দুই বছরে রাষ্ট্রের ক্ষতি ৩৮৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত